সীমন্তী দাস, সমাজকর্মী:
ভোট পর্ব ঘোট পর্ব সব মিটলো। বিশ্বকাপের হাওয়ায় মিশে যাবার আগে মনের কোণে জমে থাকা একটা দলা ধুসর মেঘ আমাকে ভাবাচ্ছে। খামচে ধরছে যেন।
ছেলেবেলা থেকে ঠাকুমার ঝুলি,আরব্যরজনী এইসব গল্পে সৎমা চরিত্রটাকে ভয়ানক এক ডাইনি রূপ দেওয়া হত। লালকমল,নীলকমল একে অপরের সৎভাই। আর ছোট মা (যিনি পরে বাবার বৌ হয়েছেন) সে ডাইনি না হয়ে যায় কোথায়। "ধরা মাঝে রূপসী কে সকলের চেয়ে"? আয়নাকে ছোট রাণী প্রশ্ন করলো, আয়নাতে ভেসে উঠলো সতীনের মুখ, রাণী রাগে চুরচুর করে ভেঙে ফেললো আয়না।
এমনই এক শৈশবে আমার নিজের চোখে দেখা এক মহিলা যিনি আমার এই ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেন। আমার বড় মাসী। তখন মায়ের সাথে চেহারার অমিল কেন জানতে চাওয়ায় জেনেছিলাম, আমার মায়ের রক্তের সম্পর্কে যিনি দিদি , তিনি আমার দিদিকে জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান। আর মাসী বন্ধুর সন্তান, তার সমস্ত পরিবারকে নিজের করে গোটা জীবন কাটিয়ে দিলেন।
পুরানো জামা কাপড়ের ভাঁজে আমার মেয়ে হবার পর তার জন্য তৈরি করা জামা আজও তার অকৃত্রিম ভালোবাসার পরিচয় বহন করে।
তারপর থেকেই ,আমি ঐ সৎমার গল্প গুলোর বিরুদ্ধে ক্লাস থ্রি থেকেই নিজের মতামত প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে আসছি।
এতবছর বাদে বলতে পারেন একটা নিস্ফল প্রতিবাদ এমন সৎবাবা নিয়েও।
বিদেশি ভাষায় গালিগালাজ বুঝি মধুর। দেখি একটি শব্দ খুব ব্যবহার হচ্ছে "বায়লোজিক্যাল ফাদার" ।
বিবাহবিচ্ছেদের পর মহিলাদের এই শব্দটির মুখোমুখি হতে হয় , "আচ্ছা ওর বায়লোজিক্যাল ফাদার কি-----???"
অদ্ভুত প্রশ্ন। যে বাবা সন্তানের দায়িত্ব নেন না, কোন কর্তব্য করেন না, শুধু নিজের পৌরষের ছাপ আর পুরুষকারের চিহ্ন আপনার শরীরে ছেড়ে গেছেন, তিনি কেমন আপনার সন্তানের সব সাটিফিকেট জুড়ে, আধার কার্ডের আধার হয়ে আছেন বছরের পর বছর।
আর অপরপক্ষে আপনি, যিনি বর্তমানে (বিধবা,ডিভোর্সী, বা আইনের সাহায্য না নিয়ে একার জীবন বেছে নিয়েছেন) নতুন যে জীবন বেছে নিয়েছেন সেখানে যে নতুন পুরুষ সঙ্গী আপনার সাথে আছেন সওয়াস্তি, ভরসা, নির্ভরতা জুগিয়ে, তিনি আপনার সন্তানের জন্য লাখো গুণে বেশী কেয়ারিং ঐ বায়লোজিক্যাল ফাদারের থেকে।
ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি দলাদলি যখন হলই তখন এই দ্বিতীয় শ্রেণীর বাবারা হোন "সাইকোলজিক্যাল ফাদার"।
এমনই কয়েকজন সাইকোলজিক্যাল ফাদারের কথা বলি।
"জানো দিদি, আমি বাবিনের জন্যেই ওর মাকে বিয়ে করেছি"। দুবছরের বাচ্চা বাবিন। তিনুদা হঠাৎ মারা গেলেন। ওর মা কেমন পাগলের মত দিশেহারা।বাবিনকে মেরে নাকি নিজে মরবে এমন দুরভিসন্ধী মাথায় পাক খাচ্ছে । সে কি ভয়ানক অবস্থা। যা হলো তা ওই ছেলেটার জন্যেই।
যাক বাবা, তোমাদের আশীর্বাদে ছেলেটা ক্লাশ টেন পাশ করে গেল। বাবা এখন পঁয়ত্রিশ। ছেলে ষোল। এদের বন্ধুত্ব দেখার মত। ঈর্ষা করার মত।
তোদের বাবা, মায়ের যা অশান্তি তাতে ছেলে মেয়ে দুটো খারাপ হয়ে যাবে। এমন চিন্তার মানুষও আছেন। যে বড় গলায় বাবাকে বলতে পারে জন্ম দিয়ে ঘন্টা করেছিস। বাবা হতে গেলে শুধু একবার পৌরুষত্বের দম দেখালেই হয় না। এখানে, সাইকোলজিক্যাল রিলেশনসিপে সন্তানের মায়ের শরীরের জন্য কাঙালীপনা নেই। এক অদ্ভুত লড়াই আছে প্রেক্ষাপটে। আছে রক্তের সম্পর্ককে বুড়ো আঙুল দেখানোর অদ্ভুত বাসনা।
সেই মেয়েও যখন তার জীবনের প্রথম পরীক্ষার ফর্মে ঐ সাইকোলজিক্যাল ফাদারের নাম বসাতে চেয়ে প্রিন্সিপালের দরজায় যায়, নানান আইনী জটিলতায় সে আশাহত হয়ে রাগে দুঃখে বলে বসে, "শালা রক্তের নিকুচি করেছে। বাবা মা বাছাইয়ের অধিকার ছেলেমেয়েদেরই থাকা উচিত।"
এমন আরেক বাবা, ছেলে আছে যারা নিত্যই নিজেদের মধ্যে নিত্য দিন ধুন্ধুমার ঝামেলা করে। দুদিন বাদেই ছেলে আবার বাবার গা হাত টিপে ভাব করে নেয়।
বাবাও মাকে লুকিয়ে কিছু গোপন চুক্তিতে যায় । যেটা ওদের টপ সিক্রেট।
সমাজ বদলাতে শুরু করেছে।তাই সৎমা,সৎবাবা শব্দ দুটো থেকে 'সৎ' কথাটার সঠিক মূল্যায়ন এখন দরকার হয়ে পড়েছে।
সৎ মানে অনেস্ট। তাই রক্ত, জিন এসবের বাইরে দাঁড়িয়ে এই সম্পর্ক গুলো সত্যিই অনেস্ট হোক, হয়ে উঠুক। সভ্যতা আসলে সভ্য হয়ে ওঠার দাবিদার।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours