সুবীর পাল, এডিটর, দ্য অফনিউস: জন্ম ও মৃত্যু যে অনিবার্য। তবু এই দুই স্মরণীয় মাহেন্দ্রক্ষণের মাঝে থাকে আরও এক বৈচিত্র্য। কি সেই বৈচিত্র্য যা জন্ম মৃত্যুর রামসেতু তৈরিতে মগ্ন? সে যে এক জীবন সরণি। সেখানেই প্রকৃত সংগোপনে লালিত হয় আগুনের পরশমনি ছোঁয়াও প্রাণে, এ জীবন পুণ্য করো। না না এ কোনও দার্শনিক আলোচনা উপস্থাপনা করতে বসিনি। সে ধৃষ্টতাও আমার নেই।
আসলে চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে এক জন্মদিন এক মৃত্যুদিন ও এক মানবিক জীবন সংকল্পের মহামিলন। দুর্গাপুরের কুষ্ঠ কলোনির ক্ষুদে বাসিন্দাদের চোখে মুখে সে কি আলো ঝিকমিক করা চাহনি। কারণ তারাই যে কেউ কুশ কেউ লব কেউ কেউ অপু কেউ বা দুর্গা। এই রবিবারে। বিভূতিভূষণের এই অপু দুর্গা রেল লাইনের পাশে কাশ ফুল দেখতে দে দৌড় দেয় না। সে ফুরসৎ কোথায়? এরা যে দুর্গাপুর ঝাঁ চকচকে শহরের দুয়োরানি এলাকার বাসিন্দা। সরকারি দফতরে খাতায় কলমে এই অপু দুর্গারা নাকি থাকে নবদিগন্তের আবাসনে। হাহাহা।
হিহিহি। ফিচেল হাসি পায় সরকারি কচকচানি শুনলে। বাস্তবে এরা অস্পৃশ্য নির্বাসনের কুষ্ঠ ছাপ ব্র্যান্ডের কচিকাঁচার দল। তাই এখানে নাকি সরকারি খাজনার অর্থের অভাবে পায়ে চলার রাস্তাও কংক্রিট হল না দীর্ঘ ত্রিশ বছরে। কি আর করার? এদের বাবা মা তো আর কোনও দলীয় নেতা হতে পারেন নি যে। আসলে এই বাবা মায়ের মধ্যে ২৪ জন ক্রমাগত ভুগেই চলেছেন লোকচক্ষুর আড়ালে। কিসে ভুগছেন বলা যাবে না। সরকার বাহাদুর রাগ করবেন যে। খুব রাগ। বাবারে বাবা। এটাই আমাদের সামাজিক দর্পণ। যেখানেই সরকারের সাহাব বিবিরা খুব গোঁসা করেন সেখানেই যে অপু দুর্গারা উপেক্ষিত অবহেলিত। তাদের শৈশব সেখানে হারিয়ে যায় অনাদরে দারিদ্রে ও নিত্য বঞ্চনায়। তবু সেই যে বৈচিত্র্য উঁকি মারে সমাজের নীলাকাশ। আজও কিছু বৈচিত্র্য মানবতার রুপোলি রেখা টেনে দেয় অপু দুর্গার অফুরান না পাওয়া কৈশোরে। সরকারের লাল ফিতের লাল চোখ ফুৎকারে লজ্জায় ক্ষণিক বন্ধ হয়ে যায় জন্ম মৃত্যুর ওই যে মাঝে থাকা এক জীবনের মন মাঝারে। প্রকৃতই তাঁর বেঁচে থাকার সাধারন থেকে অতি সাধারন জীবনটাকে বৈচিত্র্য পূর্ণ করে তুলেছেন দুর্গাপুরের বাসিন্দা সীমন্তী দাস। কয়েক দিন আগেই তিনি রবিবার আসতে বলেছিলেন এই শিল্প শহরের কুষ্ঠ কলোনিতে। যাতায়াতের রাস্তা চলাচলের উপযোগী নয় বলে যাবো নাই ভেবেছিলাম। তবু গেলাম এক অজানা মানবিক টানে। আর সেখানে গিয়ে দেখি জন্ম মৃত্যু আর জীবনকে এক অবহেলিত সরণিতে মেলবন্ধন ঘটিয়ে দিয়েছেন এই সীমন্তী দাস। এক কথায় এলাকার সমাজ কর্মী হিসেবে তাঁকে চেনে অনেকেই। মাত্র তিনদিন আগে তাঁর মায়ের মৃত্যু দিবস। সেদিনই তাঁর আবার জন্মদিনও। চাকরি করেন। ছুটি নেই। তাই রবিবারকেই বেছে নেওয়া। সঙ্গে পরিবারের হাতে গোনা পরিজন। গুটিকয়েক বন্ধু। কোনও আড়ম্ভরের তিলমাত্র কিছু নেই। তবু ওই যে সরকারের আদরের দুলাল অপু দুর্গাদের হাতে তুলে দিলেন জামাকাপড়। এলাকাবাসীর জন্য আম পেয়ারা বাতাবি লেবু পেঁপে গাছের চাড়া রোপণের ব্যবস্থাও করলেন নিজে দাঁড়িয়ে থেকে। জনা পঞ্চাশ কিশোর কিশোীদের জন্য করলেন মধ্যাহ্ন ভোজের আয়োজন। নিজেদের পোশাক হাতে পেয়ে ও সবাই মিলে খেতে বসে আজকের দিনে অপু দুর্গা মুহূর্তেই হয়ে গিয়েছিল কেউ অস্কার বিজেতা অথবা কেউ বা বেবি রকস্টার। অন্তত তাদের মুখের চওড়া নিষ্পাপ হাসিটা সেই জানানকেই মর্যাদা দেয়। যদিও এই অতি তস্য ক্ষুদ্র অনুষ্ঠানে মিডিয়ার ক্যামেরার উপস্থিতি না থাকাটাই স্বাভাবিক ছিল। মিডিয়া থাকার কথাও নয়। না কোনও গণমান্য না কোনও নেতাকে সেখানে ডাকা হয়েছিল। তাই টিআরপি যেখানে নেই ক্যামেরাও সেখানে নেই। সীমন্তী দাসের ভ্রুক্ষেপও নেই এইসবে। তার একটাই বক্তব্য, মিডিয়া আর গণ্যমান্যদের জড়ো করা তো আমার উদ্দেশ্য ছিল না। আমার মায়ের মৃত্যু দিবস। কিছুটা মায়ের জন্য মন হুহু করবেই। আবার নিজের জন্মদিন মানেই একটা আলাদা অনুভুতি। এই এলাকার বাচ্চাদের সঙ্গে কিছুটা সময় কাটানো। এদের কথা ভাবলে বেশ কষ্ট হয়। তাই এই দিনটা একটু এদের সঙ্গে কাটানো। এদেরকে নিজের করে ভাবার একটা নিজস্ব অবসর যাপন। সত্যি তাই, এদিন যেন লাল নীল সবুজের মেলা বসেছে কচিকাঁচার হাটে। বাস্তবিকই সীমন্তী দাসের ভাবনা বড্ড অদ্ভুত রকম স্বতন্ত্র। তাই আসল কথাটা বলে দিলেন তাঁর বন্ধু স্বাতী রায়। বন্ধুর ডাকে কলকাতা থেকে এখানে ছুটে আসা। আড্ডার ছলে তিনি বলেন, সীমন্তী অনায়াসেই পার্টি থ্রো
করতেই পারতো। কিন্তু ওঁর মনটাই সবার থেকে আলাদা। তাই নিজের জীবনের মানবিক বোধকে মর্যাদা দিয়ে একটা জন্মদিন ও একটা মৃত্যু দিবসকে এভাবে সার্থক করতে পারে। হ্যাঁ ঠিকই বলেছেন স্বাতী রায়। সীমন্তী দাস প্রকৃতই রবিবার কুষ্ঠ কলোনিতে জন্ম মৃত্যু ও জীবনের এক সীমান্ত রেখা একেবারে সঠিক ভাবেই এঁকে দিলেন। সার্থক হল মানবতা।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours