কাজল ভট্টাচার্য, সিনিওর জার্নালিস্ট, কলকাতা
আজকাল আর পান না।
রুইয়ের
কালিয়া, বেগুনভাজা, আলু পটলের তরকারি, ভাত, শেষপাতে আমড়ার অম্বল দিয়ে
কত্তার নৈশ আহারপর্ব শেষ। কত্তার নধর পেটখানা বেশ নজরকাড়া। তা সেই মারাদোনা
সাইজ পেটে স্নেহের হাত বোলাতে বোলাতে কত্তার হাঁক- কিগো, দুচামচ জেলুসিল
দাও।
আর কিসব নাম! ইনো, জিনট্যাক, রেনটাক, নামগুলোই
কেমন খটমটে। ওই নামগুলো হজম করাটাই তো মহাদুষ্কর। তারচেয়ে অনেক ভালো আমাদের
হজমোলা। নামের মধ্যেই একটা হজম হজম গন্ধ আছে।
হোয়াটস ইন আ নেম! সেক্সপিয়র সাহেবের তাতে কিছু হয়ত আসে যায় না, কিন্তু বাঙালির যায়। পান চেবানোর বিকল্প এখন ওগুলিই।
এই তো কিছুদিন আগের কথা।
খাওয়া
বাড়ার আগেই পানসাজা রেডি। কত্তার আবার তর সয় না। কত্তা, ছেলেপুলেকে খাইয়ে
তবেই গৃহলক্ষ্মীর খেতে বসা। আজকের নারীবাদিরা এতে পিতৃতান্ত্রিক দাদাগিরির
গন্ধ পেয়ে হইহই-রইরই জুড়ে দেবেন। তবে তখন হতো এমনটাই। বাড়ির পাঁচজনাকে না
খাইয়ে গিন্নী নিজের পাত পাড়তেন না। তাই নিশ্চিন্ত মনে খেতে বসার আগেই
কত্তার জন্য গিন্নীর সাজানো পান রেডি। তাও আবার কত্তার হাতে পানটা তুলে
দিতে হবে গিন্নীর। নইলে চলবে না।
- 'নিজেও তো পানটা
নিতে পারো,' গিন্নীর কপট রাগ। কত্তাও মুচকি হেসে কন- 'বেশ কাল থেকে তাই
হবে।' পরদিন গিন্নীর তাড়া- 'কিগো, আর কতক্ষণ তোমার পান হাতে করে দাঁড়িয়ে
থাকব?'
পানের রসের সঙ্গে এমনি করেই একাকার হয়ে যায় সোহাগের রস।
পানের
সঙ্গেই জড়িয়ে আছে সম্পর্কের অটুট বন্ধন। এমনটাই বিশ্বাস। তাই বিয়ের
অনুষ্ঠানেও পান। উত্তর ভারতেও পান সুপারি চিরদাম্পত্যের প্রতীক।
বাবুরাই
যে শুধু পানবিলাস করতেন এমনটা মোটেই নয়। তাদের সঙ্গে পাল্লা মেরে বিবিরাও
পানের রসে মজতেন। আর বিবিদের সেই পানরাঙা টুকটুকে লাল ঠোঁট দেখে, কামনার
জোয়ারে হাবুডুবু খেতেন বাবুরা।
অ্যান্টনি কবিয়াল তো আবার আস্ত এক গান ফেঁদে বসেছিলেন- 'তোমায় হেরি গো স্বপনে শয়নে তাম্বুল রাঙা বয়ানে।'
বাঙালির
মননে সুর ঢালতো পানের রস। পড়োশনের কথা মনে আছে? বিদ্যাপতি, গাইয়ে। ওই
ভূমিকায় পর্দা কাঁপিয়েছিলেন কিশোর কুমার। একটা করে পান মুখে গোঁজেন আর একটা
করে গান ধরেন। আর আশা ভোঁসলের সেই গান তো রীতিমত মাইলস্টোন- পান খায়ে
সঁইয়া হমারো!
সামান্য আয়োজন। একটুকরো পান। কোনও কত্তা জর্দা খান কেউ খান না। তখন শুধুই একটু চুন। সুপুরি। তার সঙ্গে বড়জোর এক চিমটে মৌরি।
এখানেই
একটা প্রেফারেন্স কাজ করতো। একেকজনের হাতে একেকজন পানখাওয়া পছন্দ করতেন।
ঠিক কতটা চুন কতটা জর্দা দিলে পানটা বেশ জুতসই হবে, তার মাপ ছিলো আলাদা
আলাদা। চুন একটু বেশি পড়লেই কারও মুখ কেটে যেত। আবার জর্দা বেশি হলেই
নেশা।
দুপুরে
খাওয়া-দাওয়ার পর ননদ ভাজ, শাশুড়ি বউমার পরনিন্দা পরচর্চার জমাটি আড্ডা
বসতো গালে পান নিয়ে। শাশুড়ির দাঁত নড়বড়ে। কিন্তু পানের নেশা ছাড়ার নাম
নেই। অগত্যা, ছোট্ট পেতলের হামান-দিস্তায় পান ছেঁচে মুখে ভরা।
পানপাতারও
কী কম বৈচিত্র্য নাকি। পাতি, মধ্যবিত্ত, কুলীন সবই আছে। বাংলা পাতা, মঘাই
পাতা, মিঠা পাতা। কোনটার সাইজ ছোট, কোনটা মেজ, আবার কোনটা বড়। বাবুর পেটের
সাইজের সঙ্গে পানপাতার সাইজের কোনও আনুপাতিক সম্পর্ক আছে কিনা জানি না।
আর আছে বেনারসী পান। খাঁটি কুলীন।
যা মুখে দিতেই 'বনধ অকল কী তালা' খুলে গেছিল 'ডন' বিগ বি'র।
'খাইকে পান বনারসওয়ালা!'
সময়ের
সঙ্গে তাল রেখে সেজেছে পানও। একেবারে মডার্ন ট্রেন্ড। আর সাজবে নাই বা
কেন? পানসাজার আনুষঙ্গিকগুলোও তো রীতিমত খুশবুদার। আর রঙের বাহারও চোখে
পড়ার মতো।
এখন বাজারে চল চকলেট, স্ট্রবেরি,
ব্লুবেরি, হানি পানের। এছাড়াও আছে শিঙাড়া পান, আইস পান। এখন আবার নয়া
ক্রেজ- ফায়ার পান। তবে কাটতি ভালো মিঠা আইস পানের। তার আবার তরিবতও মন্দ
না। ওই পান সাজার পর সেটাকে ডুবিয়ে রাখা হয় এক বিশেষ মিশ্রণে। যার নাম
গুলকন্দ। নির্ভেজাল হোমমেড এই গুলকন্দ তৈরি হয় গোলাপের পাপড়ি, স্যাকারিন
সমেত আরও কিছু জিনিস দিয়ে। দোকানি কিছুতেই সেই রহস্য ফাঁস করতে চান না। এই
পান মুখে দিলেই হালকা মিষ্টির স্বাদ।
চাটনি
দিয়ে পানের স্বাদ চেখেছেন নাকি? হ্যাঁ, তাও আছে। মিন্ট ফ্লেভারও নাকি
স্বাদ বাড়িয়ে দেয় আদি অকৃত্রিম পানের। কারুর আবার বিশেষত্ব, পানে মিল্কি আর
আইসক্রিম সুপারি ব্যবহার করা। পানের স্বাদে বৈচিত্র্য আনার জন্য চল আছে
পিপারমিন্ট ফ্লেভারেরও। তবে পানের ভেতর স্পেশ্যাল হীরামোতি মশলা না পুরে
দিলে নাকি স্বাদই খোলে না! এরকমই মত এক দোকানির। আবার অনেকের পছন্দ হালকা
গোলাপজল ছেঁটানো পান।
নানা মুনির নানা মত। তবে লক্ষ্য সবার এক- পানে স্বর্গীয় আবেগ আনা।
পানের
এই সাতকাহন শুনে কি জিভটা এবার লকলক করছে। মনটাও করছে 'পান পান'? তাহলে
মনটাকে শক্ত করুন। এসব পানের স্বাদ চাখার জন্য কিপটেমিতে মানা। যদিও মাত্র
পাঁচ টাকাতেই শুরু, তবে সে মামুলি পান। মন ভরানোর দাম আরেকটু বেশি। এক হাতে
পান নিন, অন্য হাতে বাড়িয়ে দিন আড়াই তিনশো টংকা।
তবে
পান রসিকদের সাফ কথা- পানের রাজা বেনারসী পান। সত্যিই স্বর্গীয়! সেসব
পানের পাতাও নাকি গাছে বেড়ে ওঠে পোষ্যর যত্নে। নির্দিষ্ট দিনেই গাছ থেকে
পাতা তোলা হয়। তারপর সেই পান সাজা হয় অগুনতি মশলা সহযোগে।
বাবুয়ানির
চূড়ান্ত প্রকাশ এই পানবিলাসে। পানসাজা হয়ে গেলেই পানপর্ব শেষ নয়। দোকানি
সেই পান যত্ন করে কচি কলাপাতায় মুড়ে কাস্টমারের হাতে ধরান। তবে অনেকেই
বিকল্প পথ বেছেছেন। তাঁরা সুন্দর ছোট্ট বাক্সে পান ভরে দেন। আবার আছে
আড়াইশো টাকা দামের দ্য ফার্স্ট নাইট পান। এই পান আবার মোড়ানো হয় এডিবল
গোল্ড ফয়েলে। সঙ্গে থাকে অরিজিনাল কেসর আর স্যাফরন। একেবারে রাজকীয়
ব্যাপার-স্যাপার!
আসলে সবাই চান, তাঁর সাজা পানে এক বিশেষত্ব আনতে। তাই এক্সপেরিমেন্টের পর এক্সপেরিমেন্ট।
চলছে
পানের বিবর্তন। কিন্তু এতকিছুর পরেও মন্দার ছায়া পড়েছিল পানবাজারে। পানের
জায়গা দখল করেছিল পানমশলা। ছায়া সরছে। ফের সুদিনের আলো দেখতে পাচ্ছেন
পানরসিকরা। পানের প্রত্যাবর্তন হচ্ছে।
'মধ্যে তো
বিয়েবাড়ি থেকেও উধাও হয়ে গেছিল পান।' বলেন এক পানরসিক। 'সেখানেও পানের
বদলে সার্ভ করা হতো পানমশলা। এখন আবার পান ফিরে এসছে। রাংতা বা ফয়েলের
জার্সি গায়ে। তৈরি হচ্ছে পান কাউন্টার।'
প্রায়
পাঁচ হাজার বছর ধরে পান চিবিয়ে চলেছে মানুষ। তবু ক্লান্তি নেই। পুরাণ
থেকে আয়ুর্বেদ, সব জায়গাতেই পানের উল্লেখ। অ্যাস্ট্রোনেসিয়ান বণিকদের হাত
ধরেই ভারতীয় উপমহাদেশে পানের আগমন, এমনটাই মত কিছু গবেষকের। তারা আবার ওই
পান আমদানি করেছিল জাভা সুমাত্রা দ্বীপ থেকে। মাত্র পাঁচশো বছর আগে পান
পৌঁছয় উত্তরভারত আর কাশ্মীর উপত্যকায়।
আরেকদল
গবেষকের দাবি উল্টো। পানের আদিনিবাস ভারত। এর ইতিহাসও সুপ্রাচীন। এখান
থেকেই পান ছড়িয়ে পড়ে প্যাসিফিক অঞ্চলে। আয়ুর্বেদে পান শুধু শখ- শৌখিনতার
প্রতীক নয়। এই শাস্ত্রে পানকে ঔষধির মর্যাদাও দেওয়া হয়েছে। কানে কোনরকম
সংক্রমণ, সুগার রুখতে পান দারুন উপকারী। কাজ করে অ্যান্টিসেপ্টিকেরও। এছাড়া
সহায়ক হজমের। মাউথ ফ্রেশনারের কাজেও পান পারদর্শী। তবে বিশ্বস্বাস্থ্য
সংস্থার হুঁশিয়ারি, পান নিজে উপকারী ঠিকই। তবে পানসাজার উপকরণগুলো কিন্তু
বিপদ ডেকে আনতে পারে।
মোদ্দা কথা, পানের ইতিহাস ভূগোল
যাই হোক না কেন, পান শেষ পর্যন্ত পানই। আর তা রসিকদের মুখে মুখে ঘুরবেই।
রসালো পানের জাত ধর্ম বিচারের অত দরকারটা কি!
আবার
পুরাণের মতে, সংস্কৃত পর্ণ শব্দটি থেকে এসছে পান। এই পান মঙ্গলকারী।
সৌভাগ্যের প্রতীক। মহিশুরে অনুষ্ঠান মানেই পান। অতিথিদের আপ্যায়িত করা হয়
এক খিলি পান দিয়ে। অসমে সৌজন্যতার প্রতীক পান। ভোজনপর্ব মিটলেই হাতে হাতে
পান। আবার তামিলনাড়ুর রেসিপিতেও ঢুকে পড়েছে সে। বেশ এক উপাদেয় পদ তৈরি করা
হয় চালের সঙ্গে পান, রসুন সেদ্ধ করে। আর বাঙালির ঘরকন্নায় পানের মহিমা তো
অসীম।
নিউ ইন্ডিয়াতে
পানের ভবিষ্যত নিয়ে ভাবতে পারে মোদি সরকার। একথা বলছেন তাঁরাই, যাঁরা
রামায়ণ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেন। অবসরে পুরুষোত্তম শ্রীরামচন্দ্রও নাকি পরম
আহ্লাদে তাম্বুল সেবন করতেন। পানের ওপরে সুনজর ছিল সীতাদেবীরও। তখন
সীতাদেবী রাবণের শ্রীলঙ্কায় বন্দি। এমন সময় সেখানে উপস্থিত হলেন হনুমান।
রামভক্ত হনুমানকে দেখে আনন্দে চোখ ভরে এলো সীতামাতার। বন্দিদশা থেকে মুক্তি
পাওয়ার আশায় নেচে উঠলো সীতাদেবীর মন। খুশিতে তিনি পানপাতার মালা গলায়
পড়িয়ে দিলেন হনুমানের।
গোটা ভারতকেই যেন এক সূত্রে বেঁধে রেখেছে পান। পূর্ব পশ্চিম উত্তর দক্ষিণ, সর্বত্রই পানবিলাস।
(তথ্যের জন্য কৃতজ্ঞতা স্বীকার: মোনালিসা মুখোপাধ্যায়)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours