fiture
পারমিতা মালী, লেখিকা ও শিক্ষিকা, কোন্নগর,:

             সহ্যের সত্যিই কোনো সীমা থাকে না। কত স্বচ্ছন্দে যে আমরা কাউকে অপমান করতে পারি, সেটা না দেখলে বোঝানো যায় না। ধর্ম, ন্যায়, নীতি, নিয়মকানুন অনেক কিছুর দোহাই দেওয়া যায় ঠিকই, তবুও ঘুরেফিরে সমস্ত আঘাত ওই নরনারায়ণের গায়েই এসে লাগে। আর ধর্ম মানেই বা কি? যা ধারণ করে তাই ধর্ম। যা বারণ করে,তাও ধর্ম। এবার কতটুকু ধারণ করবে আর কতটুকু বারণ করবে,তা নির্ণয় করুক আমাদের শুভবুদ্ধি, নইলে আমাদের ধ্বংস অনস্বীকার্য। 

                      জোমাটো একটা অতি পরিচিত খাবার ডেলিভারি সংস্থা। ইন্টারনেটের ছোঁয়ায় এখন এইসব পরিসেবা স্বচ্ছন্দে আসে আমাদের দুয়ারে। আমরা খাবার কিনি, বাজার করি, ওষুধ কিনি, গাড়ি বুক করি এইসব বাজারচলতি এপ দিয়ে। তারা আমাদের পরিসেবা দেয় সাধ্যমতো । এমএ বিএ পাস করা আমাদেরই ছেলেমেয়েরা হাসিমুখে আমাদের ক্যারিয়ারের কাজ করে। পেট বড় বালাই। সারাদিন খেটেখুটে মাসের শেষে রোজগার হয়তো হাজার দশেক। তাই সই। সরকারি চাকরি সহজসাধ্য নয়। ব্যবসা শুরু করার মূলধনও সকলের থাকে না। ফলে এইসব ছোটোখাটো পেশায় মাথা গলাতে হয় আমাদের যুবসমাজকে।  সারাদিনের শেষে সামান্য কিছু টাকা তো হাতে আসে! সেটা নিজের পরিশ্রমের টাকা! ঘাম ঝরিয়ে রোজগার করা টাকা! এরপর যদি ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন ওঠে তাহলে সে বেচারি যায় কোথায়!


            কাস্টমার দোকান থেকে খাবার কিনছে, জোমাটোর সার্ভিসের মাধ্যমে। সে খাবার কে রেঁধেছে,কে বাজার করেছে, কে বাটনা বেটেছে সেসব  কিছুই সে জানে না, ধরছে ব্যাটা সার্ভিস বয়কে!! কি? না তুই ব্যাটা মুসলমান, আমি তোর ছোঁয়া আমি খামু না !! এটা শ্রাবণ মাস, শিবের মাস, এমাসে বিধর্মীর হাতের ছোঁয়া খাবার সে খাবে না!  আরে  রাঁধাবাড়াটা মুসলমান করেছে কিনা কি সে জানে? দোকানবাজার কে করেছে তাও তো সে জানে না! কোন দোকান থেকে কাঁচামাল  এসেছে, তাও না! অতই যদি ছোঁয়াছানি, তো ঘরে বসে আলোচাল ফুটিয়ে খেলেই হয় ! দোকানের খাওয়ার কিনে খেতে যায় কেন এরা ? দোকান থেকে কেক পাঁউরুটি কিনে খায় না কোনোদিন? রুটির ব্যবসাটা এখনো বেশিরভাগই মুসলিমদের হাতে। রেস্টুরেন্ট ব্যবসাটাও। তখন যে ছোঁয়া লেগে যায়? তার বেলা?

         জোমাটোর কেস টা দেখে একটা পুরোনো গপ্পো মনে পড়লো। তেমন কিছু ত্রেতা মধ্যযুগের গপ্পো নয়, এই বড়জোর বছর পঁচিশ আগের কথা। তখনো বিয়ে হয়নি আমার। বাপের বাড়ির পিছনেই এক বুড়ো-বুড়ি থাকতো, ভাড়া বাড়িতে। বুড়ো অবশ্য সরকারি চাকরিই করতেন, তবে দুজনেরই তীব্র ছুঁচিবাই এর ঠেলায় ঘরদোরের অবস্থা শোচনীয় থাকতো।  পাড়াপড়শিদের কেউ ওবাড়ির চৌকাঠ মাড়াতো না। বুড়িও যেতেন না কারুর বাড়িতে।  সেই যে.... 'প্রথম প্রতিশ্রুতি' র পিসীমাকে মনে আছে তো?  সেই পিসী যেমন করে পুকুর থেকে চান করে ফিরতো , এই বুড়িও সেইভাবে গঙ্গাস্নান করে ফিরতো। এক ঘটি জল... ছিড়িক করে একটু রাস্তায় ফেললো...তার ওপর পা দিলো....আবার একটু ছিড়িক, আবার পরের পা টা দিলো...এই করতে করতে বাড়ি ফিরতো। রিক্সায়ে চাপলে রিক্সাও গঙ্গাস্পর্শ পেতো, সিট টিট ধুয়ে টুয়ে, তবে তিনি তাতে উঠতেন। কোনোক্রমে কায়ক্লেশে ধর্ম, শুদ্ধতা, পবিত্রতা, সব চাপাচুপি দিয়ে রক্ষা করে দুটি প্রাণ  বেঁচে থাকতো। এতো কান্ড করতে গিতে রান্নাটাই হতো নমোনমো করে। তবে নিরামিষাশী নয়, মাছ খেতেন দুজনেই। নিতান্ত দায়ে পড়লে, বা অসুখ-বিসুখে পড়লে, আমাকে দিয়ে বাজারটুকু করাতেন তাঁরা । সেই সূত্রেই মাঝেমধ্যে ঢুকেছি ওই বাড়িতে। আমার এখনো মনে আছে,  বুড়ো কথায় কথায় বলতেন...
       "আমরা হচ্ছি উচ্চ-মধ্যবিত্ত, বুঝেছ? আমরা যা তা জিনিষ ঘরে ঢোকাই না , সেই বুঝে বাজার করবে !!  "

           রাগের থেকে আমার হাসিই বেশি পেতো। মরে গেলে তো কেউ ফিরেও তাকাবে না! চারটে খাট বওয়ার লোক পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ, তবুও কি তেজ দ্যাখো বুড়োর !! ওই বুড়োর থেকেই একবার জেনেছিলাম মেয়েদের মস্তিষ্কর সাইজ নাকি পুরুষের মস্তিষ্ক থেকে অনেকটা ছোট, তাই মেয়েরা যে এতো লাফায় ঝাঁপায়, পুরুষদের সমান হওয়ার জন্য, সেসব বেকার। সেসব কোনোদিনই সম্ভব নয়। 

          তো যাগগে, যে জন্য গল্পটা শুরু করেছিলাম সেটা বলি। কোনো এক দুপুরে একজন মিষ্টির ফেরিওয়ালা এসেছিল।  খুব সম্ভবত লোকাল মেড কোনো শোন পাপড়ির প্যাকেট নিয়ে । পাড়ার অনেকে কিনলো। ওই বুড়িও এক প্যাকেট কিনলো। কিনেই সোজা ঘরে ঢুকে গেলো। খানিক পরেই দেখি হন্তদন্ত করে দৌড়ে বেরিয়ে আসছে!
   কি ব্যাপার? না....
 
 "কি সর্বনেশে কান্ড জানো! ভাগ্যিস চোখে পড়লো! আর একটু হলেই আমার সব্বনাশ হয়েছিল আরকি!"
  "আরে, হলো টা কি?"
 "এই দ্যাখো, প্যাকেটের গায়ে কি লেখা আছে! প্রস্তুতকারক - শেখ আজাম আলি! ভাবতে পারছো!"
 "কি ভাববো?"
 " আরে এটা মুসলমানের তৈরি গো! ভুল করে যদি একটাও খেয়ে ফেলতাম কি হতো বলো তো আমার!"
  "অ... তা কি করবেন এখন প্যাকেট টা দিয়ে? সে ফেরিওয়ালা তো কখন চলে গেছে...!."
  "কি আবার করবো? ডাস্টবিনে এটা ফেলে দিয়ে এক্কেবারে গঙ্গাস্নানটা সেরে আসি আগে। ঘরদোর সব মুছতে হবে আমায় এসে আবার..."
  "দিন আমায় দিন, প্যাকেটটা আমি নাহয় ফেলে দেবোখন। আপনি যান, চানটা সেরে আসুন গিয়ে।"
 "মনে করে ফেলো কিন্তু, আমি চললুম..."
 "আচ্ছা, ফেলবোখন। "

          সে প্যাকেট ডাস্টবিনে যায়নি, বলাই বাহুল্য। কিন্তু বুড়ো-বুড়িগুলোও তো ডাস্টবিনে যায়নি! এইসব বুড়ো-বুড়ি, ছোঁড়া-ছুড়ি  আরো হাজার একটা আছে। আশেপাশেই আছে। এদের ধমকে-ধামকে সিধে করা যায় না। বুঝিয়েও বোঝানো যাবে না..এদের মগজধোলাই হয়ে আছে। এরা এইরকমই থাকবে। একমাত্র শিক্ষা ছাড়া, ওই মগজধোলাই মেশিনে অন্য কোনো মন্ত্র ঢোকানো অসম্ভব। 


         আসলে মানুষ শ্রেষ্ঠ জীব, সেটা আমরা জানি। আর মরাল সায়েন্স অর নো মরাল সায়েন্স, আমরা এই পৃথিবীটা মানুষের বলেই ভাবি। অন্য কাউকে তেমন গুরুত্ব দিই না। মানুষের মধ্যেও ক্ষমতার ভাগবন্টণ বেশ সুনিপুণ হাতে করে নিই। তারপর সারাজীবন কাটিয়ে এসে একদিন আবিষ্কার করি,কিছু আমাদের এক্সক্লুসিভ নয়, আমরা প্রচুর ভুল করে ফেলি,আর সেগুলো শোধরাবার আর কোনো উপায় নেই। আমাদের জন্য স্বর্গ, মর্ত, পাতাল, কেউ সাজিয়ে বসে নেই। বুদ্ধি,মন, হৃদয় এসব ব্যপারগুলো বিবর্তিত হতে হতে আমাদের মধ্যে এসে গেছে। এবার তাদের সঠিক ব্যবহার আমাদের শিখতে হবে। নইলে আমরা নিজেদের মধ্যে মারামারি করে মরে যাব, আর পৃথিবীটাকে প্রচন্ড রাগিয়ে দিয়ে যাব। আমাদের কৃতকর্ম আমাদের ধ্বংস করবে একদিন।
  ' as flies to wanton boys are we to the gods...they kill us for their sports... '( king lier)
 
 
Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours