fiture
শম্পা ঘোষ, সহকারী অধ্যাপিকা, হাওড়া: 
ভারতবাসী ঔপনিবেশিক আমলে ব্রিটিশ শাসকের থেকে ক্রিকেট খেলা রপ্ত করেছিল। ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী তাদের সাম্রাজ্য বিস্তারের সুবিধার্থে ভারতীয় সামন্তবর্গের সঙ্গে সামাজিক মেলামেশার ফাঁকে ক্রিকেটের ব্যাট তুলে দিয়েছিল তাদের অনুগত ভারতীয় সামন্তবর্গের হাতে। মূলতঃ আর্থিকভাবে শক্তিশালী এই শ্রেণীর হাত ধরে ক্রিকেট খেলা ভারতে জনপ্রিয় হলেও পরবর্তী সময়ে তা আপামর ভারতীয়দের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। আসলে শাসক ব্রিটিশদের খেলায় পারদর্শী হয়ে, কখনো বা তাদের পরাজিত করার মধ্য দিয়ে (ফুটবল ও ক্রিকেট দুটোই) শোষিত ভারতবাসী ঔপনিবেশিক রাজের মুখের ওপর একটা যথার্থ জবাব দিতে পারার আনন্দ অনুভব করত। তাই ভারতে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল একটা  শোষিত জাতীর আত্মনির্ভরশীল হয়ে ওঠার একটা প্রয়াস। ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই ভারতীয়দের মধ্যে ক্রিকেট দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করেছিল। বিংশ শতকে গোটা ভারতব্যাপী উত্তাল জাতীয় আন্দোলনের যুগেও যে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা অব্যাহত ছিল তার প্রমাণ হল ভারতীয় ক্রিকেটার রনজিত সিংজীর জনপ্রিয়তা
যার মৃত্যুর পরের বছর থেকে তার স্মরণে রঞ্জি ট্রফি শুরু হয় (১৯৩৪ সালে)। ১৯৩০-এর দশকে জাতীয় আন্দোলনের সময়কালেও সি কে নাইডু বা মহম্মদ নিশার-এর নেতৃত্বে ভারতে  ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা একটি উল্লেখ করার মত বিষয় ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উত্তাল সময়ে যখন গোটা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ক্রিকেট খেলা বিঘ্নিত হয়েছিল, তখনও ভারতে রঞ্জি ট্রফি বা অন্যান্য খেলাগুলি নির্দিষ্ট সময় মোতাবেতই চলেছিল। স্বাধীনোত্তর ভারতে একাধিক সমস্যা নতুন ভারত রাষ্ট্রকে যেভাবে বিদীর্ন করে রেখেছিল তার থেকে ভারতবাসীকে এক চিলতে খোলা হাওয়া দিয়েছিল ক্রিকেটীয় বিনোদন। জাতি-বর্ণ-লিঙ্গ ভিত্তিক রাজনীতি কোথাও যেন একটু হলেও বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিল ব্যাটবলের ধাক্কায়। পঞ্চাশের  দশক থেকেই লালা অমরনাথ, পলি উমরিগার, বিজয় মঞ্জেরেকর, সুভাষ গুপ্তে, বিনু মানকরের হাত ধরে স্বাধীনোত্তর ভারতে ক্রিকেটের জয়যাত্রা সূচিত হয়েছিল। ১৯৫২ সালেই বিজয় হাজারের নেতৃত্বে ভারতীয়রা তাদের দুশো বছরের প্রভূর বিরুদ্ধে ব্যাট-বল হাতে টক্কর দিয়েছিল। সদ্য-স্বাধীন ভারত রাষ্ট্রের একাধিক সমস্যা ক্রিকেটের জনপ্রিয়তাকে বাধাপ্রাপ্ত করতে পারেনি। ষাট-সত্তর দশকে বিশেণ সিং বেদী, এরাপল্লী প্রসন্ন, চন্দ্রশেখর, গাভাসকার,মনসুর আলি খান পতাউদির নেতৃত্বে ক্রিকেটের জয়যাত্রা ভারতকে ক্রিকেটীয় বিশ্বে তাকে অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে প্রতিপন্ন করেছিল। তবে সবচেয়ে বড় সাফল্য ছিল ১৯৮৩ সালে ক্রিকেট বিশ্বকাপ জয় যেখানে ভারত পৃথিবীর সমস্ত ক্রিকেট দেশগুলির থেকে সেরার শিরোপা ছিনিয়ে নিয়েছিল। স্বাধীনতার মাত্র ৩৬ বছরের মাথায় দুশো বছর ধরে শোষিত, নিপীড়িত একটি জাতি ক্রিকেটকে অবলম্বন করে পৃথিবীর মানচিত্রে নিজের স্থান করেছিল এটা বেশ আশ্চর্যের বিষয়। স্বাধীনতার পর একাধিক সমস্যা, যেগুলো ভারতকে পদে পদে সমস্যা জর্জরিত করেছিল সেই কাশ্মীর- সমস্যা, হায়দ্রাবাদ-সমস্যা, মণিপুর-সমস্যা, পাকিস্থান-যুদ্ধ, চীনের সাথে যুদ্ধ, ঊদ্বাস্তু সমস্যা, বেকার সমস্যা সত্ত্বেও উত্তর-ঔপনিবেশিক যুগে ক্রিকেট তার গতি অপ্রতিরোধ্য রেখেছিল।
এই জনপ্রিয়তা ভারতে ধর্ম-জাতি-লিঙ্গ ভিত্তিক সমস্যার উর্দ্ধে উঠে কেবলমাত্র ক্রিকেটের ক্ষেত্রে ভারতীয় হিসাবে তাদের গর্বের জায়গা তুলে ধরেছিল। এমনকি মহিলাদের অংশগ্রহণের বিষয়টিও বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয়, মহিলা ক্রিকেটে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর মধ্যে ভারতের স্থান প্রথম সারিতে। অর্থনীতির নিরিখে ভারতে ক্রিকেট খেলা সব থেকে বেশী গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে গোটা পৃথিবীর ক্রিকেট রাজস্বের দুই-তৃতীয়াংশের বেশী আয় করে ভারত ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লীগ-এর দৌলতে। শুধু তাই নয় ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লীগ-এর জনপ্রিয়তার ফলে ভারত ক্রিকেট বিশ্বে প্রধান নেতৃত্বের ভূমিকায় অবতীর্ন। এ হেন দেশে ক্রিকেট বিশ্বকাপ নিয়ে উত্তেজনা তুঙ্গে থাকাটাই স্বাভাবিক। ভারতে ক্রিকেটকে একটি আলাদা ধর্মের পর্যায়ে গণ্য করা হয়ে থাকে। এত বৈচিত্র, এত বিভেদ, এত ক্ষুদ্র স্বার্থ সংঘাত ক্রিকেট মাঠে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। ক্রিকেট খেলার দর্শক হিসাবে কাশ্মীরের ছোট গ্রাম থেকে শুরু করে মুম্বাই-এর বস্তি পর্যন্ত সকল মানুষের তখন নীল জার্সিই প্রকৃত পরিচয় হয়ে দাঁড়ায়। তাই এই ক্রিকেটীয় বন্ধন কিন্তু একটা সমস্যাবিদূর রাষ্ট্রের পক্ষে কম আশার নয়। এই আশাই ভারতকে আগামী দিনে পথ দেখাবে এমনই বিশ্বাস রাখে ভারতবাসীও।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours