Fiture
সেঁজুতি ভট্টাচার্যসমাজকর্মী, 
কলকাতাঃ 

(আমারই গেহে পালিত স্নেহে) বহুকাল হল বসন্তদিন এসেছিল এক অতিথি নবীন ......... সেই নবীন অতিথি আজ আমাদের বড় হয়ে ওঠা খোকা(বা খুকু)! এ লেখার চালচিত্রে এবার সেই আমরা যাদের জন্ম পাঁচের  দশকের শেষ পাদ থেকে ছয়ের দশকের মধ্যাহ্ণে।
আমাদের গতায়ু বসন্তের ফুল আমরা বহু যত্নে ফুটিয়েছি।সেই যত্নের মধ্যে লুকোন আছে আমাদের সব না পাওয়ার হাহাকার, অন্যে কে কি পেয়েছে তার ঈর্ষা ও লোভ এবং অবশ্যই তার প্রতি পরতে আমাদের হীনমন্যতা!সে কারণে আমাদের মুখে লেগেই থাকে, আমাদের কালে তো এত কিছু ছিল না, আমরা এত কিছু জানতাম না, ওদের অঢেল টাকা—ওরা খরচ করবে না কেন ...। ওদের সঙ্গে আমাদের তুলনা!কাজের জায়গা নিয়ে বিরক্ত বা পুরস্কৃত  হলে আমরা অক্লেশে বলি, শা... চাকর-বাকরের জীবন... বা বস হেবি খুশি । এবং ইত্যাদি। ভেবে দেখুন তো, আপনার বাবা- মায়ের মুখে এ ধরনের বাক্যবন্ধ ছোটবেলায় ক’বার শুনেছেন ? মনেই করতে পারবেন না! আমাদের এই সদা-তৃষ্ণার্ত  ও ক্ষুব্ধ মানসিকতার পূর্ণ প্রকাশ ঘটেছে  ‘দুধে-ভাতে রাখা সন্তানদের ওপর। আমরা যেমন কোন-কিছুতেই আনন্দিত নই, ঠিক তেমনই আমাদের স্বপ্ন-সন্ততিরাও কোন কিছুতেই নন্দিত নয়......
অথচ, ১। ইংরিজি দ্রুত বলতে না পারা আমারা স্কুল-কলেজে কম নম্বর পেয়েই পাশ করেছি; আর সারা জীবন তার জন্য ভুগেছি(অন্তত আমাদের ধারনা)! ছেলে-মেয়েরা যাতে না ভোগে সে জন্য প্রি-স্কুল থেকেই টিউটর--একেবারে শেষ পর্যন্ত। ফটাফট ইংরিজি বলবে বলে ইংলিশ মিডিয়াম – প্রাণ ওষ্ঠাগত মাইনে, স্কুলাচার (ফেস্ট-বার্থডে-পিকনিক-এক্সকারসান এবং অন্যান্য) সব মিলিয়ে মাস-খরচের এক-তৃতীয়াংশ! তার সঙ্গে দামি খেলনার (বার্বি টু মোবাইল ভায়া কম্পিউটার গেমস )বায়না, সুইমিং বা ক্রিকেটের তালিম এবং অন্যান্য দামি আবদার মিটিয়েছি।যত বড় হয়েছে, আব্দারও তত বেড়েছে –আড়ে ও খরচের বহরে। যতই অসুবিধে হোক না কেন,ওর গায়ে আঁচ লাগতে দিই নি। আর, ওরাও বড়ই ছেলেমানুষ, কিচ্ছু বোঝে নি। আপনার ইস্কুলে পড়ার দিন একবার চট করে মনে করে নিন – দেখবেন, শুধু আধিক্য নয়, আদিখ্যেতার বাড়াবাড়ি।   
অথচ, ২। এরপর, কলেজ এবং প্রোফেশানাল কোর্স পর্ব। সেই ট্র্যাডিশন অব্যাহত। এই সব কিছু করতেই হবে – না হলে চলে না। সেভিংসের বহুলাংশ নির্গত।আমাদের কলেজ-ইউনিভার্সিটি জীবনে আমরা ছাত্র-ছাত্রী পড়িয়ে নিজেদের হাত খরচ চালাতাম।এখন, আমরাই বলে দিয়েছি, ও’সব একেবারে নয়—তুমি শুধু তোমার কেরিয়ারটা নিয়ে ভাব। ওরাও বড়ই ছেলেমানুষ, কিচ্ছু বোঝে নি। – আমাদের ভারি বাধ্য। 

অথচ, ৩। এবার বিবাহ-পর্ব। এখন পুত্র ও কন্যা-দায় সমান-সমান। শুধু বেটি কেনবেটাও বাঁচাও। সে প্রেম বা ঘটকালি যেটাই হক না কেন ! সঙ্গীত-হলদি-ক্যটারার-ব্যাংকোয়েট-রিসেপশান-বিদায়ি-ফার্নিচার-প্রণামী—সব করতে হবে। এরপরও যদি না-পসন্দের দৌরাত্ম্যে রি-ডু করতে হয়, তা হলে তো আর কথাই নেই । আমাদের যুবাবেলায় ছেলেরা বলত, বাপের পয়সায় বিয়ে করব না কি ? এখন বিয়েটা আমার, খরচটা বাপ-মায়ের। পাত্র-পাত্রী নির্বিশেষ।  না, না , শেষ ব্যাচেলরস পার্টি—বিদেশেতে হলেও—খরচটা ভাবী পাত্র বা পাত্রীই করে । বড্ড ছেলেমানুষ না ওরা কিচ্ছু বোঝে না।  
অথচর এই তিন পর্বের প্রতিটিতেই আপনি দুবার করে উপস্থিত। একবার নিজের কালে, দ্বিতীয়বার সন্তান-কবলে। আপনি যা যা করলেন, আপনার বাপ-মায়েরা কি তাই করেছিলেন?জবাব নিষ্প্রয়োজন ।তা হলে আপনি করলেনটা কি? একটা উদাহরণ মনে এল। ইস্কুলে পড়ার দিনে, ২০-২৫ বা জোর ৫০ পয়সার উপরি টিফিনে আমাদের লোভ ছিল হজমি, আলুকাবলি,ফুচকা,ঠোঁট রাঙানো বরফ—এই সব নিষিদ্ধ সুখাদ্যে। এর থেকে বেশির কপাল আমরা করি নি। সেই দুঃখে আমরা এক রাতে আমাদের সন্তানদের মুখে এক সঙ্গে ঠুসে দিয়েছি এই সব সুখাদ্য।তৃষ্ণার আগেই ভেসে গেছে প্রাপ্তির জোয়ারে। সেই আধিক্যের ফলও ফলেছে।
স্কুল থেকে কলেজ হয়ে রোজগেরে জীবনে যতই এগিয়েছি, সংসারে আমাদের দায়িত্বও ততই বেড়েছে। এক দিকে মা-বাবা অন্যদিকে ছেলেমেয়ে। সন্তানের চাহিদা মেটাতে হয়তো ফাঁক পড়েছে মা-বাবার দায়িত্বে, কিন্তু ওদের কোন কমতি হয় নি।আর, ছেলেমেয়েরাও বুঝেছে, পৃথিবী রসাতলে গেলেও তাদের প্রাপ্য তাদের চাইই -- নো কম্প্রমাইজ । আমরাই আড়াল করে রেখেছি ওদের ঔচিত্য বোধকে, অবশ করে দিয়েছি ওদের দায়িত্বজ্ঞান। চিনতে শিখিয়েছি, শুধুই ব্যক্তিস্বার্থ—সংসার সমাজ কোন কিছুর তোয়াক্কা না করে।    
আমারই গেহে পালিত স্নেহে আমদেরই সেই “একটি করে আসা” নবীন অতিথিদের বেশিরভাগই আজ এক নির্বোধ, দায়হীন, স্বার্থ-কাতর প্রজন্ম।শুধুই নিজের সুখ ও কেরিয়ারের কথা ভাবে। যাদের বাপ-মায়েরা কিছুই না শেখা চাকর-বাকর মাত্র। শুধুই যোগানদার – দরকারমাত্র হাজির। ভাবতে কষ্ট হচ্ছে, প্রত্যেকেরই মনে আশা, আমার খোকা/খুকু অন্তত এ রকম মনে করে না!ভাল, ভাল। সময় করে শঙ্করাচার্যের মোহমুদ্গর উল্টে দেখে নেবেন ... 


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours