কাজল ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

হতেই পারে তিনি নির্দোষ।
কোনও দুর্নীতির সঙ্গে আপোস করেননি।
দেশের হাই প্রোফাইল রাজনীতিবিদদের অন্যতম। পালান্নিয়াম চিদাম্বরম।

বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই যে প্রশ্নটা ঘুরে বেড়িয়েছে তা হলো, জেল নাকি বেল?
দুপুর তিনটে দশ। সিবিআই অফিসাররা চিদাম্বরমকে নিয়ে পৌঁছে গেলেন রাউজ অ্যাভিনিউয়ের বিশেষ আদালতে। দু'পক্ষের আইনি লড়াইয়ের পর, কিছুক্ষণের জন্য রায়দান স্থগিত রাখল আদালত। ঘড়িতে তখন প্রায় সন্ধ্যা পৌনে সাতটা। সিবিআইয়ের আর্জি মঞ্জুর করলো আদালত। আগামী ছাব্বিশ অগাস্ট পর্যন্ত সিবিআই হেফাজতে গেলেন চিদাম্বরম।
তবে খাতা- কলমে এখনও চিদাম্বরম অপরাধী না, অভিযুক্ত মাত্র।

প্রায় চল্লিশ বছরের সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন। দায়িত্ব সামলেছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর। বুধবার রাতে সেই প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী চিদাম্বরম ক্ষমতা অপব্যবহার, আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগেই সিবিআই- এর হাতে গ্রেপ্তার হলেন। যে তদন্তকারী দল একসময় তাঁর ইশারায় চলতো, সেই সিবিআইয়ের হাতেই গ্রেপ্তার হলেন তিনি। বুধবার রাত থেকেই এই মাননীয় প্রাক্তন মন্ত্রীকে নিয়ে চললো এক জমজমাট নাটক।

প্রশ্ন একটাই। চিদাম্বরম যখন সত্যিই নির্দোষ, তখন তিনি সাতাশ ঘণ্টা গা-ঢাকা দিয়ে কাটালেন কোন যুক্তিতে? মঙ্গলবার দিল্লি হাইকোর্ট তাঁর আগাম জামিনের আবেদন নাকচ করে দেয়। নাকচ করার কারণ, সিবিআইয়ের তদন্তে অসহযোগিতা। ঠিক সে মুহূর্তেই সিবিআইয়ের চোখে ধুলো দিয়ে আত্মগোপন করেন হাই প্রোফাইল এই নেতা। আর ঠিক এখানেই ফের আরেকবার তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের পুনরাবৃত্তি করে ফেললেন চিদাম্বরম।
এ ব্যাপারে চিদাম্বরমের যুক্তি, শীর্ষ আদালতের যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন তিনি। রাতভর কাটিয়েছিলেন নিজের বিশ্বস্ত  আইনজীবীদের সঙ্গে। অভিযোগ, তিনি নিজের মোবাইলের সুইচ অফ রেখেছিলেন। কেন? কিসের আশঙ্কায়? জবাব পরিষ্কার, সিবিআইয়ের হাতে গ্রেপ্তারের আশঙ্কায়। এত আশঙ্কার কারণ কী? তাহলে কি কংগ্রেসের এই হেভিওয়েট নেতাও শেষ পর্যন্ত অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়েছিলেন?

বারো হাত কাকুড়ের তেরো হাত বিচির মতো ঘটনা। যত বড় নেতা তত বড় অঙ্কের দুর্নীতি। বলা হচ্ছে সিবিআইয়ের অভিযোগ সত্যি প্রমাণিত হলে কংগ্রেসের কড়া বিজেপি বিরোধিতা এক জোর ধাক্কা খাবে। 2007 সালে আইএনএক্স মেডিয়াকে তিনশো পাঁচ কোটি টাকার বিদেশী পূঁজি লগ্নিতে আইনের তোয়াক্কা করেননি তৎকালীন অর্থমন্ত্রী চিদাম্বরম। তার বদলে শর্ত ছিল, ছেলে কার্তির ব্যবসায় মদত করতে হবে মামলার অন্য অভিযুক্ত মুখার্জি দম্পতিকে। সরকারি সাক্ষী হিসেবে এমনটাই বয়ান দিয়েছেন পিটার মুখার্জির স্ত্রী ইন্দ্রাণী মুখার্জি। নর্থ ব্লকে বসে পিটারের সঙ্গে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী চিদাম্বরমের সঙ্গে পিটারের রফা হয় মোট চার কোটি টাকায়।
"এক এমন মহিলা যে নিজেই খুনের মামলার অভিযুক্ত, তাঁর কথায় ভরসা করে এগোচ্ছে সিবিআই।" বৃহস্পতিবার সকালে কংগ্রেসের ডাকা প্রেস কনফারেন্সে, এমনটাই কটাক্ষ করেন কংগ্রেসের প্রবক্তা রণদীপ সুরজেওয়ালা। তাঁর কথায়, গণতন্ত্রের খুন করা হচ্ছে। কোনও সাক্ষ্যপ্রমাণ ছাড়াই চিদাম্বরমকে গ্রেপ্তার করেছে সিবিআই। গোটা ঘটনার মধ্যে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ছবি দেখতে পেয়েছে কংগ্রেস।

বৃহস্পতিবার সকালের এই প্রেস কনফারেন্সের প্রায় চোদ্দ ঘণ্টা আগে কংগ্রেস দপ্তরে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েছিলেন চিদম্বরম। অন্য আরও পাঁচজন মামুলি অপরাধীর মতোই তাঁরও দাবি ছিলো, তিনি নির্দোষ। রাজনীতির শিকার হচ্ছেন। ওই ঘটনার পরেই শিকারি শিকারের সন্ধান পেয়ে তাড়া করে। ফের শুরু হয় চিদাম্বরম, সিবিআইয়ের আরেক প্রস্থ চোরপুলিশ খেলা। ঘড়িতে তখন রাত আটটা বেজে দশ মিনিট। কংগ্রেস দপ্তরে সিবিআই হানার আগেই চিদাম্বরম জোড়াবাগে তাঁর বাংলোর দিকে রওনা দেন। তাঁকে ধাওয়া করে সিবিআই ফের হাজির হয় অভিযুক্তের বাংলোতে। কিন্তু ততক্ষণে বন্ধ হয়ে গেছিলো সদর দরজা। শেষ পর্যন্ত দেওয়াল টপকে বাংলোর ভেতরে ঢুকে পড়েন তিন সিবিআই অফিসার। তাঁরা সদর খুলে দেওয়ার পরেই বাংলোতে ঢুকে পড়ে তদন্তকারী দল। সেখান থেকেই গ্রেপ্তার হন চিদাম্বরম। রাতে তাঁকে সিজিও কমপ্লেক্সের যে সিবিআই ভবনে রাখা হয়, সেই কমপ্লেক্সের উদ্বোধন করেছিলেন তিনি নিজে। দিনটা ছিল 2011সালের 30 জুন। এই ঘটনার পরেই চিদাম্বরমকে মনে হচ্ছিলো, ঠিক যেন সম্রাট শাহজাহানের কংগ্রেস সংস্করণ।

বারো বছরের  পুরনো এই মামেলায় পি চিদাম্বরমকেই মূল ষড়যন্ত্রী হিসেবে চিহ্ণিত করেছে সিবিআই। ইতিমধ্যেই আইএনএক্স মেডিয়া মামলায় বাইশবার দিল্লি হাইকোর্ট চিদাম্বরমের জামিনের আবেদন মঞ্জুর করেছে। কিন্তু গত মঙ্গলবার সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়নি। এরপরেও কিন্তু নিজের রাস্তা বদলাননি তিনি। বুধবার রাতে গ্রেপ্তারের পরেও প্রাক্তন মন্ত্রী তদন্তকারী দলের জেরার কোনও উত্তর দেননি বলে অভিযোগ। প্রশ্নের জবাবে চিদাম্বরম পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন বলে সূত্রের খবর।
বৃহস্পতিবার টানটান উত্তেজনা, আর কড়া নিরাপত্তার মধ্যে সিবিআইয়ের বিশেষ আদালতে তোলা হয়  চিদাম্বরমকে। সেখানে আগেই পৌঁছে গেছিলেন চিদাম্বরমের স্ত্রী নলিনী, ছেলে কার্তি। অভিযুক্ত চিদাম্বরমের হয়ে মূলত সওয়াল করেন অভিষেক মনু সিংভি। উপস্থিত ছিলেন আইনজীবী কপিল সিবালও। সিবিআইকে নিশানা করে বলা হয়, চিদাম্বরমকে যেভাবে গ্রেপ্তার, জেরা করা হয়েছে তা আইনবিরুদ্ধ। মামলার কেস ডায়রিকে কটাক্ষ করে বলা হয়, ওটা নিছকই এক ডায়রি। ওতে কোনও সাক্ষ্যপ্রমাণের চিহ্নমাত্র নেই।
তবে ঘটনার শেষে, শেষহাসি হাসলেন সিবিআই কর্তারাই। মামলার গুরুত্বের কারণ দেখিয়ে সিবিআই, চিদাম্বরমের পাঁচ দিন হেফাজতের অর্জি জানায়। আদালত সেই আবেদন মঞ্জুর করে। আগামী ছাব্বিশ তারিখ পর্যন্ত, পি চিদাম্বরমের ঠিকানা সিবিআই হেফাজত।






Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours