Fiture
পার্থ বসু, লেখক,হাওড়াঃ কবিগুরুর জন্মদিন ফেলে এলাম ২৫শে বৈশাখ। একই কবির উত্তরাধিকার বইছে দুই বাংলা। কিন্তু বাংলা ক্যালেন্ডার যা আমাদের অখণ্ড বাঙালী জাতীয়তার অভিজ্ঞান এখন দু বাংলায় দু খাতে বইছে। এই ক্ষোভ আর প্রতিবাদ দিয়ে লেখায় আসছি। কবিগুরুর কথা দিয়েই শুরু করি। ' তোমার পূজার ছলে তোমায় ভুলে থাকি--' । ভূমিকায় কিছু সুখ রাখা যাক। দুঃখ তো আছেই। ছেলেবেলায় ইস্কুলে প্রশ্ন থাকত-- বড় হয়ে কি হতে চাও ? কেউ লিখত ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার। এক গরীব শিশুর স্বপ্ন নিয়ে, যে বড় হয়ে রবীন্দ্রনাথ হতে চায় সব বাধা ডিঙিয়ে, সেই বুদ্ধুরামের গল্প নিয়ে একেবারে অন্য ধারার নাটক নিয়ে ভারতের প্রান্ত থেকে প্রান্তে ক্লান্তিহীন যাত্রায় মগ্ন এক মধ্য তিরিশের কাশ্মীরী যুবক। এই শিলচরের মাটিতেই হয়তো কবে হাজির হবেন। গত পনেরো বছর ধরে ধরে তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন তাঁর নাট্যদলরঙ্গলোক। দল না বলে সংস্থা বলব ? লাকি গুপ্তা , যার কথা বলছি , একাই একশ'। 'মা মুঝে টেগোর বনা দে' এই নাটকে তাঁর একক অভিনয় মঞ্চসফল বলার যো নেই। কারণ এ নাটক অভিনয়ের জন্য মঞ্চই লাগে না। এ নাটক টিকিট কেটেও দেখতে হয় না। অভিনয়ে প্রীত দর্শক যা দেন তাই তাঁর প্রণামী। নাটকের গল্প পাঞ্জাবী লেখক মোহন ভাণ্ডারীর। নাট্য রূপান্তর প্রয়োগ পরিকল্পনা সব লাকির। রবীন্দ্রনাথ শুধু কবি নন। তিনি আমাদের শিক্ষক। দার্শনিক। পথপ্রদর্শক। কবিকে ছবির ফ্রেমের বাইরে এনে ছড়িয়ে দিচ্ছেন গ্রাম নগরে। দেশের এ কোন থেকে ও কোনায়। লাকিকে কি বলে অভিনন্দিত করি ? জয় হো ? লাকির জয় হোক। সুখের কথায় সুচনা হল। এবার সূচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বার হবার কথা। দুঃখে। এ গল্পটা কয়েক দশকের পুরনো। সাহিত্যিক কথাশিল্পী অমলেন্দু চক্রবর্তীকে মনে আছে ? বাংলা পড়াতেন খিদিরপুর হিন্দু ইন্সটিটিউশনে। তাঁর রাধিকা সুন্দরী বা গোষ্ঠবিহারীরজীবনযাপন বা অন্য বইয়ের কথা না বলে চটজলদি স্মৃতি উসকে দিতে আকালের সন্ধানে বা একদিন প্রতিদিন--- ঠিক ধরেছেন ! মৃণাল সেন তাঁর গল্প নিয়ে সিনেমা করেছেন। তাঁর মুখেই শোনা একটি ঘটনার কথা শুনুন। ক্লাসে ছাত্রদের অমলেন্দু একদিন জিজ্ঞাসা করলেন-- বাড়িতে টি ভি আছে কার কার ?

প্রায় সবাই হাত তুলল। কালার টি ভি কার কার ? ( তখনও সাদাকালোবিদেয় হয় নি ) এবার হাত উঠল সংখ্যায় কম। বাড়িতে রবি ঠাকুরের সঞ্চয়িতা আছে ক'জনের ? একটিও হাত উঠল না। যে সব গৃহে বই স্ট্যাটাসসিম্বল, সোনার জলে দাগ পড়ে না খোলে না কেউ পাতা , তাদের এই হিসেবের বাইরে রাখছি। কাহিনীটি অমলেন্দুর গলায় হাহাকারের মত শুনিয়েছিল। একটু আসামে ঘুরে আসি চলুন। তিনিসুকিয়ায়। তারও আগে নাগাল্যান্ডঘুরিয়ে আনি আপনাদের। মোককচং। শহর মোককচং। জিলা মোককচং। পাহাড় মোককচং। বি ডি ও অফিস ওংপ্যাং কং। আও উপজাতির বাস। ওখানে এককালে কোলকাতায় মোহনবাগানে খেলে যাওয়া টি আও-য়ের সাথে আলাপ হয়েছিল। নাগা জঙ্গিরা তখন বেশ সক্রিয়। কর্নেল আও স্বাধীনতা দিবসে জাতীয় সঙ্গীতে গলা মেলাতেন--- জন গণ মন-- । বলা বাহুল্য এটি আমাদের দেশের জাতীয় সংগীত। কবিগুরুর লেখা। ওপার বাংলার জাতীয় সঙ্গীতও তাঁরই রচনা। এমনকি সিংহলের জাতীয় সঙ্গীতও তাঁরই লেখার অনুবাদ। এসব তথ্য এখন বহুল প্রচারিত। তাই ? নাগাল্যান্ডে নানাজনকে জিজ্ঞেস করেছি। গানটি টেগোর লিখেছেন সবাই জানেন। গানটি কোন ভাষায় লেখা ? বেশীর ভাগ উত্তর – হিন্দি। একজন অধ্যাপক শুধু জানালেন – না, হিন্দি নয়, গানটি সংস্কৃতে রচিত। আসামে লেখক কে বা গানটির ভাষা কি তা নিয়ে কোন সংশয় নেই। তবে আসুপ্ররোচিত চাপা প্রতিবাদ আছে-- এই গানে – পাঞ্জাব সিন্ধু গুজরাত মারাঠা দ্রাবিড় উৎকল বঙ্গ আছে। আসাম কই ? চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী। এ গানে তো ঝাড়খণ্ডও নেই, বিহার নেই, ছত্তিশগড় নেই--- অসহিষ্ণু অসমীয়া সহকর্মী যুক্তিতে কান পাতলে তবেই না ! পশ্চিম বাংলার হালটিও খতিয়ে দেখা হোক। আমার প্রস্তাব কুইজে এই প্রশ্ন তাবৎ স্কুল কলেজের ছাত্র ছাত্রীদের করা হোক-- ভারতের জাতীয় সংগীত কোন ভাষায় লেখা? কুইজ যদিও জ্ঞান নয় ,পল্লবগ্রাহিতা। তবু কে কতটা খবর রাখে তার একটা সূচক। বাংলা মাধ্যমের স্কুলে না গিয়ে চলুন আমাদের এলিটদের ছেলেমেয়েরা যে সব দিল্লী বোর্ড, সি.বি.এস.সি, আই.সি.এস.ই ইত্যাদি পাঠক্রমে পড়ে, বা আমাদের রমরমিয়ে চলা আমজনতার কে জি স্কুলের শিশুরা তাদের প্রশ্ন করি। বালক জানে না। আর শিশুরাও না শেখালে---- কোলকাতায় আমার অফিসের অধস্তন চতুর্থ শ্রেণীর এক কর্মী জানতে চেয়েছিল-- রবীন্দরনাথ কোই বড়া কবি থে ? আমি কিছুটা তার বোঝার মত করে বললাম। সে এবার আরও খোলসা করে প্রশ্ন রাখল- ও অমিতাভ বচ্চনকে পিতা হরিবংশ রাই বচ্চনসেভি বড়া পোয়েটহ্যয় ? আমি কি আর জবাব দিতাম ! ছেলেটি নাগাড়ে বলে চলল-- অগর মান ভিলেরবীন্দরনাথ বড়া পোয়েট ও বাংলা মে লিখে কিউ বেকার। হিন্দিমে লিখে হোতে তো কিতনিশানপ্রতিষ্ঠামিলতা। ছেলেটির কথা অর্বাচীনের প্রলাপ ভেবে না নিলেই ভাল। ছেলেটির গলায় বাকি ভারতবর্ষ কথা বলেছে কিন্তু। আর তারকার মুখে ছাই দেওয়ার দৌড়ে এ বাংলাই কি পিছিয়ে? বাংলা ভাষার এক রগরগে লেখক ও এক স্বনামধন্য আবৃত্তি শিল্পীর যুগলবন্দী কবিগুরুর কেচ্ছা বেচে বাজার মাত করছে। হতাশার কথা লোকে খাচ্ছেও। ভারতের মাটিতে বাংলা ভাষাই যদি মর্যাদা বা প্রতিষ্ঠা না পায় রবীন্দ্রনাথ উল্লেখ পাবেন তাঁর গীতাঞ্জলীর ইংরাজি অনুবাদে। চিত্ত যেথা ভয়শূন্য নয়, where the mind is free-- বড় জোর এইটুকুই। সেই কবে আবু সয়ীদ আইয়ুব শুধু কবির মাতৃভাষায় কবিকে পড়ার জন্য প্রৌঢ় বয়সে নিবিড় চর্চায় বাংলা শিখেছিলেন শুধু না, বাংলা ভাষার পুরোধা প্রাবন্ধিকের স্বীকৃতি পেয়েছেন তা এখন ইতিহাস। পশ্চিম বাংলাতেই বাংলা ভাষা এখন কোণঠাসা। ভাষাই যদি না বাঁচে ! বলা হয় কবি হলেন সভ্যতার চারণ। যে কোন সভ্যতার একজন প্রমুখ কবি থাকেন। হরপ্পামহেঞ্জদরোর ? নিশ্চয় ছিল। ভাষাই বাঁচে নি। লিপি পড়া যায় নি। বাঁচেন নি কবিও। আসুন। আগে সর্ব শক্তি দিয়ে ভাষাকে বাঁচাই। আ মরি বাংলা ভাষা । আসুন। ভাষার অধিকার অর্জন করি। রক্ষা করি। কবি বীরেন চট্টোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তাঁর এক কবিতায় বলেছিলেন -- এক লক্ষ বছরের পর / রবীন্দ্রনাথের ছবি ইঁদুরের আত্মার ভিতর।এই নির্মম কাল পরিণতিকে আসুন উপেক্ষা করি।  কবি বীরেন চট্টোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তাঁর এক কবিতায় বলেছিলেন -- এক লক্ষ বছরের পর / রবীন্দ্রনাথের ছবি ইঁদুরের আত্মার ভিতর।এই নির্মম কাল পরিণতিকে আসুন উপেক্ষা করি। কবিকে আত্মস্থ করি। বাকি ভারতে অন্তত লাকির মত মানুষও আছেন। আসুন। গলা মেলাই-- মা মুঝে টেগোর বনা দে।
মোককচংয়ের কথা সেভাবে শুরুই হ’লনা।শেষ হয়ে হইলনা শেষ তাও বলা যাবেনা।কিন্তু এই নিবন্ধের প্রস্তাবনায় শিরোনামে একটি মরুদ্যানের সংকেত আছে--- মোককচং।পাঠকের ধৈর্যচ্যূতি না ঘটিয়ে পাশের রাজ্য আসামের জাতিদাঙ্গা, বঙ্গাল খেদাও সাম্প্রতিক নাগরিক পঞ্জীর বাহানায় চুড়ান্ত পর্বের বাঙালি বিতাড়নের প্রেক্ষিতে নাগাল্যাণ্ড কিভাবে বাঙালিকে বুকে টেনেছে তার কিছু গল্প ও গাণিতিক তথ্য পেশকরছি।
বাংলা ভাগ প্রথম হয়েছিল ১৯০৫য়ে। রদ হয়১৯১১য়।রাখী বেঁধেছিলেন দুই তরফের ঋত্বিক কবি রবীন্দ্রনাথ।এই ইতিহাস অর্ধসত্য।বাংলা প্রথম বিভক্ত হয়১৮৭৪ সালে।তখনকার বেঙ্গল প্রেসিডেন্সী ভেঙে পুরোশ্রী হট্ট আর রংপুর ডিভিসনের বড় একফালি গোয়ালপাড়া ইত্যাদি নিয়ে আসাম রাজ্যের পত্তন।মমতা বিহীন কালস্রোতে শ্রীভূমি হ’ল বাঙ্গালার রাষ্ট্র সীমা থেকে নির্বাসিত।প্রশাসনিক যুক্তি ছিল আসামের রাজস্বে স্বনির্ভরতা।দেশভাগের পর অসমীয়া জাতিবাদীদের টনক নড়ে।আসাম কোন ভাষার ভিত্তিতে গঠিত রাজ্য নয়।বাংলার ভূমি তারা বৃটিশের বদান্যতায় পেয়ে এতোদিন ভোগদখল করেছে।এখন আটশ' বছর আগে আসামে পারাখা গগৈরা খিলঞ্জীয়া,আর বাঙালি যে কিনা সহস্রাধিক বছরের ভূমিপুত্র তাদের নিজেদের নাগরিকত্ব প্রমান করতে হচ্ছে।আটক শিবিরে এক রকম বিনা অপরাধেই পচতে হচ্ছে।প্রায় একচল্লিশ লক্ষ বাঙালি যাদের নাগরিক পঞ্জী থেকে নাম কাটা গেছে তার আটত্রিশ লক্ষই হিন্দু বাঙালি।এই এনআরসি আগামীদিনে এই বাংলায়, চালু হবার সমূহ সম্ভাবনা।প্রমাদ গুণছি।
অসহিষ্ণু অসমীয়া জাতিবাদ ১৯৬১সালে বাঙালি ও সমস্ত অনসমীয়া জাতিগুলির ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের সামনে পড়ে প্রথমে হাইলা কান্দির দাঙ্গায় বাঙালির ঐক্য হিন্দু মুসলমানে বিভাজিত করে।সেই পুরনো খেলা।বন্দুকের ডগায় মুসলমান বাঙালির বৃহদংশ নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে,পিঠ বাঁচাতে অসমীয়া পরিচিতি আঁকড়ে ধরে।তবুও নেলীর ঘটনা এড়ানো যায়নি।আসাম প্রদেশের সাতবোনের সংসার ভিন্ন হয়ে যায়।জন্ম নেয় মেঘালয়,অরুণাচল,মিজোরাম,নাগাল্যাণ্ড-----।বাঙালির সংগে অসমীয়ার যে আকচা আকচিতার প্রতিফলন পড়ল নাগাল্যাণ্ডে।জনগণ নায় মুসলমান বাঙালি আসামে অসমীয়া।কিন্তু নাগাল্যাণ্ডে তাদের জাত খোয়াতে হয়নি।আসামের সাথে যেহেতু জাতিসত্তার প্রশ্নে উজ্জীবিত নাগা জনতার সম্পর্ক আদায় কাঁচকলায়।নাগাল্যাণ্ডের হিন্দু বাঙালির পাশাপাশি মুসলমান বাঙালি ও বাঙালি পরিচয়েই বাঁচতে চেয়েছে।আসামে বন্দুকের ডগায় বাঙালি কমেছে।নাগাল্যাণ্ডে তা হয়নি।২০১১রসর্বশেষ জন গণনায় নাগাল্যাণ্ডে দুটি সমতলবাসীর পরিসংখ্যানে পাচ্ছি---
বাঙালি রাজ্যের জন সংখ্যার৩.৭৩%.মারওয়াড়ি৩.১৩%।মানে বাঙালি স্বমহিমায়।টিআওয়ের সৌজন্যে বাঙালি ওখানে স্বনামে ব্যবসা করে।মারওয়াড়ি রানা গানাম ভাড়া নেয়।
টিআওকে আজকের বাঙালি প্রজন্ম ভুলে গেছে।কলকাতার ক্লাবে এবং ভারতীয় দলে খেলার সুবাদে টিআও বাঙালির প্রতিপক্ষ পাত করতেন স্পষ্টত।নতুবা রোজের বাজারে আলাদা করে নিজের নামে দোকান দেওয়ার এতো খাতির, এতো জামাই আদর বাঙালি পেত কোথায়?
মোককচং, পূর্বদেশে, বাঙালির মরুদ্যান। সাধে বলেছি?
অলমতি বিস্তারেণ। আপনারা চাইলে বারান্তরে।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours