choto golpo
পারমিতা মালী, লেখিকা ও শিক্ষিকা, কোন্নগর:  

আজ স্বাধীনতার ৭৩ বছর পূরণ। বর্ষপূতি টা কোনো নতুন কথা নয়, আহ্নিক গতি আর বার্ষিক গতির স্বাভাবিক নিয়মেই একটার পর একটা বছর পেরোয়। আমরাও পেয়ে যাই একটার পর একটা স্বাধীনতা দিবস। তবুও স্বাধীনতার এতগুলো বছর পেরিয়েও তেমন কি খুব একটা এগিয়েছে কি দেশ? অপ্রাপ্তিগুলো বড়জোর জোড়াতালি দেওয়া গেছে, সেগুলো পেরোতে পেরেছি কি? 

এসব কথা বললেই কেন জানি না রাজনীতির কথাই চলে আসে। সে তুমি মানো, কিংবা নাই মানো। রাজনীতি থেকে দূরে থাকা মুশকিল। তবে এখনো এ ভারত উপমহাদেশে জোর যার, মুলুক তারই। রাজনীতি বড় বেসামাল দশায়। তুমি সৎ বা অসৎ যাই হও না কেন, জোরের সঙ্গে না হলে বোধহয় তার কোনো মূল্য নেই। এই বোধটা বুঝতে বুঝতে বুড়ো হয়ে গেলুম। রাজনীতির সামান্য ছোঁয়া কলেজজীবনে সকলেরই থাকে, তারপর একটা বয়সের পর কেউ আর আমরা খামোখা রাজনীতি করি না। আমরা সবাই কেরিয়ারিস্ট। চাকরি খুঁজি, সংসার পাতি, বাচ্চাকাচ্চা আনি সংসারে। আমাদের সবার গল্পই মোটামুটি একই। তবুও দু একটা বেনিয়ম তো থাকেই। দু একটা ধূমকেতু এসে যায় রোজকার চলার পথে।  নীচে একটি ছোট্ট গল্প আছে,  সেটিও তেমনই এক এক্সট্রিমিস্ট কে নিয়ে।....চরমপন্থী নীতির সামান্য এক চরিত্র মাত্র , যেমন অসংখ্য চরমপন্থী মরে তবে একটা ১৫ই আগষ্ট আমরা পেয়েছি...

 সেই কবে থেকে আমরা শিখে বসে আছি, ভগবান শ্রী কৃষ্ণ করেন দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন। যখনই ধরাধামে তার প্রয়োজন হয়, তখনই তিনি আসেন। অর্থাৎ সে শান্তিকামী কিন্তু প্রয়োজনে যুদ্ধবাজ হয় সে। এ হচ্ছে সেই প্যারাডক্স, যা গান্ধীজী ছাড়া আজ পর্যন্ত সমস্থ মানুষকেই অস্বস্তিকর দোলাচলে রেখেছে। শ্রীকৃষ্ণ চরমপন্থী না নরমপন্থী জানি না, তবে এটুকু বুঝি, তিনি রাজনীতি বুঝতেন, আর মহাভারত আমাদের বার বার শিখিয়েছে জীবনদর্শন। 

কতটুকুই বা ইতিহাস পড়েছি আমরা! সবাই জানে দেশভাগের অন্যতম পুরোধা গান্ধীজী। আর শুধু দেশভাগের জন্য মরে গেছে কয়েকলক্ষ লোক, যার কোনো হিসেবই নেই! বিনাকারণে স্বার্থের বলি হয়েছে হাজার হাজার হিন্দু-মুসলমান।  তারপর, এত বছর ধরে, অল্পস্বল্প ইতিহাস আর সমাজবিজ্ঞান পড়ে এটুকু অন্তত বুঝি, যে অহিংস নীতিটা এতো সোজা থিওরি নয়। এটা ভীরুতার অস্ত্র হতেই পারে না। গোটা ভারতবর্ষ জুড়ে এক অর্ধনগ্ন ফকির এক অস্ত্রহীন আন্দোলন গড়ে তুলেছিলো, আর সেটা খুব একটা সহজ জিনিষ ছিলো না। এ ধ্বংসে পৃথিবীতে বেঁচে থাকার ওই একটিমাত্র উপায় আছে আর। অহিংসা।  

নিচে একটা ছোট্ট অণুগল্প রইলো। আজকের দিনের জন্য।

"বিপ্লব" 

একাত্তরের এনকাউন্টারে দুটো গুলি পিঠের মধ্যে ঢুকে গেছিল। ধরা পড়ার ভয়ে ডাক্তারের কাছেও যেতে পারিনি। গুলিও বের করা যায়নি। বাচ্চুদের ট্যাঙ্ক টার পাশে, যেখানে কুকুর থাকার জায়গা, ওইখানটায় দুদিন ধরে লুকিয়ে ছিলাম। জানুয়ারির ওই ঠাণ্ডায়! না খাবার, না ওষুধ। তাও মরিনি। সাধে কি আর বলে,ব্যাটা আগুনখেকো নকশাল! দু দুটো নাইন এম এম গুলি সাক্ষাৎ হজম করে নিয়েছিলাম। 

পুলিশের থেকে রেহাই অবশ্য পাইনি। পরের বছর নভেম্বরেই ধরা পড়েছিলাম। তদ্দিনে পিঠের ক্ষত শুকিয়ে গেছে। মাঝেমাঝে খালি উস্তম খুস্তম ব্যাথা হতো। তখন কাটা পাঠার মতো ছটফট করতুম বিছানায়। কিছু খেলেই বমি হয়ে যায়। তাও, চালিয়েই তো নিচ্ছিলুম। বিছানায় পড়ে থাকার সুযোগ আর ক দিনই বা পেতাম!   

পিস্তলের দুটো গুলি খেয়ে যা ক্ষতি হয়নি, তার চেয়ে বেশি সর্বনাশ করে দিলো পুলিশ। মারের চোটে একটা পা ই নুলো করে দিলো। হাত পায়ের নখগুলো সব উপড়ে দিয়েছিল। বরফে শুয়ে থাকতে থাকতে শালা এমন নিউমোনিয়া ধরলো, এখন সারাবছর ধরে  কাশতে কাশতে দম বেরিয়ে যায়! আরো একটা ক্ষতি করে দিয়েছিল। সে লজ্জার কথা আর.........যাকগে!

জেল থেকে বেরোনোর পর সরকার অবশ্য ভাতা দিয়েছে, তবে তাতে হাড়ির জলও গরম হয় না। একাবোকা লোক, তায় আবার নুলো, হাঁটাচলার মুরোদ নেই লাঠি ছাড়া....। বাপ মার জন্য জম্মে কিছু করিনি,  এখন তাদেরই টাকায় বসে বসে খাই। জেদ করে কলেজ ছেড়েছিলাম, চাকরিবাকরি নেই, তবু মাথার ওপর ছাদ ঠিক জুটে গেছে। বাপের করে দেওয়া ছাদ। পরার জামাকাপড়ও কম পড়ে না এখন। শীতে কাঁপতে হয়না। একটা বুড়ি এসে দুবেলা বাজার হাট রান্না বান্না করে দিয়ে যায়। সেও বাপেরই ব্যবস্থাপনায়।

ভাগ্যেও শিকে ছেঁড়ে মাঝেমধ্যে।  শুনলাম রাজ্যপাল বিপ্লবীদের মেডেল পরাবেন স্বাধীনতা দিবসের ভোরে। ওই বিপ্লবীদের লিস্টে কি করে যেন আমার নামটাও ঢুকে গেছিল। চিঠি এলো একদিন, কুরিয়ারে। 

পনেরোর সক্কালে সেজেগুজে পৌছে গেলুম রাজভবনে। কড়া সিকিউরিটি। মাছি গলার সুযোগ নেই। মোবাইল নেওয়া বারণ। মেটাল ডিক্টেটর বোর্ডে এক একজনকে দাঁড় করাচ্ছে, আর টুঁইইইইই..টুঁইইইইই...শব্দ হচ্ছে। মোবাইল সরাও, ব্যাগ খোলো, দেখি কোথায় কি আছে! যতক্ষণ না ওই টুঁইইইইই টুঁইইইইই শব্দ বন্ধ হবে তোমার ওপারে যাওয়া বারণ।

পুলিশগুলো মোবাইল নিয়ে নিলো আমার। তাও শব্দ থামে না। ব্যাগ খোলো দেখি! খুঁজেপেতে পাওয়া গেলো একটা পুঁটুলি খুচরো কয়েন। অ, তাহলে এইটার জন্য শব্দ হচ্ছে! সরাও কয়েন। তাও শব্দ থামে না..! একি রে বাবা! ঘড়ি, বেল্ট, কোথায় কি আছে, সব খোলো দেখি! কি আশ্চর্য!  শব্দ থামে না কেন? 

সব চেক করেও শব্দ থামানো গেলো না! আবার সেই টুঁইইইই...টুঁইইইই... নুলো বিপ্লবী তখন খিলখিল করে হেসে যাচ্ছে। খোঁজ শা...রা খোঁজ! কোথায় পাবি রে খুঁজে! সে গুলি তো পেটের মধ্যে  !  তোদের বাপ ঠাকুরদের পাপ! তোরাও একটু তার ভাগ নে !!

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours