Fiture
কাজল ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

কী অদ্ভুত দুই ঘটনার মিল দেখুন। মধ্যে সময়ের ফারাক প্রায় বাহাত্তর বছরের।

এবার দশ হাজার অতিরিক্ত আধা সামরিক বাহিনী পাঠানো হলো কাশ্মীর উপত্যকায়। বাহাত্তর বছর আগেও, ঠিক ওই দশ হাজার অতিরিক্ত সেনাই পাঠানো হয়েছিলো কাশ্মীরের পাহারায়। কারণটা সেদিন যা ছিল, আজও তা। পাকিস্তানি হানাদারের হাত থেকে ভূস্বর্গকে বাঁচানো।


সেদিন সেনা পাঠানোর জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহরুকে কাতর আর্জি জানিয়েছিলেন মহারাজা হরি সিং।

অসহায় রাজা পাকিস্তানী হানাদারদের হাত থেকে তাঁর রাজ্য আর প্রজাদের বাঁচাতে দ্বারস্থ হয়েছিলেন দিল্লির।  সেদিন কিন্তু দিল্লি গড়িমসি করেছিল। অগত্যা নেহরুকে খোলাখুলি বলেই বসেছিলেন কাশ্মীরের তৎকালীন প্রাইমিনিস্টার মেহর চন্দ মহাজন, "হয় সেনা পাঠান। নয়ত জিন্নার সঙ্গে সমঝোতা করতে হবে। যে কোনও শর্তে বাঁচাতে হবে শ্রীনগরকে।"

মহাজনের কথা কানে যেতেই রাগে ফেটে পড়েছিলেন পন্ডিতজি। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে তিনি সোজা দরজা দেখিয়ে দিয়েছিলেন মহাজনকে- "গো অ্যাওয়ে।"


গোটা ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন আরও দুজন।

তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল আর কাশ্মীরের ন্যাশনাল কনফারেন্সের নেতা শেখ আবদুল্লা। তাঁরা দুজনেই তখন ঘটনাস্থল নেহরুর ঘরে উপস্থিত।

অপমানিত মহাজন দরজার দিকে পা বাড়াতেই এগিয়ে গেছিলেন প্যাটেল। মহাজনের কানের সামনে ফিসফিস করে বলেছিলেন, "আপনি পাকিস্তানে যাচ্ছেন না।"


এবার নীরবতা ভাঙলেন শেখ আবদুল্লা। তিনি চট করে একটা স্লিপে কিছু লিখে নেহরুকে ধরালেন। নেহরু তা পড়ে বুঝতে পারলেন, "মহাজন যা বলছেন শেখ আবদুল্লাও তাই চান।"

দিনটা ছিল 1947 সালের 26 অক্টোবর। কাশ্মীরের ভাগ্য নির্ধারণ করতে সেদিন নেহরুর বাসভবনে ছুটে গেছিলেন মেহর চন্দ।

"এরপরেই চোখমুখের চেহারা বদলে গেল জওহরলাল নেহরুর।"

তাঁর আত্মজীবনী 'লুকিং ব্যাক' এ লিখেছিলেন মহাজন। 1947 সালের অক্টোবর থেকে পরের বছরের মার্চ পর্যন্ত তিনি কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। 


শেখ আবদুল্লাও ঘোর বিরোধী ছিলেন পাকিস্তানের সঙ্গে কাশ্মীরের সংযুক্তিকরণের। তিনি চাইতেন কাশ্মীরে সাধারণ মানুষের নির্বাচিত সরকার গড়তে। তাঁর সহায় ছিলেন খোদ নেহরু। ওদিকে রাজা হরি সিংও তখন চাপে পড়ে গিয়েছিলেন। তিনিও মানসিক ভাবে তৈরি হচ্ছিলেন আবদুল্লার হাতে জম্মু-কাশ্মীরের রাজদন্ড তুলে দিতে। 


'পাকিস্তানের উপজাতি হামলাবাজরা তখন শ্রীনগর সীমান্তে জমা হয়েছে।' লিখছেন মহাজন। দিনটা ছিল 1947 সালের 24 অক্টোবর।

উবে গিয়েছে 'স্বাধীন কাশ্মীর'-এর স্বপ্ন। রাজা হরি সিংয়ের মাথায় তখন একটাই চিন্তা- কিভাবে বাঁচানো যায় জম্মু-কাশ্মীরকে।

দিশাহারা রাজা হরি সিং। 26 তারিখ প্রধানমন্ত্রী মহাজন ছুটলেন দিল্লিতে। নেহরু, প্যাটেলের কাছে দরবার করলেন- আজ সন্ধ্যার মধ্যেই শ্রীনগরে সেনা পাঠান। বাঁচান কাশ্মীর, শ্রীনগরকে। এক নিঃশ্বাসে এই কথাগুলি বলে একটু থামলেন মহাজন। তারপর সরাসরি নেহরুর চোখে চোখ রেখে বললেন, " আপনি যে কোনও দলের হাতে যত খুশি ক্ষমতা তুলে দিন। আমাদের কোনও আপত্তি নেই।"


অধীর রাজা হরি সিং। তিনি এক মুহূর্তও নষ্ট করতে রাজি ছিলেন না। এর আগে তিনি পাত্তাই দেননি নেহরুকে। শরীর খারাপের অজুহাতে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন লর্ড মাউন্টব্যাটনকেও। কিন্তু পরিস্থিতির চাপে অসহায় রাজা, রাজ্য আর প্রজাদের বাঁচাতে দ্বারস্থ হয়েছিলেন দিল্লির।


নেহরু আর প্যাটেল, দুজনকেই দুটি চিঠি লিখেছিলেন হরি সিং। জানিয়েছিলেন, সংযুক্তিকরণের প্রস্তাবে তিনি রাজি। রাজ্যের ডেপুটি প্রাইমিনিস্টার রামলাল বাঁত্রাকে সেই চিঠি দিয়ে রওনা করে দিয়েছিলেন দিল্লি। 

তারপর শুধুই অধীর প্রতিক্ষা। সেদিনও সন্ধ্যা নেমেছিল কাশ্মীর উপত্যকায়। কিন্তু দিল্লি থেকে উড়ে কোনও সেনা কাশ্মীরে পৌঁছয়নি।  


"এবারে ইদের উৎসব পালন করব শ্রীনগরে," লাহোরে বসে জানিয়ে দিয়েছিলেন অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী জিন্না। মহাজন লিখছেন, জিন্না তাঁর ব্রিটিশ কমান্ডার-ইন-চিফকে আদেশ দিলেন পাকসেনার দুটি ব্রিগেডকে নিয়ে কাশ্মীরের দিকে এগোতে। দিনটা ছিল অক্টোবরের 27।


হরি সিংকেই টার্গেট করেছিলেন জিন্না। তাঁর ছক ছিল, শিয়ালকোট ব্রিগেড জম্মুতে হামলা চালিয়ে কবজা করবে হরি সিংকে। অন্যদিকে শ্রীনগর আক্রমণ করবে রাওয়ালপিন্ডি ব্রিগেড। এই সাঁড়াশি আক্রমণে জম্মু-কাশ্মীরের পতন অবধারিত বলে ধরেই নিয়েছিলেন পাক প্রধানমন্ত্রী।

ওই পরিকল্পনার কথা কানে আসতেই রক্তচাপ বেড়ে গিয়েছিল রাজা হরি সিংয়ের।


তবে জিন্নার স্বপ্নপূরণে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন খোদ ব্রিটিশ কমান্ডার-ইন-চিফ। সুপ্রিম কমান্ডারের অনুমতি না নিয়ে এক পা এগুনোও সম্ভব হবে না বলে তিনি স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছিলেন। এরপর কফিনের শেষ পেরেকটি ঠুকতেও মোটেই সময় লাগেনি। সুপ্রিম কমান্ডার পত্রপাঠ জানিয়ে দিয়েছিলেন, কাশ্মীর ভারতে যোগ দিচ্ছে। তাই সেনা পাঠানো সম্ভব নয়।


দেরিতে হলেও সব ভালোয় ভালোয় মিটলো। মহাজনের সঙ্গে দিল্লিতে কথাবার্তা চূড়ান্ত হওয়ার পরেই সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিলো দিল্লি। পরদিন 27 অক্টোবর, সকালেই ভারতীয় সেনা হাজির হয়েছিল শ্রীনগরে। সেই সঙ্গে কপালের ভাঁজ কমেছিলো রাজার। সব কিছু দেখে, সবার অলক্ষ্যে মুচকি হাসি হেসেছিলেন বিধাতা। 


রাজাসন থেকে সরে যেতে হলো হরি সিংকে। কয়েক দিনের মধ্যেই কাশ্মীরের রাজমুকুট মাথায় উঠল আবদুল্লার। ইচ্ছাপূরণ হলো জওহরলাল নেহরুর। তৈরি হলো অ্যাডহক সরকার। কাশ্মীরের নয়া প্রধানমন্ত্রী হয়ে বসলেন শেখ আবদুল্লা।
বদলে গেল যেন ভূস্বর্গের গোটা ছবিটাই। শেষ হলো কাশ্মীরে শতাব্দি পুরনো ডোগরা রাজত্ব। তারপরের ঘটনা বয়ে গেল ঝড়ের গতিতে। নির্বাসনে পাঠানো হয়েছিল প্রাক্তন কাশ্মীররাজ হরি সিংকে। এরপর তিনি ফিরেছিলেন বটে তাঁর প্রিয় ভূস্বর্গে, তবে কলসভর্তি ছাই হয়ে।


প্রজাদরদী রাজা হরি সিং মারা গেছিলেন মহারাষ্ট্রের চন্দনওয়াড়িতে। সেখানেই সৎকার। ভূস্বর্গের স্রোতস্বিনী তাওয়ির পূণ্যতোয়ায় হয়ত স্বর্গের পানেই ভেসে গেছিল প্রয়াত রাজার দেহভস্ম।


গত সাত দশকেরও বেশি সময়ে, অনেক জল বয়ে গিয়েছে ঝেলম, চেনাব দিয়ে। সীমান্তপারের হানাদারদের গোলাগুলিতে আজও বারেবারে কেঁপে ওঠে উপত্যকা। অবস্থা সেদিন যে তিমিরে ছিলো, আজও সেই তিমিরেই।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

1 comments so far,Add yours

  1. কাশ্মীর নিয়ে আরো লেখা নিয়ে আসুন। জানার ও পড়ার কৌতুহল রইল।

    ReplyDelete