কাজল ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

ভোট বড় বালাই।তাই নতুন ঝকঝকে পার্টি অফিসের পাঁচতলার দপ্তর ছেড়ে চারতলা, তিনতলা, এমনকি দোতলাও না। সোজা চালান হয়ে গেলেন গ্রাউন্ড ফ্লোরে। সেখানেই নিজের দপ্তর গুছিয়ে বসলেন বিজেপি'র চাণক্য অমিত শাহ। ওই অফিসে বসলেই ভোটে জিতবেন। পরামর্শ জ্যোতিষের। বিজেপি'র নতুন দপ্তরের দেওয়ালে কান পাতলেই নাকি এমন ফিসফাস শোনা যায়।
নরেন্দ্র মোদি সমেত বিজেপির নানা নেতার জ্যোতিষ, পুরাণে ভরসা নিয়ে অসংখ্যবার কটাক্ষ হয়েছে নানা মহলে। তার মধ্যে হামেশাই এগিয়ে থেকেছে কংগ্রেস। কিন্তু ইতিহাস কী বলে?

ভারতের শেষ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন। ব্রিটিশ পার্লিয়ামেন্ট মত দিলো, ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে ১৯৪৮ সালের তিরিশে জুনের মধ্যেই। সেই মতো মাউন্টব্যাটেনও জানিয়ে দিলেন, পনেরো অগাস্ট আজাদি মিলবে। স্বাধীনতার জন্য ওই দিনটাকে বেছে নেওয়ার কারণটা ঠিক কী ছিল? হাতে তো তখনও বেশ
কিছুদিন সময়। আর ভারতের হাতে স্বাধীনতা না তুলে দিলে, ভাইসরয়ের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটছিল, এমনটাও নয়। তাহলে, রহস্যটা কোথায়?
"গোটা ঘটনার আমিই নায়ক। এমনটাই বোঝাতে চেয়েছিলাম।" সদম্ভ এই উক্তিটাই করেছিলেন লর্ড  মাউন্টব্যাটেন। বাদবাকি কথাগুলোও তাঁর মুখ থেকেই শোনা যাক।
"যখন আমার কাছে জানতে চাওয়া হলো(ক্ষমতা হস্তান্তরের) কোনও  দিন ঠিক করেছি কিনা, তখনও আসলে নির্দিষ্ট কোনও  দিনের কথা ভাবিনি। তবে এটা জানতাম, যা করার তাড়াতাড়ি করে ফেলতে হবে। ভেবেছিলাম, অগাস্ট সেপ্টেম্বরের মধ্যেই সব সেরে ফেলব। তখনই হঠাত পনেরো অগাস্টের কথা মনে আসে। ওই দিনটা ছিল জাপানের আত্মসমর্পণের(দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ) দ্বিতীয় বার্ষিকী।"
ভারতের শেষ ভাইসরয় লর্ড  মাউন্টব্যাটেনের ওই সদম্ভ উক্তি ধরে রেখেছিলেন হ্যারি কলিন্স, ডোমেনিক ল্যাঁপিয়ের জুটি তাঁদের 'ফ্রিডম অ্যান্ড মিডনাইট' গ্রন্থে।
তবে এর অনেক আগেই কিন্তু ভারতের স্বাধীনতা দিবস পালন শুরু করেছিল কংগ্রেস। সালটা ছিলো ১৯৩০। তখন স্বাধীনতা দিবস উদযাপন হতো ছাব্বিশ জানুয়ারি। ঠিক তার এক বছর আগেই, কংগ্রেসের তৎকালীন সভাপতি পন্ডিত জওহরলাল নেহরু ডাক দিয়েছিলেন 'পূর্ণ স্বরাজ'- এর।

এদিকে স্বাধীনতার দিন পনেরো অগাস্ট কানে যেতেই ঘাড় নাড়ালেন জ্যোতিষিরা। চললো গণনা। গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থান নিয়ে ছক কাটা। শেষ পর্যন্ত, না অসম্ভব।  দিনটা পয়মন্ত না। স্বাধীনতার দিন বদলাতে হবে। ওদিকে অনড় মাউন্টব্যাটেন। জ্যোতিষির আবদারকে পাত্তা দিতে রাজি হলেন না। আতান্তরে নেহরু। শেষ পর্যন্ত অবশ্য মাথা নুইয়েছিলেন জ্যোতিষতন্ত্রের কাছেই। দাদুর(প্রমাতামহ) সেই কীর্তির কথা সম্ভবত জানা নেই নাতির। আর যদি জানার পরেও, বিজেপি'র জ্যোতিষে আস্থা নিয়ে রাহুল গাঁধি হাসি মস্করা করে থাকেন, তাহলে বলতেই হয় চোরের মায়ের গলা বড়ো!

জ্যোতিষ, গ্রহ নক্ষত্রে অগাধ বিশ্বাস ভারতীয় রাজনীতির কারবারিদের। কোথাও কোথাও তা আবার যাবতীয় মাত্রাও টপকে যায়। যেমন ধরুন উত্তরাখন্ডের প্রাক্তন বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী রমেশ পোখরিয়াল দিনাঙ্কের কথা। তিনি আচমকাই এক অনুষ্ঠানে বলে বসলেন, "জ্যোতিষ সবচেয়ে বড় বিজ্ঞান।" এরপর আরও একধাপ সুর চড়িয়ে তিনি জানিয়ে দিলেন, বাস্তবে বিজ্ঞানের থেকেও বড় জ্যোতিষবিদ্যা।

কারুর জ্যোতিষে ভরসা, তো কারুর পুরাণে। নরেন্দ্র মোদি তখন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী। এক পাঠ্য বইয়ের ভূমিকায় তিনি লিখে দিলেন, রামচন্দ্র প্রথম বিমান ওড়ান। কথা প্রসঙ্গে তিনি এমনটাও জানিয়েছিলেন, সেই বহু যুগ আগেই নাকি আমাদের দেশে প্লাস্টিক সার্জারি হতো। শ্রীগণপতি দেব নাকি তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। শুধু তাই নয়, জেনেটিক সায়েন্সেরও নাকি বিকাশ হয়েছিলো সেই আদি যুগেই।

যাই হোক, ফিরে যাই দেশের প্রথম স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের কথায়। মাউন্টব্যাটেনের 'হ্যাঁ', জ্যোতিষির 'না'। দু'পক্ষই গোঁ ধরে বসে আছে। কেউ কাউকে জায়গা ছাড়তে রাজি নয়। ঝোলার উপক্রম স্বাধীনতার। অগত্যা, চেষ্টা হলো এক মধ্যপন্থা সূত্র আবিষ্কারের।
চোদ্দই অগাস্ট। সেদিন সাজ সাজ রব। সবার অপেক্ষা, কতক্ষণে সূর্যদেব অস্তাচলে যান। বৃটিশ উপনিবেশবাদের শেষ সূর্য। দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। ঘড়িতে তখন রাত এগারোটা। বৈঠক বসলো দেশের কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলির। জ্যোতিষিরা আগেভাগেই সতর্ক করে দিয়েছিলেন, পাক্কা আটচল্লিশ মিনিটের মধ্যেই সেরে ফেলতে হবে ভাষনপর্ব। জ্যোতিষির কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করলেন দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহরু।
এরপর রাত বারোটা বাজতেই শঙ্খধ্বনি। নেহরু তাঁর ভাষণে বললেন, "মধ্যরাতে যখন গোটা বিশ্ব নিদ্রামগ্ন, তখন ভারতের নবজন্ম। সে জেগে উঠবে তার নবজীবনে, স্বতন্ত্র পরিচয়ে।"

সাপ মরলো কিন্তু লাঠি অক্ষত। ভাইসরয় এই ভেবে খুশি হলেন যে সত্যিই তিনিই সব। তিনিই শেষকথা। ঠিক যেমনটা তিনি দেখাতে চাইতেন। কারণ রাত বারোটা মানেই ইংরেজি মতে নতুন দিন। চোদ্দই অগাস্ট রাত বারোটা মানেই পনেরো অগাস্ট। তৃপ্তির ঢেঁকুর তুললেন মাউন্টব্যাটেন। পনেরো অগাস্ট মিলল ভারতের স্বাধীনতা।
ওদিকে ভারতীয় জ্যোতিষমতে, নতুন দিন শুরু সূর্যোদয়ের সময় থেকে। তাই জ্যোতিষকুলের গণনায়, স্বাধীনতা প্রাপ্তি হলো চোদ্দই অগাস্টে। খুশি দু'পক্ষই।
মধ্যরাতে স্বাধীন হলো ভারত।
ফ্রিডম অ্যান্ড মিডনাইট।।




Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours