vromon kahini
জয়ন্ত কুমার সাহা, ফিচার রাইটার, কলকাতা:

আজ দীঘায় প্রথম দিন।

নিউ দীঘায় পুলিশ হলিডে হোম। এখানে সমুদ্রের নিকটতম আবাস - আর তারই নিকটতম আঠাশ নম্বর ঘর। সেখানেই পূর্ব নির্ধারিত ঠাঁই। দ্বিতলের ছোট্ট বর্গাকার বারান্দায় বসে সমুদ্রবিলাস।

বঙ্গোপসাগর !  আহা ! কী অপূর্ব তার অপার সৌন্দর্যের সম্ভার । 

নিরন্তর বয়ে চলেছে অগণিত স্রোত  - চলছে তাদের নিরলস আসা যাওয়ার পালা। তার চরিত্রে ক্লান্তি নেই, শরীরে বার্ধক্য নেই, মনে নিরানন্দ নেই। নিজে বিরাট হয়ে সামনের সব কিছুকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র তুচ্ছাতিতুচ্ছ ক'রে তুলতে পারলেই যেন তার নিষ্ঠুর অহমিকা পূর্ণতা পায়।

রৌদ্রের ছোঁয়া লেগে ফেনিল ঊর্মিমালায় শ্বেতশুভ্র উচ্ছ্বাসের বুদবুদ। তরঙ্গায়িত শরীরি বিভঙ্গে নৃত্যের মুদ্রা আর আপাত স্তিমিত গর্জনে সঙ্গীতের মূর্চ্ছনা। অপূর্বই বটে।

এভাবেই যেন বিস্তৃত বালুতটের চরণ ছুঁয়ে যায় সমুদ্র। শুধুমাত্র দেখার আনন্দেই যেন তাকে নয়ন সার্থক ক'রে দেখা। মন ভ'রে সম্ভোগ আর আকণ্ঠহৃদয়ে অমৃত পান। সমুদ্র যেন তার অতলান্ত বৈভব বুকে নিয়েই গিলে খেতে যায় সমগ্র মূলভূমিকে। তার ব্যাপ্তি বহু জনতার মধ্যেও আমাকে একাকিত্বের বরণডালায় অভ্যর্থনা করে - এক নিঃসীম শূন্যতা - এক অপার্থিব নির্জনতা ...। 

এক অপাপবিদ্ধ যন্ত্রণার বিবরে আত্মগোপন করি। মুখ লুকাতে লুকাতে আর পালাবার পথ পাই না। দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে, আড়ে-বহরে সরীসৃপের মতো ঘিরে ধরে দানবীয় পরিখা।  সামনে দিগন্তরেখায় পিঠঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে অনন্তনীল দৃপ্তফেনিল সমুদ্রের অগাধ জলরাশি। অক্লান্ত অমলিন জলকেলির মধ্যেও অন্তঃসলিলা ফল্গুর মতন নিরন্তর বেজে চলে আমার নিভৃত যন্ত্রণার অনপেক্ষ রুদ্ধসঙ্গীত।  

কোথাও যেন এক অক্টোপাসের মতন এক ছায়াময় বিষন্নতা গ্রাস ক'রে ফেলে আমার আমিত্বকে। কখনও মনে হয় কাছে গিয়ে তাকে একটু ছুঁয়ে দেখি। কখনও মনে হয় নিরাপদ দুরত্ব রাখি। আবার কখনও তার অন্তরে লীন হয়ে থাকার দুর্বার বাসনাও লালন করি।  মনে হয়, অনুভব করি - বুকভরা নিঃশ্বাসের মতোই বুকভরা সমুদ্রকে। সুগভীর অন্তরঙ্গতায় তাকে গ্রহণ করি অন্তরে। আকাঙ্ক্ষা করি, শুধুই এবং শুধুই শরীর নয়, অবগাহিত হোক সমস্ত সত্তা, সর্বাত্মক  অস্তিত্ব, সকল আমিত্ব।

আজ দ্বিতীয় দিন।

সমুদ্রতটের সমান্তরালে পথ দেখিয়ে চলা সৈকতসরণীর আতিথেয়তা গ্রহণ করলাম। পথের ধারে পর্যটকদের বসার জন্য উত্তম ব্যবস্থা। চলার পথ আলোকাকীর্ণ।

