Mol
মোনালিসা মুখোপাধ্যায়, ফিচার রাইটার, হুগলিঃ


উদ্বাস্তু বাঙালি।
রক থেকে উচ্ছেদ হয়ে আজ মলের সিঁড়িতে আড্ডার পুনর্বাসন।

রক থেকে রকবাজি।
দেড়শো বছরের বেশি কলোনিয়াল কালচার। ইংরাজি বাংলা মিলেমিশে একাকার। ইংরেজির রকে বাঙালির আড্ডা। তাই রকবাজি। এও কলকাতার এক সুপ্রাচীন ঐতিহ্য। একদিকে যেমন বাঙালি তার চলার পথ আধুনিক করে তুলতে নব জাগরণ নিয়ে সমানে মাথা ঘামিয়েছে, ঠিক তেমনি সমানতালে আড্ডাও মেরে গেছে।

পটলডাঙার টেনিদার কথা মনে আছে তো?
স্যাঙাতদের নিয়ে আড্ডার আসর বসতো পাড়ার রকে। রকবাজিতে শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে, বরাবরই এগিয়ে কলকাতার উত্তরের ঘটিরা। কলকাতার আশপাশের জনপদগুলিতেও সমান জনপ্রিয় ছিল রকবাজি।

লাল টকটকে মেজে। ইট-বালি-সিমেন্ট দিয়েই তৈরি বসার জায়গা। যাঁর যেমন ট্যাকের জোর, তাঁর তত বড় রক। আবার দুষ্টু লোকেরা মুচকি হেসে বলতেন, "বাবুর মনখানাই তো পায়রার মতো, ছোট্ট। রক বড় হবেটা কিভাবে?" মোদ্দা কথা, যে বাঙালির মন যত বড়, তাঁর রকও তত বড়। রকের ধার ঘেঁষে অপটু হাতের সিমেন্টের সিংহ। সেই রকেই দিনভর রকবাজি।  অবশ্য পালা করে।

তখন এত পার্কের বাড়াবাড়ি ছিলো না। ছিল পতিতোদ্ধারিনী গঙ্গার পাড়। যৌবনবতী গঙ্গার কুলুকুলু গুঞ্জন, তার সঙ্গে ফ্রি শুদ্ধ তাজা সমীরণ। সেখানে প্রাতঃভ্রমণ সেরে প্রবীণ পক্ককেশ বাবুমশাইরা একে একে জমা হতেন রকে। সেখানে কিছুক্ষণ না বসলে, গঙ্গাপাড়ের বিশুদ্ধ বাতাসও যেন হজম হবে না।

কী দিনকাল এল! সবারই তখন এক চিন্তা। হাজার হলেও গোরা সাহেবরা হলো গিয়ে রাজার জাত। সেই সাহেবরা বিদায় নিলো। দেশভাগ। দাঙ্গার রক্তাক্ত তরতাজা স্মৃতি। ওপার বাংলা থেকে উদ্বাস্তুর ঢেউ। আকাল। পেট শুকিয়ে রাস্তায় গড়াগড়ি কতশত বাঙালির লাশ। পারবেন তো নেহরু, বিধান রায় রাজধর্ম পালন করতে?

জিনিসের দাম বাড়ছে। সবকিছু দেখে কপালে ভাঁজ খানদানি আড্ডাবাজদের। দশটা পাঁচটার চাকরিতেও তেমন অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারেনি বংসন্তান। তাই হাতে অখন্ড অবসর। তখন মনভারী বাঙালীর। রকে বসে একে অন্যের সঙ্গে সেই মনখারাপ শেয়ার করে নেওয়া। তাতে খানিকটা উদ্বেগ কমলেও কমতে পারে।

একসময় চিন্তিত মুখে প্রবীণদের আড্ডার আসর ভাঙত। গৃহস্থের টুকিটাকি কাজকম্ম তো থাকেই। তখন রকের দখল নিতো অপেক্ষাকৃত কম বয়সীরা। মনে পড়ে, 'লুকোচুরি' সিনেমার সেই গান?
'তগড়াই বেঁটে বড়দা   খায় পান সাথে জর্দা
গুলবাজি ডিগবাজি রকবাজি শুধু চলে....'
মাত্র কয়েকটা শব্দ। তাতেই গীতিকার এক নিখুঁত ছবি এঁকেছিলেন রকবাজ বাঙালির। কিছু পাড়া তো টেপি, কুন্তিদের জন্য একেবারে নিষিদ্ধ ছিল। আবার এমনটাও ছিল সকালে যাওয়া যায়, সন্ধের পরে নয়। রকবাজ দাদারাও তো কম রসিক ছিলেন না!

বড়দারা বিদায় নিলেই, গুটিগুটি পায়ে পড়ার রকে হাজির হয়ে যেত উঠতিরা। তখন আমি বেশ ছোট। মা, কাকিমারা পইপই করে সাবধান করে দিত, নাড়ুবাবুর গলিতে ভুলেও পা রাখবি না। কিন্তু স্কুল থেকে ফেরার সময় ওই গলিটাই যেন কী এক অদম্য টানে টানতো। সেই নিষিদ্ধ ফলের মতো। গলি পেরোতে গেলেই মুখুজ্জেদের রক থেকে উড়ে আসতো রসালো সব কথাবার্তা। নানা ইঙ্গিত নিষিদ্ধ দুনিয়ার।
আবার বোসবাবুদের রক পেরোতে গেলেই রকবাজরা পরম উৎসাহে ছুঁড়ে দিতো নিধুবাবুর রসালো টপ্পার দু-একটা সোঁদা গন্ধমার্কা কলি। কানে আসতো গুচ্ছের নতুন শব্দ। তার মানেগুলো সব বুঝতাম না ঠিকই, কিন্তু এটা বুঝতে পারতাম ইঙ্গিতটা ঠিক সুবিধার নয়।

আবার পাড়ার কিছু রক ছিলো 'রিজার্ভড ফর সিনিয়র সিটিজেন'। দাদুকে দেখেছি, লাঠি হাতে রোজ বিকেলে ভটচাজ্জিদের রকে বন্ধুদের সাথে বসে গল্প করতে।অনেকের হাতে থাকতো সেদিনকার পেপার। রক যে বেদখল হতো না, এমনটা নয়। জমে উঠতো কাকাদের তাসের আসর। তবে বড়দের কেউ এসে হাজির হলেই বিনা বাক্যব্যয়ে যে যার মতো কেটে পরতো।

বেশ রগড়ও হতো। বড়দের রকের আড্ডা সন্ধায় ভাঙ্গত। কমবয়সীদের আড্ডা চলতো আরও কিছুক্ষণ। দাদুর দলের আড্ডা থেকে ফেরার পথেই পড়ত কাকুদের রক। দাদুদের ফিরতে দেখেই কাকুরা চট করে হাতের সিগারেট লুকোতো। কিন্তু ততক্ষণে যা দেখার দেখা হয়ে যেত দাদুদের। গোমরামুখে নিজেদের মধ্যেই তখন বলাবলি, আজকালকার ছেলে। যখনই দেখ সিগারেট ফোঁকা, আর রকবাজি।


কালচক্র ততদিনে বেশ কয়েকটা পাক খেয়েছে। বদলে গেছে রকবাজির চরিত্র। সংখ্যা কমেছে আড্ডাবাজের। প্রতিপত্তিতে টান পড়তে শুরু করেছে বাঙালির। শুরু হয়েছে রকের সংখ্যা কমাও।

তখন ফুটবল খেলা হতো ইডেনেই। আর রকবাজরা খেলার দিনগুলো পাড়া মাতাতো রেডিওর ধারাবিবরণী বাজিয়ে। রকেও পতপত করে উড়ত মোহনবাগানের পতাকা। বেশ একটা উৎসবের মেজাজ রকে-রকে। মোহনবাগানের ওপর বিশেষ এক আবেগ কাজ করতো বাঙালির। সাহেবদের বুট পরা পা থেকে ফুটবল কেড়ে নিয়েছিল বাগানের খালি পা-এর প্লেয়াররা।

ওদিকে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা বাঙালিদের দুর্বলতা ছিল ইস্টবেঙ্গলের ওপর। এপার পশ্চিম বাংলা হলে ওপার পূর্ব বাংলা। ইস্টবেঙ্গল নামটার সঙ্গেই যেন জড়িয়ে গেছিল পুর্ব পাকিস্তানে ফেলে আসা ভিটেমাটির টান। তাই স্পষ্টাস্পষ্টি এক বিভাজন রেখাও টানা হয়ে গেছিল মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গলের। উত্তরের ঘটিরা মোহনবাগান। দক্ষিণের বাঙালরা ইস্টবেঙ্গল।
খেলার দিন অনেক রকেই জোর ধরতো তুমুল তর্ক- ঘটি বাঙালের।

ক্রমেই পাল্টে যেতে লাগলো কলকাতার ছবিটা।
বাঙালির সুদিনে তখন গ্রহণ বেশ চেপে বসেছে। বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী। কিন্তু ভিনদেশি সওদাগরদের সঙ্গে ঠিক তখন পেরে উঠছে না বাঙালি। খানিকটা পরিশ্রমে বিমুখ, আবার বিলাসিতাও বাঙালির রক্তে। অথচ তখনও গুলবাজি, ডিগবাজি, রকবাজি আর সুযোগ পেলেই বাঙালির পায়রাবাজি।

উত্তরের দখল ক্রমেই হাতছাড়া হতে লাগলো বাঙালির। এ শহরটাতে এক সময় যেমন রবীন্দ্রনাথ, নেতাজি, সত্যজিত, উত্তমকুমাররা ছিলেন, তেমনি ছিলেন রকনিষ্ঠ বংসন্তানেরাও। সহাবস্থানে কোনদিনই কোনও আপত্তি ছিলো না বাংলার। কিন্তু ভিনপ্রদেশের সংস্কৃতির কাছে যেন আত্মসমর্পণ করে বসলো পোস্ট মডার্ন বাঙালি।

রকের সঙ্গে বাঙালি হারালো তার শৈশব, যৌবন, শুদ্ধ বাঙালিয়ানাও। সম্পর্কের বাঁধন ছিন্ন হলো তুতো কাকা, দাদুদের সঙ্গে। আর হারালো বাঙালির সরল রসবোধ।
শূন্য পড়ে রইলো শ্যামবাজার, শোভাবাজার, গিরীশ পার্কের রক।
আজ নবপ্রজন্মের বঙ্গসন্তানের রকবাজির নয়া ঠিকানা মলের সিঁড়ি।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours