fiture
কাজল ভট্টাচার্য, সিনিওর জার্নালিস্ট, কলকাতা:

বামন হয়ে চাঁদে হাত বাড়ানো!
নীল আর্মস্ট্রং বলেছিলেন অন্য কথা।
'মানুষের জন্য এক ছোট্ট পদক্ষেপ। কিন্তু মানবজাতির জন্য এক দৈত্যাকার লাফ।"
চাঁদের মাটিতে পা রেখেই বলেছিলেন নীল। তাঁর ঠিক কুড়ি মিনিট পরেই নেমে এসেছিলেন নীলের সহচর অ্যালড্রিন। দিনটা ছিল জুলাইয়ের 20 তারিখ, 1969। আজ থেকে ঠিক পঞ্চাশ বছর আগে চন্দ্রজয় করেছিল মানুষ।

জুলাই মাসের 16 তারিখের সকাল। আমেরিকার ফ্লোরিডা শহরের দিকে তাকিয়ে গোটা বিশ্ব। সেখানে তখন তৈরি হতে চলেছে এক নয়া ইতিহাস। সাজ-সাজ রব কেনেডি স্পেস সেন্টারে। রুদ্ধশ্বাস প্রতীক্ষা। কাউন্টডাউন চলছে।
ঘড়ির কাঁটা আটটা বত্রিশ মিনিট ছুঁতেই যেন প্রবল বিস্ফোরণ।
'আমাদের যাত্রা হলো শুরু!'
অ্যাপেলো 11 স্পেস মিশনের চন্দ্রাভিযান।
তিনশো তেষট্টি ফুট উঁচু অতিকায় মহাকাশযান। তাতে চেপেই পৃথিবী ছেড়ে মহাকাশের পথে ধেয়ে গেলেন তিন নভশ্চর। 

অ্যাপেলো 11 মিশন। নীল আর্মস্ট্রং ছিলেন মিশন কমান্ডার। কমান্ড মডিউল 'কলম্বিয়া'র পাইলট মাইকেল কলিন্স। এডউইন 'বাজ' অ্যালড্রিন পাইলট ছিলেন লুনার মডিউল 'ইগল'- এর।

মহাশূন্যের পরতে পরতে রহস্য। তিনদিন সেই রহস্যের উজান ঠেলে অবশেষে উনিশে জুলাই। চাঁদের পিঠের দিকের আকাশে ভাসতে লাগলো মহাকাশযান অ্যাপেলোকে। আর ঠিক এ সময়েই বিপদ নেমে এলো। পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল মহাকাশযানের। কিন্তু লক্ষ্য যেখানে স্থির, সেখানে বিপদও পিছু হটে। এদিকে যাত্রা শুরুর পর দেখতে দেখতে কেটে গেছে একশো ঘণ্টা বারো মিনিট। আপাতত কাজ শেষ কমান্ড মডিউল 'কলম্বিয়া'র। তার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার জন্য তৈরি লুনার মডিউল 'ইগল'। চাঁদে নামতে হবে তো তাকে!

জুলাই 20। লাঞ্চ সেরে নিলেন আর্মস্ট্রং। পাইলট এডউইন অ্যালড্রিনের সঙ্গে চড়ে বসলেন 'ইগল'- এ । মূল মহাকাশযান 'কলম্বিয়া' থেকে বিচ্ছিন্ন হলো 'ইগল'। প্রস্তুতি শেষ চাঁদে নামার। দুই নভশ্চরকে নিয়ে লুনার মডিউল এবার নেমে পড়লো চাঁদে। মহাকাশ গবেষণা সংস্থা 'নাসা'র হিসেবে, পৃথিবী থেকে রওনা হওয়ার পর তখন কেটে গেছে একশো ন ঘণ্টা বারো মিনিট।

পরিকল্পনা মাফিক, 'ইগল' থেকে প্রথমেই বাইরে বেরিয়ে এলেন নীল আর্মস্ট্রং। এঁকে দিলেন চাঁদের বুকে মানুষের প্রথম পদচিহ্ন। তৈরি হলো এক ইতিহাস। আমাদের দেশে ঘড়িতে তখন রাত একটা বেজে সাতচল্লিশ মিনিট (গ্রিনউইচ মিন টাইম 20:17:39)। 

বিস্ময় তখন নীলের চোখেমুখে। এই চাঁদকে নিয়ে কতোই না কাব্য। মহাকাশবিজ্ঞানীরা অবাক চোখে চেয়ে থাকতেন চাঁদের দিকে। আজ সেই যুগ- যুগান্তের সব রহস্যের পরিসমাপ্তি। চাঁদকে ছুঁয়ে ফেললো মানুষ। যতোই দূরের হোক না কেন, চাঁদ আজ আপনজন।
আবেগে থরথর কাঁপছেন নীল আর্মস্ট্রং। 
চাঁদের শূন্য বুকে দাঁড়িয়ে তিনি বললেন- 'that's one small step for man, but one giant leap for mankind !'

ঠিক কুড়ি মিনিট পর চাঁদের বুকে পড়লো দ্বিতীয় মানুষের পদচিহ্ন। এডউইন অ্যালড্রিন।
শুধু নামলেই তো হলো না। চাঁদের বুকে একটু ঘোরাফেরা করাও চাই। এতদিন তো শুধু দূর থেকেই দেখা। তৈরাই ছিলো চাঁদে চক্কর মারার জন্য বিশেষ গাড়ি। নাম, 'সি অফ ট্র্যাঙ্কুইলিটি'। 
চন্দ্র পরিক্রমায় বেরিয়ে পড়লো দুই সহচর। এক- আধ ঘণ্টা না। পাক্কা একুশ ঘণ্টা ছত্রিশ মিনিট চাঁদের বুকেই তোফা কাটিয়ে দিলেন নীল আর এডউইন। তবে চাঁদের বুড়ির সঙ্গে তাঁদের দেখা হয়নি। ভিনগ্রহের মানুষ দেখে বুড়ি ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছিলেন কিনা কে জানে!

কতই না বিপদের মধ্যে পড়তে হয়েছে তিন নভশ্চরকে।  আর পড়বেন নাই বা কেন? পৃথিবী থেকে চাঁদে যাত্রা। সুদীর্ঘ পথ। চাঁদ যখন পৃথিবীর সবচেয়ে কাছাকাছি, তখন মধ্যেকার দূরত্ব 2 লক্ষ 25 হাজার 623 মাইল। আর যখন চাঁদ দূরে সরে যায়, তখন সেই দূরত্ব 2 লক্ষ 52 হাজার 88 মাইল। এই দুই দূরত্বের গড়পরতা হিসেব করে চাঁদ, পৃথিবীর মধ্যের দূরত্ব 3 লক্ষ 84 হাজার 400 কিলোমিটার।

সেদিনের চন্দ্রাভিযানের ওই গোটা পর্বটার নাম দেওয়া হয়েছিল  'অ্যাপেলো 11 স্পেস মিশন'। মোট তিনটি মডিউলের সমন্বয়ে সাজানো হয়েছিল মহাকাশযানকে। প্রথমটি 'কমান্ড মডিউল- কলম্বিয়া', দ্বিতীয়টি সার্ভিস মডিউল, আর তিন নম্বরটি 'লুনার মডিউল- ইগল'।
অভিযানের গোটা ব্যাপারটায় জড়িয়ে ছিল চল্লিশ হাজার মানুষ। তারা সবাই নানা পেশার, বিভিন্ন দেশের।  মহাকাশযান যখন মহাশূন্যের বুক চিরে উল্কা গতিতে এগিয়ে চলেছে তখনই হঠাত বিগড়ে গেছিল কম্পিউটার। যোগাযোগ কেটে গেছিল পৃথিবীর সঙ্গে। আবার আচমকাই চলে আসে জ্বালানী শেষের সঙ্কেত। ঠান্ডা মাথায় প্রতিটা সমস্যার মুখোমুখী হয়েছিলেন নভশ্চররা। জিতেও গেছিলেন। 

জুলাই 24, 1969। 
প্রতীক্ষায় গোটা পৃথিবী। সবার চোখ আকাশের দিকে। বুক দুরুদুরু। এত জটিল অভিযান বলে কথা। যতক্ষণ নভশ্চররা পৃথিবীর মাটি না ছোঁয়, ততক্ষণ উদ্বেগের শেষ নেই।
শেষ পর্যন্ত এগিয়ে এলো সেই মুহূর্ত। ভারতীয় সময়, সকাল দশটা বেজে পাঁচ মিনিট।
মহাকাশযান ঝাঁপিয়ে পড়লো প্রশান্ত মহাসাগরে। শেষ হলো 'অ্যাপেলো 11 স্পেস মিশন'। মোট সময় লাগলো একশো পঁচানব্বই ঘণ্টা, আঠারো মিনিট পঁয়ত্রিশ সেকেন্ড। নির্বিঘ্নে ঘরে ফিরেছিলেন তিন সহচর নীল, এডউইন আর মাইকেল।
তারপর থেকে তিন নভশ্চর আর চাঁদের দেখা হলেই হলো! তিন বন্ধু অপলক চোখে তাকিয়েই থাকে চাঁদের দিকে। চোখ ফেরাতে পারে না চাঁদও।
 
 
Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours