প্রিয়াঙ্কা সরকার, লেখিকা, বর্ধমান:
ভাঙা প্রতিমা বেয়ে পাণ্ডুলিপি ছুঁতেই কালের কথক হতে সুখ চায় মন। অসমবয়সী ছাব্বিশ, আর চৌতিরিশের সময়ের অভিধানে এক মেধাবী প্লাবন পুরুষ, লেখক, সম্পাদক। পত্রগুচ্ছের পাতা ধরে ভাষা যেন খিদে হয়ে ধরা দেয়। ইচ্ছা হয় শব্দগুলো গান হয়ে যাক একবার। অচিনঘরে পড়ে থাকে অক্ষর ব্যর্থতা, দ্বিধাহীন পরিণতি আজ৷
সময়টা ১৮৯৫ এর ১৬ ডিসেম্বর.. উজ্জ্বল ধীময় পুরুষের জীবনে তখন সদ্য পরিপূর্ণ জমি। কিন্তু, অমেরুদণ্ডী রক্তিম স্তবকে মন যে আজ খালি হতে চায়। সেই এয়োতির বুকে মাথা রেখেও যে, বন্ধুর প্রয়োজন। বন্ধু তো সে, যিনি মনের শূন্যতা দেখেও হিসাবের বাইরে রাখবে সুযোগের সম্মোহনী সুর। আর তাই সেই বন্ধুত্বের নারী হলেন ইন্দিরা দেবী। রবীন্দ্রনাথ তার কাকা, কিন্তু এমন কাকা কি কোনো ভাইজির আছে? চিঠির অলিগলিতে বুক চাপা শ্বাস বেরিয়ে আসে, এ যে এক অন্য রবীন্দ্রনাথ। কথা কথা ঝুঁকে পড়ছে নীরবে, আলো আর ছায়া। মন যে বিশ্বাস করতে চাই কেবল। সম্পৃক্তের খাতায় বড্ড ব্যাকুল হতে মন চায়। রবীন্দ্রনাথ চিঠিতে ইন্দিরাকে
বলেছেন, তিনি যে অনুভবের শরীর ছুঁয়ে সবটুকু উজাড় করেছেন,তা না বললে যে নিজের কাছেই মিথ্যা বলা হয়৷ রবীন্দ্রনাথের পত্রগুচ্ছ, কিন্তু ঘরোয়া আটপৌরে চলন শৈলী, মন খোলা নিবেদনের ঘেরাটোপে যাওয়া - আসা।। দিশাহীন জীবন কেটেছে পাতালছায়া নিবেদনে।
প্রশ্ন আসে ইন্দিরা কেন? পাঠক কি তেমন করে চেনে ইন্দিরাকে। ছদ্মবেশের আড়ালে বিশ্বাসের আঙিনায়, যে ইন্দিরাকে রবীন্দ্রনাথ চেনেন - আড়াল টানতে হয় না প্রকাশে। দৈবক্রমে প্রকাশ, যা ব্যক্ত করা সাধ্যের অতীত৷ আসলে গন্তব্য পথে তো সবাই আমরা হেঁটে চলেছি, পথ ভিন্ন ভিন্ন। সত্যপ্রিয়তাই সহজ প্রকাশ হলো ইন্দিরার গুণ। মোহ ছাড়তে নাকি জানে না নারী, তবে কিসের আকর্ষণ!!ইন্দিরার মধ্যে কুন্ঠার খচখচানি। তবে কি অহেতুক বিচিত্র ভাবাবেশ!! নিয়মের অধীনে থেকেই তো জীবনীশক্তি৷ প্রকাশের আনন্দ ভরপুর। মাধুর্যের অধিকার নেই, বেপরোয়া মনের কথাতেই মানবিক ইন্দিরার মনন।
বুক বেয়ে ঝরে পড়ে নিজস্ব চিত্রকল্প। তাই তো নির্বাসনের অন্ধকার নেই। অমূল্য মনের তোরণে "ছিন্ন পত্রাবলী "। কিন্তু দ্বারে আসা শীতার্ত শিবের মতো নির্বাসিত হয় " পূর্ণ পত্রাবলী "।যত দূরে যায়, নিঃসঙ্গতা নির্জনতা গ্রাস করে রবীন্দ্রনাথকে। কাদম্বরী নেই, বেছে নিলেন পদ্মার স্রোত, উপলব্ধির অনুভবের জীবন৷ তিনি ছেড়ে চলে গেলেন বাড়ির কোলাহল, মজলিস, আরাম। কখনও শিলাইদহ, কখনও সাজাদপুর, কখনো গোয়ালন্দের পথ, বিলের আবর্তময় আয়োজন।
পদ্মার চর আর স্নিগ্ধ শান্ত বসন্তজ্যোৎস্না ছুঁয়ে আছে সৌন্দর্য সম্ভোগ৷ ইচ্ছা করে চিঠি গুলো স্মৃতির রাস্তা ধরে জীবন ধন্য করতে, হয় না। চাদর গুটিয়ে বলিষ্ঠ থাইয়ের মতো আড়চোখের তাকায় মৌলিক মন।
ইন্দিরা তবে অখন্ড প্রকৃতি। কিন্তু, পরমরহস্যময় জ্ঞানবৃক্ষ ফল না খেয়েই কি যুগের আবর্তনে ধরা সম্ভব হয়!! আসলে দুকলি লিখে কন্ঠের আবেশে টান থাকলে সখ্যতা সম্ভব, কিন্তু বিচার করলে বিশেষণের খাতায় হাত দিয়ে দ্বিধাহীন স্বীকৃতি অসম্ভব। ভালোবাসার জন্য আত্মবিসর্জন দেখা যায়,আত্মবিসর্জনের আকর্ষণ সম্ভব নয়। মন তো ভালোবাসার চাক্ষুষ অভিধান। মায়া জড়ানো প্রেমের ফুলদানিতে প্রেম ধরা পড়ে না। অনুভবের পসরা তো হয় না, বরং আঘাত লাগলে কেন্দ্রীকরণের ফল বোঝা যায়। খুব বলতে ইচ্ছা করে, " you think me reckless, desperate and mad"।চাকতির মতো চুম্বনের দূরত্ব সৃষ্টিছাড়া উল্লাস নয়, বরং অনুভব, উপলব্ধিই সব। লালায়িত অপরাধে আকাঙ্ক্ষার সুপ্তি
অসীমের আকাঙ্খা হয়ে ধরা দেয়। আসলে রবীন্দ্রনাথ বিয়েটাকেও থিওরেটিক্যাল বলেছেন। মনের ফসল এখানে ঈর্ষণীয় চোরাস্রোত।
সূর্যের এজলাসে তো আর প্রবাসী নিবাস নিয়ে মন চলে না৷ সভ্যতা তো শালীনতা ছুঁয়েই আজই বাধা, সামাজিকতায়। পদ্মার চরে খাঁ - খাঁ কান্না সেঁকে দেয় দূরবর্তী চোখের সাথ৷ আয়ত্তের অতীত হয়ে ইন্দিরাকে বব বললেন রবীন্দ্রনাথ । চাপা আবেগে বুকের শিরা টেনে অমোঘ আকর্ষণে আত্মার মিলন। মন্ত্রমুগ্ধের বুকে ফুলের নিঃশব্দ ঝরে পড়া আন্তরিক গহনতা। কিন্তু উৎসর্গপত্র!! এতো রবিকাকা দিয়েছেন ইন্দিরাকে, তবে!! সঞ্চারের মুক্ত ক্ষেত্র বয়ে বব এসেছে, অসমবয়সী সঙ্গী। এ যে ভাবনার বন্ধু!! একে কি আর অন্য কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়!! রবীন্দ্রনাথ হলেন দুই ছায়ায় নর - নারী৷। প্রকাশিত হলো জীবনের লক্ষণ, মনুষ্যত্বের চিহ্ন, জড়ত্বের প্রতিবাদ৷
পরিবার একসময় হয়ে ওঠে শুষ্ক শ্রাবণ। ভোরের এলোমেলো চুলের মতো ভাবের ঘরে কাঁদে শ্বাস রুদ্ধ শাসন৷ দেবেন্দ্রনাথের শাসন, হুঙ্কার ক্ষীণতর করে রবীন্দ্র মন। হাওয়াদের শিবিরে কাঁদে তীব্র ধ্বনিতত্ত্ব৷ সঙ্গম শেষে যেমন করে আত্মিক দরজা আঁকড়ে ধরে
কান্নার স্রোত, লজ্জার বোধ!! প্রবৃত্তির কান্না মৃত্যুর শীতল বোধ ডুগরে কাঁদিয়ে দেয় বিকশিত অন্তর। ইন্দিরা এবার আচ্ছন্নের বোধে প্রসঙ্গান্তর করে। প্রতিপ্রশ্ন আর প্রত্যয় কাঁদে, জরাগ্রস্থ প্রাণে। এবার আর প্রাবল্য পায় না জীবনীশক্তি। বাসনা, কামনা, দহন লিখলেই আটপৌরে মেয়েলি ভাষা স্থান পায়। খুব বলতে ইচ্ছা করে পারিজাতের কান্নায় ঐশ্বরী।
এবার ইন্দিরার বুনোট বলিষ্ঠ উদ্যম৷ বুনো ঘোড়ার আনন্দ আবেগ, লঘু হয়ে যায়৷ ইচ্ছের আগুনে ঝাঁপ। কলমের আঁচড়ে প্রতি শব্দে তাড়নার দাগ, আর্তি৷ অন্তরকথা খেয়ালী হয়েই লুকিয়ে যায় নীরবতার যাপনে । না, আর কেউ নয়, এ মানবীমুখ কেবল তাঁর.. সংসার নয়.. কুন্ঠাহীন স্বীকারোক্তি ইন্দিরার৷ (ক্রমশ)
অসাধারণ লেখনী শৈলী ।পড়ে মুগ্ধ হলাম সুধী ।এইরকম সুন্দর সুন্দর লেখনী উপহার চাই।।
ReplyDelete