২০০৭ সালে একবার এসেছিলাম এখানে। একই হলিডে হোমে ছিলাম। তখন অবশ্য এইরকম বারান্দায় বসে সমুদ্রদর্শনের সৌভাগ্য হয় নি। অসংখ্য নাতিদীর্ঘ ঝাউ-দেবদারুর উপস্থিতিতে অনতিদূরের সমুদ্রও দৃশ্যমান ছিল না। এখন অবশ্য সেদিনের নাতিদীর্ঘ ঝাউ-দেবদারু-নারকেল গাছগুলি বেশ দীর্ঘ হয়ে ঘরে বসেই সমুদ্র দর্শনের আড়ালটুকু সরিয়ে নিয়েছে। 

বাঁদিকের মাঠে বেশ কিছু গাড়ি দাঁড় করানো রয়েছে। বোধহয় একদিনের দীঘা ভ্রমণার্থীদের বাহন সব। পাশেই দু’একটি অশ্ব তৃণ ভোজন ক'রে চলেছে। সামনের বড়ো ঝাউগাছটির অন্তরালে নাম না জানা পাখিদের বিরামহীন কাকলি আমার এই সামান্য অবসর ব্যঞ্জনাময় ক'রে তুলেছে। 

ধীরপায়ে এগিয়ে চলেছি সৈকতসরণী বেয়ে। সুনির্দিষ্ট কোনও গন্তব্য নেই। পথের পাশে বসার জায়গায় কোথাও বিচ্ছিন্ন আবার কোথাও সারিবদ্ধভাবে অনেকে বসে আছেন। কেউ দাঁড়িয়ে আছেন একেবারে সমুদ্রতটে। অপরাহ্নের মেঘলা রোদ গায়ে মেখে ধুয়ে যাচ্ছেন সৈন্ধবজলে। 
কলকাতার রাস্তার ট্রাফিক সিগন্যালের মতন এখানেও গান শুনিয়ে চলেছেন রবীন্দ্রনাথ - 'এরা পরকে আপন করে,  আপনারে পর'। একবার সমুদ্রের দিকে তাকালাম,  একবার সেই গানের দিকে। প্রাণ জুড়ানো উদাসী হাওয়ায় তখন প্রবল স্রোতের শব্দ।

গতবার এসে দেখেছিলাম পুলিশ বিচের দিকটি বেশ নিরালা। সন্ধ্যার পরেই কেমন একটা জনমানবশূন্য তমসাচ্ছন্ন সর্বগ্রাসী নিস্তব্ধতা। বরং নিউ দীঘার প্রধান বিচের দিকটি বেশ জমজমাট। এবারের অভিজ্ঞতা ভিন্ন। এদিকেও এখন লোকারণ্য। 

আমাদের রাজ্যের শ্রেষ্ঠ সমুদ্রতীর্থ এই দীঘা। তাই দিনে দিনেই এখানে বেড়ে চলেছে সমুদ্রপিয়াসী মানুষের ভিড়। তাছাড়া উপরি পাওনা হিসাবে রয়েছে সায়েন্স সিটি, অ্যাকোরিয়াম, নেহেরু মার্কেট, অমরাবতী পার্ক, মোহানা ও ওল্ড দীঘা। আরও একটু অগ্রবর্তী হতে পারলেই উদয়পুর-তালসারি-চন্দনেশ্বর কিংবা তাজপুর-শংকরপুর-মন্দারমণি। একসূত্রে নিবদ্ধ একাধিক সমুদ্রতীর্থ দর্শনের সুবিধা। এই কারণেই অরণ্য যেমন বৃষ্টিকে টেনে আনে তেমনই দীঘার সমুদ্রও টেনে আনছে সমুদ্রাকাঙ্ক্ষী অসংখ্য তৃষ্ণার্ত পর্যটককে। 

গতকাল সন্ধ্যায় গিয়েছিলাম ওল্ড দীঘায়। সেখানে প্রচুর জনসমাগম। কাজের দিনেও ছুটির দিনের ভিড়। টোটো-ভ্যান - এসবের ছড়াছড়ি। তবে মোটামুটি সুলভ।   সমুদ্রের আশেপাশে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা পসরা সাজিয়ে বসেছেন। এ দৃশ্য নিউ দীঘাতেও অনুরূপ। 

ওল্ড দীঘার সমুদ্র তুলনামূলক ভাবে বিধ্বংসী মনে হল। তাছাড়া তটের দিকে এগিয়েও এসেছে অনেকখানি। পাথরের চাঁই ফেলে প্রকৃতির বিরুদ্ধে যথাসম্ভব লড়াই চালাচ্ছে প্রশাসন  - আগামী সমুদ্রের গ্রাস থেকে ওল্ড দীঘাকে আগলে রাখার নিরন্তর প্রয়াস। এছাড়া উপায়ই বা কী। শতসহস্র মানুষের জীবিকা,পর্যটক - এদের দিকে তাকাতেই হয়। (ক্রমশ)

 
Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours