রঞ্জন সেন,লেখক ও সাংবাদিক, কলকাতাঃ
বারবার জোর করে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা দেখে রবীন্দ্রনাথের ‘জয় করে তবু ভয় কেন তোর যায়না’ গানটা মনে পড়ে যায়। হিন্দি ছবি, গান এবং টিভি সিরিয়ালের জনপ্রিয়তার সুবাদে হিন্দি ভাষা এমনিতেই সারাদেশে জনপ্রিয়। দেশের অনেক মানুষ তা খানিকটা বলতে ও বুঝতে পারেন। তবুও বেপরোয়া সেলসম্যানের মত ভাষাটাকে ‘পুশ’ করা হচ্ছে কেন তার কারণ বোঝা কঠিন! এটা একটা ভাষা সন্ত্রাস। দেশজোড়া প্রতিবাদের ফলে আপাতত পিছু হঠলেও অহিন্দিভাষী রাজ্যগুলিতে ভবিষ্যতে আবার হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েই গেল।
২০১১সালের জনগণনার তথ্যের বিকৃত ব্যাখ্যার মাধ্যমে হিন্দির স্বপক্ষে সরকারিভাবে যে যুক্তিজাল বিস্তার করা হচ্ছে তাতে এই ধারণা আরও বদ্ধমূল হচ্ছে। এই জনগণনায় বলা হয়েছে হিন্দি দেশের ৫২কোটি মানুষের মাতৃভাষা। আপাতনিরীহ এই ঘোষণার মধ্যে একটা সাঙ্ঘাতিক ফাঁকিবাজি আছে। ভাষাবিজ্ঞানীদের মতে, এর মধ্যে খুব সুচতুরভাবে ৫কোটি ভোজপুরী ভাষাভাষী মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সংখ্যা বাড়ানোর জন্য টেনে আনা হয়েছে দেশের প্রায় ৬১টি ভাষায় কথা বলা ৯কোটির কাছাকাছি মানুষকে। জনগণনার সুচতুর ব্যাখ্যায় এরা সবাই হয়ে গেছেন হিন্দিভাষী মানুষ। আমরা কেউই হিন্দির বিরোধী নই। হিন্দি দেশের একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রধান ভাষা। কিন্তু তার ব্যাপ্তি ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য এত মিথ্যাচারের কি কোন দরকার ছিল?
‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ, সবকা বিশ্বাস’ কথাটা যারা বলেন তাদের ভাষা নিয়ে এত কুযুক্তির অবতারণা দেখে সন্দেহ জাগে। মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, হরিয়ানা, বিহার, ঝাড়খণ্ড, ছত্তিশগড়ের অধিকাংশ মানুষই হিন্দিতে কথা বলেন না। এসব রাজ্যের বহু জায়গায় আঞ্চলিক ভাষার বিরাট দাপট। এদের সবাইকে ‘হিন্দি’ নামক একটা বিরাট ভাষার ছাতার তলায় নিয়ে আসাটাকে একধরণের আধিপত্যবাদ ছাড়া আর কিছুই বলা যায়না। ইউনেস্কোর মতে ভাষাহত্যা গণহত্যার মতই একটা ব্যাপার। যে জাতীয়তাবাদের প্রসার বিজেপি চাইছে পরিকল্পিত ভাষাহত্যা তো সেই জাতীয়তাবাদের পথেই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে! দেশজুড়ে সৃষ্টি করবে অসন্তোষ। তখন কিন্তু শুধুই সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে এই অবস্থা সামাল দেওয়া যাবেনা।
ভাষা যে কোন মানুষের আত্মপরিচয়।
তা এমন একটা ব্যাপার যা জোর করে কারো ওপরই চাপিয়ে দিতে গেলেই বাঁধবে লড়াই, জন্ম নেবে আরও বৃহত্তর অসন্তোষ। অতীতে আমাদের দেশ এমন বহু ঘটনা দেখেছে, তবুও শাসকদলের মতিগতি বদলায় না। ইউনেস্কোর একটা হিসেবে দেখা যাচ্ছে, লিঙ্গ বৈষম্য, মেয়েদের জন্য শৌচালয় না থাকা, আর্থিক অসাম্য, উপযুক্ত পরিকাঠামোর অভাব, লেখাপড়া শেখার পর চাকরি না পাওয়া ইত্যাদি নানা কারণে ছেলেমেয়েরা স্কুলছুট হচ্ছে। এর পাশাপাশি ভাষা সমস্যাও স্কুলছুটের একটা বড় কারণ বলে অনেক শিক্ষা বিশেষজ্ঞই বলে থাকেন। শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে মাতৃভাষাকে মাতৃদুগ্ধ বলে ধরা হলে একথার সত্যতা মেনে নিতেই হবে।
মাতৃভাষা হল আমরা সবাই যে ভাষা দ্রুত ও সহজে বলতে, লিখতে ও শিখতে পারবো এমন ভাষা। আমাদের দেশের ঔপনিবেশিক শিক্ষা কাঠামোয় এই সহজ ও বাস্তবসন্মত ধারনাটি কখনোই গুরুত্ব পায়নি, তার মাশুল আজও আমরা দিচ্ছি। আমাদের দেশের শিক্ষায়, রাজনীতি ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত ঐতিহাসিকভাবেই বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। শিক্ষার ক্ষেত্রে এ দুটি ব্যাপারের অবশ্যই গুরুত্ব আছে। কিন্তু এ দুটো বিষয় কখনোই শিক্ষার নীতি নির্ধারণ করতে পারেনা। এই সহজ সত্যটা আমরা বুঝতে পারিনি বলেই ইংরেজি সর্বস্বতা এবং হিন্দি সর্বস্বতার দুই অনড় দেওয়ালে ধাক্কা খেতে খেতে ভাষা শিক্ষার ব্যাপারটাকে একটা রাজনীতির অস্ত্রে পরিণত করছি। অহিন্দিভাষী রাজ্যগুলিতে হিন্দির প্রসার করার চেষ্টাটা হয়ে দাঁড়িয়েছে শাসকদলের একটা বাতিক। অবৈজ্ঞানিক ধারণার ওপর গড়ে ওঠা এই বাতিক কিছুদিন পরপরই নতুন করে মাথাচাড়া দেয়।
যারা কোন ভাষা জোর করে অন্য ভাষায় কথা বলা, বেড়ে ওঠা, বেঁচে থাকা মানুষের ওপর চাপিয়ে দিতে চান তারা ভাষার বিকাশের প্রাথমিক শর্তটুকুই মানেন না। মানুষকে অন্য প্রাণীদের থেকে আলাদা করা যায় ভাষার জন্যই। আজ থেকে প্রায় ৭০হাজারের বেশি আগে মানুষের কথ্য ভাষার জন্ম, এমনটাই বলে থাকেন ভাষাবিজ্ঞানীরা। আলোবাতাসের মত ভাষাও একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। ভাষা আমাদের যাবতীয় জ্ঞানের ভিত্তি, তার মাধ্যমে আমরা যাবতীয় জ্ঞান আহরণ করি এবং তাকে ধরে রাখি। মানব মস্তিষ্কের ভাষাজ্ঞান ক্ষমতা, কাজের অভ্যাস, আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি, সাংস্কৃতিক ধরণ সবকিছু মিলেমিশে দীর্ঘদিন ধরে একটা ভাষার নির্মাণ ও ভাঙাগড়া চলতেই থাকে। এই ভাঙাগড়ার ধরনধারণ নদীর স্রোতের থেকেও বিচিত্র।
মুশকিল হল রাজশক্তি ভাষার এই হয়ে ওঠার ব্যাপারটাই বুঝতে চাননা। তারা সবসময় কাজের সুবিধার দোহাই দিয়ে একটা ভাষার ওপর আরেকটা ভাষাকে চাপিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা চালিয়ে যান। রাজনৈতিক আনুকূল্য পেয়ে সময় সময় তা একটু বেশি ডালপালা ছড়ায়, যেমন হচ্ছে এখন। রাজনীতিবিদরা ভুলে যান মেঠো রাজনীতি বা বাহুবলের প্রদর্শনী দিয়ে কোন ভাষাকে দাবিয়ে রাখা নেহাতই এক পাগলামি। এভাবে কোন ভাষার শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করা যায়না। যারা এমন অপচেষ্টা চালাচ্ছেন তাদের সুচিন্তিত যুক্তি এবং দীর্ঘস্থায়ী লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে রুখতে হবে। মানুষকে বোঝাতে হবে ভাষা ব্যাপারটা কখনোই কোন শাসকের দয়া দাক্ষিণ্যের ওপর নির্ভর করেনা। ভাষার ওপর রাজনীতি চাপাতে গেলে ভাষা নয়, হেরে যাবে রাজনীতি।
ব্যাপারটা আরও স্পষ্টভাবে বোঝানো যাক, একটা শিশু যখন স্কুলে যেতে শুরু করে তখনও কিন্তু তার একটা প্রাথমিক ভাষাজ্ঞান থাকে, স্কুল যে ভাষায় শেখাবে তা সে খুব কম হলেও বুঝতে পারে। ভাষা শিক্ষায় প্রাথমিক ভিত্তিটাকে অস্বীকার করে জোর করে কোন ভাষা শেখানো যায়না। বিশেষ করে ভারতের মত দেশ, যেখানে বহু ভাষার কোন আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি নেই সেখানে ভাষা শিক্ষার পরিস্থিতিটা আরও জটিল। ছোটদের চারটে ভাষা শেখাতে গেলে সেই পরিস্থিতি জটিলতর হবে। বাস্তব অবস্থাকে অগ্রাহ্য করে জাতীয়তাবাদ প্রসারের নামে হিন্দি চাপাতে গেলে ভাষা শিক্ষার ব্যাপারটা একটা বিজাতীয় ব্যাপারে পরিণত হবে।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours