শেখ ফরিদ, প্রগতিশীল লেখক, বাংলাদেশ:

কাশ্মীর নামটি বেশ পুরনো। প্রায় তিন হাজার বছর বয়স এ শব্দটির। মুসলিম দখলদারেরা যেখানেই গিয়েছে সাধারনত নাম বদলে ফেলতো। বৃটিশরাও তাই করতো।  বৃটিশরা ভারতকে  ইনডিয়া বলেছে,লিখেছে। কেন? তারা কি ভারত বলতে, লিখতে পারতো না?  অথবা ভারতকে হিন্দুস্তান কেন বলা হয়? এখানে তো বৌদ্ধও ছিলো। ছিলো বুদ্ধিষ্ট শাসকও। এ বিষয়ে বাংলাদেশের কথা সাহিত্যিক হুুমায়ুন আহমেদের মুখে  বলা গল্পটি শোনা যেতে পারে। তিনি বেশ কিছু দিন আমেরিকায় (নাকি ইংল্যান্ড  মনে করতে পারছি না)  ছিলেন।  সে দেশে তাকে কেউ হুময়ুন শব্দটি শুদ্ধভাবে বলতো না। বা বলতে পারতো না। কিন্তু তার সেই বিদেশি বন্ধুরা যখন এয়ারপোর্টে বিদায় জানাতে আসে তখন হুময়ুন নামটির সঠিক  উচ্চারন করে যা শুনে তিনি বিস্মিত হয়ে যান! তারা,হুমায়ুন উচ্চারণ  করতে জানে না৷ নাকি ইচ্ছা করেই করে না তা আসলে ভাবনার বিষয়। তেমনি ভারতকে ইচ্ছা করেই ইনডিয়া বলতো কি না কে জানে! 

প্রসঙ্গ কাশ্মীর। কোথা থেকে শুরু করা যায়?  কাশ্মীরের ইতহাস বেশ পুরনো আগেই বলেছি। ইসলাম প্রচারেরও প্রায় ১৫ শ বছর আগেই কাশ্মীর ছিলো। ভারতবর্ষে অনেক স্থানের নাম বদলে গেলেও তিন হাজার বছর ধরে কাশ্মীর নামটি এখনো অবিকৃত আছে। ঋৃষি কশ্যপের নাম থেকে কাশ্মীর নাম নেয়া হয়েছে। ঋকবেদে কশ্যপ  ঋষির কথা উল্লেখ করা আছে একবার।

কাশ্মীর উত্তপ্ত, যে কোন সময় যুদ্ধ লেগে যেতে পারে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে। কয়েকবার যুদ্ধ হয়েছেও। আরো হবে তাতে  কোন সন্দেহ নাই। যদি পাকিস্তানের অর্থনীতি এ সময় চরম মন্দাবস্থায় না থাকতো। আ,  তার মার্কিন বন্ধু রাষ্ট্রের সাথে আগের মত সুসম্পর্ক থাকতো। তবে পাকিস্তান এতক্ষণ যুদ্ধ  ঘোষনা করে দিতো ৩৭০ ধারা বাতিল করার কারনে। তবে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। ৪৭ এ কাশ্মীরে যুদ্ধ বাধানোর সময়ও পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো ছিলে না। এবং পাকিস্তান কাশ্মীর আক্রমন করে বসে।  অদ্ভুত বিষয় ভারত তার নিজের দেশে একটি রাজ্যের একটি ধারা বাতিল করলো  আর  তাতে পাকিস্তান সংসদে সর্বদলীয় অধিবেশন ডাকলো। এবং সব দল একত্রে ভারতের বিরুদ্ধে  এক হয়ে গেলো! যদিও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী উপস্থিতিতে বিরোধীদলীয় সাংসদ বিলওয়াল ভুট্টো ইমরান খান নিয়াজিকে "সিলেক্টেড " প্রধানমন্ত্রী বলে সম্বোধন করেছেন! শুধু তাই নয় প্রধানমন্ত্রীর কড়া সমালোচনা করে পাকিস্তানের ধর্মীয় দলগুলোও তাকে "সিলেক্টেড" প্রধানমন্ত্রী বলছেন। তাদের অভিযোগ ট্রাম্পের কাছে কাশ্মীর বেচে দিয়ে এসেছে তাদের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান নিয়াজিী।  ইমরান খানের  বংশে আত্মসমর্পনের ইতিহাস নাকি পুরোন। তা বলে ধর্মীয়,দলের নেতারা ১৯৭১ নিয়াজির আত্মসমর্পণের ইঙ্গিত দিয়েছে।

বেচাকেনার প্রসঙ্গ যেহেতু এসেই গেলো, তাহলে ইতিহাসের দিকে তাকানো যাক; শিখ ও বৃটিশদের যুদ্ধের পর বৃটিশরা অমৃতসর চুক্তিতে প্রায় ৭. ৫ মিলিয়ন 'নানাকশাহী রুপির' বিনিময়ে কাশ্মীরকে বিক্রি করে দেয় গুলাব সিং এর নিকট। ১৮৪৬ সালে ১৬ মার্চ এ ক্রয়- বিক্রয় সম্পন্ন হয়। গুলাব সিং জুম্মু ও কাশ্মীরের রাজা বনে যান।সে অর্থে তিনিই বর্তমান নামের জুম্মু ও কাশ্মীরের প্রতিষ্ঠাতা। তার সময় থেকে জুম্মু ও কাশ্মীর প্রিন্সলী ষ্টেট বা করদ রাজ্য। ১৯৪৭ সালে বৃটিশরা ক্ষমতা হস্তান্তর করার সময়; জুম্মু কাশ্মীরের সামনে তিনটি অপশন ছিলো এক, ভারতীয় ইউনিয়নে যোগ দেয়া। দুই, পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত হওয়া। তিন, স্বাধীন থাকা।

ভারত ও পাকিস্তান ১৯৪৭ সালে ১৪ ও ১৫ আগষ্ট স্বাধীনতা ঘোষনা করলেও। জুম্মু কাশ্মীর কোন দিকেই যায়নি। দু মাস না যেতেই, সদ্য স্বাধীন পাকিস্তান ২২ অক্টোবর জম্মু-কাশ্মীর আক্রমন করে বসে! কাশ্মীরের রাজা সনাতন ধর্মের হলেও অধিকাংশ প্রজা ছিলো মুসলিম। তারা পাকিস্তানে যোগ দিলে আগেই দিতে পারতো, তবে তারা যোগ দেয়নি। যদিও তারা ভারতেও যোগ দেয়নি তখনো। ২২ অক্টোবরে পাকিস্তানের আক্রমনে রাজা হরি সিং হতভম্ব হয়ে যান। পাকিস্তান তার সৈন্য ও পাহাড়ি কাবিলা নিয়ে ২৬ তারিখ পর্যন্ত অনেকটা বিনা বাধায় কাশ্মীরে ঢুকে পরে। যদিও সে হামলায় প্রথমে কয়েকহাজার কাশ্মীরি মুসলমানকেই মরতে হ! ২৬ অক্টোবর কাশ্মীর ভারতীয়  ইউনিয়নে যোগ দেয় রাজা হরি সিং , শেখ আবদুল্লাহ কে সাথে নিয়ে। রাজা হরি সিং শেখ আব্দুল্লাকে জুম্মু কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন।

২৭অক্টোবর ভারতীয় বিমানবহিনী কাশ্মীরে প্রবেশ করে। এক বছর দুই মাস দুই সপ্তাহ যুদ্ধ চলে। ভারতীয়দের বক্তব্য, যদি ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহর লাল নেহেরু ভারতীয় ফৌজকে স্বাধীনভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করতে দিতেন তবে সম্পূর্ন কাশ্মীর ভারতের দখলে থাকতো। ৬২ সালে চায়না ভারত যুদ্ধে ভারত কাশ্মীরের কিছু অংশ হারায়। যা, আকসাই চীন বলে পরিচিত। পাকিস্তান তার দখলে থাকা কাশ্মীরের কিছু  অংশ চায়নাকে উপঢৌকনও দেয়। এ ঘটনা ইতিহাসে বিরল বৈকি!

১৮৪৬ সালে গুলাব সিং জুম্মু কাশ্মীরের রাজা হলেও। কাশ্মীরের ইতিহাস অনেক প্রাচীন। কাশ্মীরের রয়েছে সমৃদ্ধ ইতিহাস, ভাষা,সাহিত্য দর্শন। কিন্তু আজ ওসব বাদ দিয়ে কাশ্মীর এখন যুদ্ধ ও সন্ত্রাসের প্রধান খবর হয়ে উঠেছে। প্রাচীন যুগ থেকে এই আধুনিক সময়ের অনেক কবি, সাহিত্যিক,ঐতিহাসিক, দার্শনিকের জন্ম হয়েছে। আজ তাদের নিয়ে চর্চা হচ্ছে না। কারাকোরাম পর্বতের বিস্ময় আর ঝিলাম নদীর বুকের জলরাশীর গল্প মানুষের মুখে নেই। কাশ্মীরের মানুষের জীবিকা, জীবন, যৌবন, সৌন্দর্যের কথা আমরা শুনি না। কাশ্মীরি কসুর ভাষা,জুম্মুতে দোগরী ভাষা, লাদাখে লাদাখি ভাষায় রয়েছে অসাধারণ কবিতা, গল্প,গান।  সে খবর আমাদের মিডিয়াগুলো দেয় না। এছাড়াও কাশ্মীরে এখন উর্দু হিন্দি ভাষায় লেখে থাকেন অনেক কবি লেখক,সাহিত্যিক। সংস্কৃত ভাষায় তো কাশ্মীরের কালজয়ী অনেক রচনা রয়েছেই।

ভারতীয় ইউনিয়ন যোগ দিয়ে রাজা হরি সিং শেখ আবদুল্লাকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেন। তখন কাশ্মীরের পৃথক প্রধানমন্ত্রী ও পতাকা ছিলো।১৯৫৩ সালে কাশ্মীরের রাজতন্ত্রের বিলুপ্তি ঘটে। অবশ্য, রাজা হরি সিং এর পুত্র প্রিন্স করন সিং কে একটি বিশেষ পদ দেয়া হয়।

ভারতের সাথে কয়েকবার যুদ্ধ হয় পাকিস্তানের।  আবারো কাশ্মীরে ৩৭০ নামে  একটি ধারা বাতিল করাতে ভারত পাকিস্তান মুখোমুখি। ৩৭০ বাতিল হলে ৩৫ এর এ,  ধারা এমনিতেই রদ হয়ে যায়। পাকিস্তানের কাশ্মীর নীতি নিয়ে  সে দেশের প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবি হাসান নিসার কঠোর সমালোচনা করে থাকেন। তার ভাষায় পাকিস্তানে জনগনের কর্মসংস্থান,  শিক্ষা, চিকিৎসা বাদ দিয়ে কাশ্মীর নিয়ে পরে থাকার কোন মানে নেই। সে দেশের একজন ক্রিকেটারও পাকিস্তানের কাশ্মীর নীতির সমালোচনা করে বিপদে পরেছিলেন। কাশ্মীরের একজন  বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতার বক্তব্য  "কাশ্মীরকে ভারত মাথার তাজ ও  পাকিস্তান শাহ রগ (ঘাড়ে রগ) মনে করে কিন্তু আসলে তারা কেউ কাশ্মীরিদের ভালো চয় না! "  
ভারতীয় সংসদে লাদাখের তরুন সাংসদ বলেছেন," ৩৭০ ধারা বাতিল  হওয়াতে কাশ্মীরের দুটি পরিবারের রুটি রুজি বন্ধ হবে আর কারো ক্ষতি হবে না!"  উল্লেখ্য লাদাখকে এখন  ইউটি বা ইউনিয়ন টেরওটোরির অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।  লাদাখকে ইউনিয়ন টেরিটোরী  করার দাবি,  হিন্দু মুসলমি, বৌদ্ধ খৃস্টান সম্প্রদায় সহ সকল নাগরিকের দাবী ছিলো।

যে কারনে, কাশ্মীরের দল হলেও লাদাখের স্থানীয় ( জেলা)  নেতাদের বহিষ্কার করেছে কাশ্মীরের  পিডিপি ও ন্যাশনাল কংগ্রেস! লাদাখের স্থানীয়দের দাবি,  মুফতি মেহবুবা ও ফারুক আব্দুল্লা লাদাখের উন্নয়নের কথা বলে, জুম্মু ও কাশ্মীরে সে অর্থ লোপাট করে ফেলে। (ক্রমশ)


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours