শতাব্দী দাশ, লেখিকা, কলকাতা:


দ্বিতীয় তরঙ্গের নারীবাদ যে স্লোগানটিকে জনপ্রিয় করেছিল, 'ব্যক্তিগতই রাজনৈতিক',  তা নিয়ে আলোচনার আরেকটা উপলক্ষ্য পাওয়া গেল।

লাদাখের বিজেপি সাংসদ জামায়েল শেরিং  নামগেইল-এর স্ত্রী সোনম ওয়াংমোর একটি ভিডিও ক্লিপ ভাইরাল হয়েছে। ভিডিও নির্মাতা ইন্ডিয়া টুডে।  একটি সংসদীয় বামদল সঙ্গত কারণেই সেটি প্রচার করে চলেছে। লিংক নিচে দেওয়া থাকল৷

ভিডিও প্রচারে সেই সংসদীয় বামদলটির উদ্দেশ্য স্পষ্ট৷  কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বিলোপ ও লাদাখকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করার  পরবর্তী সময়ে, ধারালো বক্তৃতা রেখে বিজেপির পোস্টার বয় হয়েছেন যিনি, সেই নামগেইলের স্ত্রী, জেএনইউ-এর ছাত্রী, সোনম ওয়াংমো বলছেন,  তিনি কানহাইয়া কুমারের সহপাঠী ছিলেন৷ তিনি জানেন, কানহাইয়াকে ফাঁসানো হয়েছিল৷ অর্থাৎ পক্ষান্তরে বলছেন, বিজেপিই ফাঁসিয়েছিল। তিনি আরও বললেন, তিনি ভালোই জানেন, অডিও-ভিডিও ক্লিপগুলো ফেক৷ কারণ সেই ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি ল্যাব থেকে বেরিয়ে দ্যাখেন, কয়েকজন ষণ্ডা ষণ্ডা অপরিচিত লোক, ক্যাম্পাসে মুখোশ এঁটে ভারতবিরোধী স্লোগান দিচ্ছে,  ভারতকে টুকরো টুকরো করার কথা বলছে। সেই দলে কানহাইয়া কুমার বা তার সঙ্গীরা কেউ ছিলেন না৷ উমর খালিদদের পার্টি অবশ্য ক্যাম্পাসে 'ব্যানড' ছিল, তাদের ক্লিনচিট দেননি সোনম।।

কিন্তু কানহাইয়াকে ফাঁসানো হয়েছিল এবং মুখোশধারী বহিরাগতরাই ভারতবিরোধী স্লোগান দিচ্ছিল, এ'কথা তিনি বারবার বলেন। তাঁর বিখ্যাত বর চুপ। দুঁদে সাংবাদিক তাঁর সততার সঙ্গে চোখ মেলাচ্ছেন না, চা খাচ্ছেন মাথা নিচু করে। ফলে সিপিআইএম-এর দায়িত্ব ভিডিওটি প্রচার করা।

এ তো গেল দেশের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত "বড় বড়" ব্যাপার। নারীবাদীদের কাছে যেহেতু 'ব্যক্তিগতই রাজনৈতিক'  বা অন্তত 'ব্যক্তিগতও রাজনৈতিক' , তাই কিছু "ছোট ছোট" ব্যাপারও চোখে পড়ল।

চোখে পড়ল, কীভাবে জেএনইউ-এর পিএইচডি স্কলার বউকে  'ট্রোফি ওয়াইফ' করে রাখার চেষ্টা করা যায়। কীভাবে আলোচনার শুরুতেই পুরুষসুলভ অহং সহকারে বলা যায়, 'আমি তো আজকাল সময়ই দিতে পারিনা সংসারে, ওকে তাই অনেক কম্প্রোমাইজ করতে হয়'। চোখে পড়ল, কীভাবে বিরুদ্ধ মতাবলম্বী স্ত্রী-র বিরুদ্ধমতকেও গুরুত্ব দিতে নেই, এমন ভাব করতে হয় যেন তা খুব আমোদের ব্যাপার । তার সঙ্গে কোনো আলোচনায় যেতে নেই। বরং প্রেমপূর্ণ দৃষ্টিতে তার মিঠে হাত-পা ছোঁড়া অবলোকন করতে হয়। তারপর বারংবার তাকে নিজের রাজনৈতিক দলের মতাদর্শগত ডিস্কোর্স-সকল পড়ার জন্য জোর করতে হয়।

অর্থাৎ, পিতৃতন্ত্র ঘরের বউ-এর বিরুদ্ধাচরণের সর্বাধিক সীমাও নির্ধারণ করে দিয়েছে। সেই সীমা-র মধ্যে থেকেই খানিক বিরোধিতা করো, খানিক সত্যবচনের নমুনা দেখাও।

পুরুষকে এই লক্ষণরেখা টানার অধিকার কে দিল? সে নিজেই নিজেকে সেই অধিকার দিয়েছে। সে তার  নারীকে 'ভালোবাসে' কিনা! সে-ই একমাত্র বোঝে কতটুকু বিরুদ্ধাভ্যাস তাঁর প্রিয় নারীর স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর নয়। কিংবা তার ও তার পরিবার-কাঠামোর  পক্ষে কতটুকু 'বিক্ষোভ' নিরাপদ। সেই ছাঁচেই ঢেলে নেয় নারীটিকে।

দু'বার দুজনের মুখে একই কথা শুনলাম৷ রাজনৈতিক ও আদর্শগত বিরোধ কি আর খাটে ব্যক্তিগত সম্পর্কের ক্ষেত্রে? অক্ষয় কুমারকে আমরা দেখি নরেন্দ্র মোদীর সাক্ষাতকার নিতে। টুইঙ্কল খান্নাকে দেখি গো-রাজনীতি ইত্যাদির সকৌতুক সমালোচনা করতে৷ শোনা যায় বিজেপি নেত্রী সুষমা স্বরাজের বৈবাহিক সঙ্গী বামমনস্ক ছিলেন। এঁদের এই যে  'ব্যক্তিগত' বায়বীয় প্রেম, তা এতই স্বয়ংসুম্পূর্ণ যে তার হয়ত কোনো সামাজিক-রাজনৈতিক সহমতের মাটি লাগে না৷ যাইহোক,এক্ষেত্রেও আমরা দেখি, পুরুষ ব্যস্ত 'সশক্ত ', পুরুষালি ভারত গড়ার কাজে, নারীটি সেই ব্যস্ত পুরুষের অপেক্ষায় রত, আর সংসারে 'কম্প্রোমাইজ'রত। অন্তত পুরুষের ভাষ্য তা-ই। সেই নারী মাঝে মাঝে ঝলসে উঠবে।  কিন্তু পরিমাপ মতো। তার চেয়ে বেশি হলে ক্যামেরার পিছন থেকে বলা হবে, 'কাট'।

অথচ প্রায় আধ ঘণ্টার ভিডিওতে সোনম পাঁচ মিনিটের জন্য এসেছিলেন। তার মধ্যেই শ্লেষে বলে গেছেন, সংসদে নিজের বরের 'শুননে কি ক্ষমতা রখিয়ে' উক্তিটা তিনি মনে রেখেছেন।  ভাবছেন বাড়িতেও বলবেন একই কথা যে, মাঝে মাঝে 'শোনা' মন্দ নয়। ম্যানসপ্লেনিং-কে এক কথায় এরচেয়ে ভালো থাপ্পড় মারা যেত না। Mansplaining, অর্থাৎ যখন শুধুমাত্র পুরুষ হওয়ার কারণেই এক ব্যক্তি তার মতামতকেই চরম ভাবছে, নারী বিরুদ্ধমত পোষণ করলে চেষ্টা করছে তাকে 'মতান্তরিত' করার। দুজন পুরুষের যবতীয় স্থূল রসিকতা ম্লান করে দেওয়ার জন্য সোনমের  ওই একটা কথাই যথেষ্ট ছিল৷ অদ্ভুত নয়? মূল ভারত ভূখণ্ড লাদাখের কথা শুনতে নারাজ, আবার লাদাখীয় পুরুষ তার ঘরের নারীটির কথা শ্রবণে একই রকম উদাসীন। সবলে শোনে না দুর্বলের বচন৷

অথচ 'ইন্ডিয়া টুডে' শেষমেশ যে খবর ছেপেছে,  তার হেডার ও সাবহেডার দেখলে মনে হবে, সোনমের ওই রাজনৈতিক মতপার্থক্যকে যতটা মৃদুভাবে পরিবেশন করা যায়, ততটাই করার চেষ্টা।  শুধু টিআরপি বাড়ানোর খাতিরে একজন বামপন্থী ও একজন বিজেপি সাংসদের "মহান প্রেমকাহিনী"-টি স্থান পেয়েছে। যাতে তার চেয়ে বেশি 'র‍্যাডিকাল' কোনো বার্তা ভুলেও না চলে যায়, তাই সতর্কতা হিসেবে  সাবহেডারে 'কম্প্রোমাইজ'-এর বাণীটি ভাস্বর।

ভালো লাগল সোনমের সরল সত্যবাদিতা৷ অনেকে বলছেন, লাদাখের বদলে তিনি উত্তরভারতের কোনো নারী হলে নাকি তাঁর জীবনসঙ্কট হতে পারত৷  অনেকে বলছেন, মিথ্যাচারী এক দলের সাংসদকে তিনি বিয়ে করলেনই বা কেন? কিন্তু সচরাচর মানুষ 'ব্যক্তিগত' ও 'রাজনৈতিক'-কে আলাদা করে রাখতে ভালবাসে। বিশেষত পেলব ভালোবাসাকে রাখে রূঢ় তত্ত্বের উর্ধ্বে। ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিকের দ্বন্দ্বকে বক্স-খাটের গহ্বরে চালান করে, তার উপরে পাতে মসৃণ পাটাতন, গদি, বিছানা।  এসব ঘিরেই 'সুখী গৃহকোণ'। এসব কারণে চরমপন্থী নারীবাদীরা এমনকী এও বলেছেন যে 'Romantic love is a patriarchal conspiracy'. তাহলে কী ভালোবাসবে না কেউ? ঘর বাঁধবে না? বাঁধুক ঘর। কিন্তু সেই ঘরে নিজের মতাদর্শ-বিশ্বাস-পছন্দ-অপছন্দ যেন প্রথমে কনেবউটি না হয়ে যায় আর ক্রমে অবহেলিত না থেকে যায়। সোনম ভালো থাকুন, "ভালোবাসায়"  থাকুন। তবে তাঁর থেকে প্রত্যাশা, "ভালোবাসায়" ভুলে এমনভাবে সত্য বলতে তিনি ভুলে যাবেন না। "ভালোবাসা" আর সত্যের সংঘাত না ঘটুক জীবনে। "ভালোবাসা নিজেই পরম প্রশ্নাতীত সত্য" -এমনটা নাও হতে পারে।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours