কাজল ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:
লালকেল্লায় ভারতের তেরঙ্গা উড়েছিল একদিন পরে। ষোল অগাস্ট সকালে।
লুইস মাউন্টব্যাটেন, ভারতের শেষ ভাইসরয়। সাল 1947। চোদ্দ অগাস্ট পাকিস্তানের প্রথম স্বাধীনতা দিবস উদযাপন। সেখানকার অনুষ্ঠান সেরে সেদিনই করাচি থেকে দিল্লি ফিরলেন মাউন্টব্যাটেন। ভারতে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিল এক চমক। যার কথা হয়ত তিনি স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি।
"আপনিই অন্তর্বর্তীকালীন গভর্নর জেনারেলের দায়িত্ব সামলান।" মাউন্টব্যাটেনকে ধরে বসলেন কংগ্রেস নেতারা। কী বলবো এই ঘটনাকে?
পন্ডিত জওহরলাল নেহরুর মাউন্টব্যাটেনপ্রীতি নিয়ে বাজারে অনেক গল্প উড়ে বেড়ায়। কংগ্রেসবিরোধীরা বলেন ব্রিটিশ চাটুকারিতা। কোথায়, এই তো পাকিস্তান ঘুরে এলেন মাউন্টব্যাটেন। সেখানে তো ওরকম কোনও প্রস্তাব দিলো না। তাহলে?
ঠিক একইরকম ঘটনা ফের দেখা গেছিল ব্রিটিশ পতাকা, ইউনিয়ন জ্যাক অবনমন নিয়েও।
চোদ্দ অগাস্ট। বসলো কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলির মাঝরাতের অধিবেশন। সেখানেই আনুষ্ঠানিক ভাবে মাউন্টব্যাটেনের গভর্নর জেনারেলের কুর্সিতে বসার প্রস্তাব অনুমোদন পেলো সর্বসম্মতিক্রমে। এরপরেই স্বাধীন ভারতের অ্যাসেম্বলির প্রথম অধিবেশনে নেহরু শুরু করলেন তাঁর সেই ঐতিহাসিক ভাষণ। মাঝরাতে ঘোষণা হলো স্বাধীন ভারতের। তেরঙ্গা উত্তোলন করলেন নেহরু।
সেদিনের গোটা ঘটনার কথা নানা প্রসঙ্গে শোনা গেছিলো লর্ড মাউন্টব্যাটেন আর তাঁর মেয়ে পামেলা মাউন্টব্যাটেনের স্মৃতিচারণায়। এছাড়া অসংখ্য সরকারি নথিপত্র, পত্র- পত্রিকার পাতা ওল্টালেও অনেক চমকে দেওয়ার মতো খবর চোখে পড়ে।
"অতীত যতই রক্তরাঙা হোক, সে রাতে চাপা পড়ে গেছিলো সবকিছুই। সবাই উল্লসিত। এক অন্তহীন আবেগে ভাসছিলেন সবাই। তারই শরিক করে নিতে চাইছিলেন প্রাক্তন ভাইসরয়কেও। সবাই যেন ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন ব্রিটিশ রাজকে এক স্মরণীয় বিদায় সম্বর্ধনা দিতে।
পামেলা তাঁর ডায়রির পাতায় লিখছেন, "অধিবেশনের পর হল থেকে বাইরে বেরনোই দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ভিড়ে ভিড়ে ছয়লাপ। অনেকেই হাততালি দিয়ে চলেছেন মনের আনন্দে। থেকে- থেকেই জয়ধ্বনি উঠছে- পন্ডিত মাউন্টব্যাটেনের জয়। লেডি মাউন্টব্যাটেনের জয়। এরই মধ্যে কয়েকজন আমাকেও চিনে ফেলে। জয়ধ্বনি ওঠে আমারও। মাউন্টব্যাটেনের মিস সাহেব!"
পনেরো অগাস্ট। সকালে অনুষ্ঠান শুরু হলো 'মাউন্টব্যাটেন বরণ' দিয়ে। রাষ্ট্রপতি ভবনের দরবার হলে ছোট্ট ছিমছাম অনুষ্ঠান। এরপরেই নতুন গভর্নর জেনারেলকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লেন নেহরু। সোজা হাজির হলেন পুরনো দিল্লির রোশনারা বাগে। সেখানে তখন অপেক্ষা করছিল হাজার পাঁচেক খুদে। তাদের মা বাবার সঙ্গেও কথা বললেন নেহরু। চারদিকে সেদিন খুশির উচ্ছ্বাস।
"সেদিনকার মূল আয়োজন ছিল ইন্ডিয়া গেটের সামনে প্রিন্সেস পার্কে। কথা ছিল, সন্ধ্যা ছটায় প্রথমে ইউনিয়ন জ্যাক নামানো হবে। তারপরেই তোলা হবে তেরঙ্গা। কিন্তু সবকিছু বদলে গেল শেষ মুহূর্তের সিদ্ধান্তে। এমন সময় নেহরু জানালেন, আজ একটা আনন্দের দিন। তিনি সবার হাসিমুখ দেখতে চান। জ্যাক নামানোর ঘটনায় ব্রিটিশ নাগরিকরা আঘাত পেতে পারে, মাউন্টব্যাটেনকে এমনটাই জানালেন নেহরু। এ ব্যাপারে কী করা যায় তিনি দেখবেন।"
"বাস্তবে সেদিন ব্রিটিশ পতাকা নিয়ে কারোর কোনও মাথাব্যথাই ছিলো না। অবশেষে ইন্ডিয়া গেটে পৌঁছলেন পন্ডিত নেহরু। চতুর্দিকে শুধু মানুষ আর মানুষ। থিকথিকে ভিড়। এমনকি মাউন্টব্যাটেনকে নিয়ে ডায়াস পর্যন্ত পৌঁছতেও বেগ পেতে হয়েছিল নেহরুর। স্বাধীন ভারতের পতাকা ওড়ালেন নেহরু। হলো
একত্রিশটা গান স্যালুট। গোটা এলাকা গমগম করে উঠলো ভারতের জাতীয় সঙ্গীতে।"
"পরদিন ষোল অগাস্ট, 1947। লালকেল্লায় পতাকা তুললেন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহরু। মাথার ওপর পুষ্পবৃষ্টি করে উড়ে গেল বায়ুসেনার ডাকোটা। দিলেন স্বাধীনতা দিবসের ভাষণ। নিজেকে বললেন ভারতের 'প্রথম সেবক'।"
তবে দিল্লির রেডফোর্টে না হলেও, তৎকালীন মাদ্রাজের ফোর্ট সেন্ট জর্জে স্বাধীন ভারতের পতাকা উত্তোলন হয়েছিল পনের অগাস্ট সকালেই। ঘড়িতে তখন ভোর পাঁচটা বেজে পাঁচ মিনিট। বারো ফিট লম্বা আট ফুট চওড়া সেই পতাকার সংরক্ষণ করেছিলো প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ। 2013 সালের ছাব্বিশ জানুয়ারি, সেই ঐতিহাসিক পতাকার জায়গা হয় ফোর্টের প্রদর্শনী কক্ষে।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours