hospital
 গৌতম ভট্টাচার্য, সমাজকর্মীঃ সম্প্রতি পশ্চিম বাংলায় চিকিৎসক নিগ্রহের ঘটনায় গোটা রাজ্য উত্তাল হয়ে ওঠে। একজন রোগীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সদ্য চিকিৎসক হয়ে ওঠা মেধাবী তরুন পরিবহ তার চিকিৎসক জীবনের প্রারম্ভেই রোগীর পরিজন দ্বারা এই রকম একটি প্রাণঘাতী আক্রমণের শিকার হলে তার প্রতিবাদে রাজ্যের সমগ্র চিকিৎসকবৃন্দ একযোগে এক মঞ্চে উপস্থিত হয়ে জুনিয়র ডাক্তারদের কর্মবিরতিকে সমর্থন করেন। চিকিৎসা জগতের সাম্প্রতিক ইতিহাসে এমন জোটবদ্ধ সামগ্রিক প্রতিবাদের চিত্র প্রায় বিরল। রাজ্যের হাসপাতালগুলিতে দীর্ঘ প্রায় সাতদিনের কর্মবিরতির ফলে সর্বত্র ত্রাহি ত্রাহি রব উঠে গিয়েছিল। যদিও ডাক্তারদের তরফ থেকে জানানো হয়েছিল যে সব হাসপাতালেই চালু ছিল জরুরী পরিষেবা। তবুও এর মধ্যেই বিনা পরিষেবায় মৃত্যু সংক্রান্ত কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে যায় ফলে পরিস্থিতি খানিক টালমাটাল হয়ে ওঠে। যাই হোক শেষ পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রীর আশ্বাস বাণীতে প্রতিবাদীদের জয় এবং ফলশ্রুতিতে মধুরেণ সমাপয়েৎ। সমস্ত হাসপাতালে আবার চিকিৎসা পরিষেবা চালু। রাজ্যের চিকিৎসা ব্যবস্থার এমন বেহাল চিত্র একদিনে হয় নি। বিগত কোনও সরকারই এই জরুরী পরিষেবার তাবৎ উন্নতি নিয়ে ভাবে নি। 
এই মন্তব্যের মধ্যে কোনও ভূল নেই। সরকারী চিকিৎসা ব্যবস্থায় পরিষেবা বিনা পয়সায় হয় তাই তার সামগ্রিক চেহারা দুয়োরাণীর মতই হবে। এটা যেন আকাশবাণী। গ্রামের হেলথ সেন্টার থেকে জেলা হাসপাতাল হয়ে তথাকথিত সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালের অন্তস্থলের গল্প প্রায় একই রকম। দশকের পর দশক ধরে হাসপাতালগুলো রাজনীতির আখড়া হয়ে উঠেছে, খুব পরিকল্পিতভাবে এক শ্রেনীর অসাধু চক্রকে রাজনৈতিক মদত দিয়ে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করা হয়েছে। চতুর্থ শ্রেনীর কর্মচারীরাই হয়ে উঠেছে হাসপাতালের অলিখিত নিয়ামক । অলিখিত লেনদেন আজ আর আড়াল রাখে না। যেন এটাই নিয়ম। এ নিয়ম সকলের জানা। মাথার উপর ক্ষমতার হাত। রুগী এবং তার পরিবার পরিজনদের সামান্য চিকিৎসাটুকু পেতে যে অভাবনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয় তা কোথাও সংবাদ শিরোনামে আসে না। অথচ ভেতরে ভেতরে ক্ষোভ জমা হতে থাকে। প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে বা জেলা হাসপাতাল থেকে রেফারাল কেসগুলি হাসপাতাল থেকে হাসপাতাল ঘুরে বেড়ায়। চিকিৎসা পায় না। মূমুর্ষূ রোগীকে সাথে নিয়ে ঘুরতে থাকা এমন নিম্নবিত্ত পরিবারের ক্রন্দনরত মুখগুলি দেখার সময় কারোর নেই। অথচ মানুষের জন্য তৈরী সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে নির্লজ্জ ভাবে ডায়ালিসিস পাচ্ছে মানুষ নয় ক্ষমতাবানের পোষ্য। ক্ষোভের বারুদ তো জমা হচ্ছে বছরের পর বছর। বিস্ফোরন ঘটেই যায় কখনও কখনও। চিকিৎসকদেরও এই অব্যবস্থা, অপব্যবস্থা এবং হাসপাতালে প্রাপ্ত সীমিত সুযোগ সুবিধার মধ্যেই চিকিৎসা করতে হয়। তার মধ্যেও তারা অসাধ্য সাধন করে চলেছেন বললে অত্যুক্তি হয় না। বহু জটিল অস্ত্রোপচার, জটিল রোগের চিকিৎসা এইসব চিকিৎকেরাই করে চলেছেন সরকারী ব্যবস্থায়। কিন্তু সরকারী বা বেসরকারী সব জায়গায় যেটার চুড়ান্ত অভাব দেখা যায় তা হলো রুগী বা তার পরিজনদের সাথে চিকিৎসকের যোজন দূরত্ব। রুগীর পরিজনদের কাছে রোগ সংক্রান্ত কোনও ব্যাখ্যা না দেওয়া। রুগীর পরিজন চিকিৎসার কি বুঝবে এই অজুহাতে তাদের রাখা হয় ঘোর অন্ধকারে। তারা জানতেও পারে না চিকিৎসার গতিপ্রকৃতি। জিজ্ঞাসা করলে সেবিকা থেকে জুনিয়ার সিনিয়ার সবার কাছ থেকেই অবহেলা এবং চুড়ান্ত অবজ্ঞার একই অভিব্যক্তি ছুটে আসে। চিকিৎসক এবং রুগীর মধ্যে এই আলোকবর্ষ ব্যাপী দূরত্ব ক্ষোভের জন্ম দেয় বৈকি। এরপর রোগীর অবস্থার অবনতি বা মৃত্যু ঘটলে তখন পরিস্থিতি বিগড়ে যাবার সম্ভাবনা যে থাকবে না এমন বলা যায় কি। তুলনা করতে না চাইলেও কথা প্রসঙ্গে এসে পড়ে যে, দক্ষিনের সরকারী বা বেসরকারী যে কোনও চিকিৎসা ব্যবস্থাতেই চিকিৎসকেরা শত রুগীর চিকিৎসার চাপের মধ্যেও চিকিৎসা চলাকালীন যাবতীয় উন্নতি কিংবা অবনতি সম্বন্ধে চিকিৎসা বিজ্ঞানের জটিল ভাষাকে যথা সম্ভব পাশে সরিয়ে রেখে সহজ সরল ব্যাখ্যা দিয়ে রুগীর পরিবারকে মানসিক বল জোগান। সেখানকার একজন চিকিৎসক এই একটি কারণেই রুগীর পরিবারের কাছে স্বজন হয়ে ওঠেন। এরপরে যদি রুগীর খারাপ কিছু ঘটেও যায় তবে তা চিকিৎসার অবহেলার কারণে ঘটেছে একথা রুগীর পরিজনরা বিশ্বাস করেন না। ফলে আগুন জ্বলে না। প্রতিবেশী বিভিন্ন দেশ এবং এই দেশেরই বিভিন্ন রাজ্য থেকে আসার কারনে দক্ষিনের হাসপাতালগুলিতে রুগীর চাপ এই রাজ্যের থেকে কয়েকগুণ বেশী একথা সবাই মানবেন। তবু সেখানকার চিকিৎসকবৃন্দ, সেবিকাবৃন্দ, পরিষেবা সহায়কবৃন্দ এবং তদুপরি কর্তৃপক্ষ সকলেরই মানবিক মুখ স্পষ্ট এবং উজ্জ্বল। এই অভিজ্ঞতা রাজ্যবাসীর অনেকেরই আছে। সুতরাং এই রাজ্যের চিকিৎসা ব্যবস্থার সামগ্রিক চিত্রের উন্নতি করার সদিচ্ছা এবং দায় একমাত্র সরকারের। সরকারী হাসপাতাল মানেই বিনাপয়সায় যা পাওয়া যায় তাই অনেক এবং তাতে মৃত্যুও অবহেলার এক উপহার মাত্র, হাসপাতালের দেওয়াল থেকে, অলিন্দ থেকে রাজনৈতিক ভাবে এই মানসিকতার অবসান ঘটানো প্রয়োজন, যদিও সে কাজ অতীব কঠিন কিন্তু অসম্ভব নয়। রাজনীতির আগ্রাসন সরিয়ে হাসপাতালের সামগ্রিক চেহারায় আস্থার বাতাবরণ ফিরলে অপ্রীতিকর ঘটনার সংখ্যা অবশ্যই কমবে। চিকিৎসকেরা যদি সম্মীলিত ভাবে রুগীর পরিজনদেরকে অবজ্ঞা, অবহেলা না করে তাদের সাথে মানবিক আচরণ করেন, তাদের স্বজন বন্ধু হয়ে ওঠেন তাহলে এই সীমিত সুযোগ সুবিধার মধ্যেও হাসপাতালে সুস্থ বাতাবরণ বজায় থাকে। একজন চিকিৎসকের ইতিবাচক ব্যবহার রুগীর রোগজনিত যন্ত্রণা এবং রুগীর পরিবারের উদ্বেগ যে উপশম করে একথা চিকিৎসা বিজ্ঞানেই আছে। জানেন সবাই। একজন সাধারণ মানুষ চিকিৎসকের কাছে এই বিশ্বাস আর আস্থাই প্রত্যাশা করে। তাদের আর কোনও অভিযোগ থাকে না। হাসপাতালে চিকিৎসকদের নিরাপত্তার প্রশ্নটি যেমন জরুরী তেমনি চিকিৎসকেরা নিজেরাই পারেন তাদের মানবিক ব্যবহারের মাধ্যমে হাসপাতালের ভেতরে নিরাপত্তার পরিমন্ডল তৈরী করতে। চিকিৎসার গাফিলতিতে মৃত্যু এমন অভিযোগের তুষাগ্নি জ্বলার অবকাশই পাবে না যদি রুগীর পরিবার চিকিৎসকের মধ্যে পাশে দাঁড়ানো স্বজন বন্ধুর উষ্ণতা অনুভব করেন। 

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours