School
গৌতম ভট্টাচার্য, সমাজকর্মীঃ     পরিবর্ধিত, পরিমার্জিত প্রতিবন্ধী সুরক্ষা আইন ২০১৬ অনুযায়ী সমস্ত মাধ্যমের বিদ্যালয়গুলি এখন থেকে সব ধরনের শিশুদের ভর্তি করবে। ওই আইনে যা মূলতঃ inclusive education নামে উল্লিখিত হয়েছে। আপাত দৃষ্টিতে নিশ্চিত সাধু প্রস্তাব। শিক্ষার অধিকার সকলের। সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে সাথে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের ( সেরিব্রাল পালসি, অটিজম, ডাউন সিনড্রোম, মানসিক প্রতিবন্ধী এবং সমষ্টি প্রতিবন্ধী) উন্নতি এবং স্বনির্ভর করে তুলতে তাদের কাছেও শিক্ষার সুযোগ পৌঁছে দেওয়া অবশ্য কর্তব্য। কিন্তু এই ব্যবস্থা আপাত ভাবে সৎ হলেও মূলতঃ যে জায়গাকে অনালোকিত রেখে এই নির্দেশিকা জারি করা হলো তা হলো, সাধারণ বিদ্যালয়ের পরিকাঠামো বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের উপযোগী কিনা সে বিষয়ে পরিস্কার চিত্র এখানে তুলে ধরা নেই। বিশেষ শিশুদের চাহিদাই যেহেতু বিশেষ ধরণের তাই সাধারণ বিদ্যালয়ের একই শ্রেণী কক্ষে তাদেরকে রেখে অন্যান্য সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে সাধারণ পাঠক্রম শেখানোর কাজটা কঠিন শুধু নয় প্রায় অসম্ভব। বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের বুদ্ধিবৃত্তি সাধারণ মানের থেকে কম, ব্যবহারের অসংলগ্নতা, অতি চঞ্চলতা, অনেক ক্ষেত্রেই সুস্পষ্ট , কারোর কারোর শারীরিক অক্ষমতাও দৃশ্যমান। এই সমস্ত শিশুদের সাধারণ শিক্ষা পাওয়ার উপযোগী করে তুলতে নির্দিষ্ট এক দীর্ঘ  প্রশিক্ষণের পথ পেরোতে হয়। সেই প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত শিক্ষক ও শিক্ষিকা সাধারণ বিদ্যালয়ে অপ্রতুল বা নেই। যদিও CBSE পরিচালিত ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলিতে বিশেষ প্রশিক্ষক নিয়োগ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তবে সেই নিয়োগের ক্ষীন সংখ্যা কেবলমাত্র নিয়মের অনুশাসনের অনুসারি। বিশেষ ছাত্র ছাত্রীদের ক্রমবর্ধমান সংখ্যার আনুপাতিক কখনও নয়। এর বাইরে পড়ে রইল বহু স্কুল যেখানে কোনো প্রশিক্ষক নেই। ফলে এই নতুন ব্যবস্থায় শিশুদের চরম ভোগান্তি। বিশেষ শিশুদের সাধারণ শিক্ষা প্রণালী গ্রহণ করতে না পারা এবং ক্রমশঃ পিছিয়ে পড়ার সমস্যা চিহ্নিত করে তার সদুত্তর তৈরীর কোনও সঠিক নকশা তৈরির অভিজ্ঞতা শিক্ষক শিক্ষিকাদের না থাকার ফলে প্রায় প্রতিদিনই বিদ্যালয়ের শিক্ষক শিক্ষিকাদের সাথে অভিভাবকদের অভিযোগ পাল্টা অভিযোগের ফিরিস্তি চলতে থাকে। অভিভাবকরা বুঝতে পারেন না কেন তাদের সন্তান পিছিয়ে পড়ছে, কেন তাদের সন্তানের মধ্যে তীব্র ব্যবহারিক সমস্যা তৈরি হচ্ছে, অতিচঞলতা বাড়ছে, কেন তাদের সন্তান ক্রমশঃ স্কুল বিমুখ হয়ে পড়ছে। শিক্ষক শিক্ষিকারাও বিভ্রান্ত এই ধরনের ব্যতিক্রমী বিশেষ শিশুদের সাধারণ শিক্ষাক্রম বুঝিয়ে দিতে। অভিভাবকদের প্রশ্নের জবাব দিতে তারাও অপ্রস্তুত হয়ে পড়ছেন।  ফলে বিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে নিয়ত এক বিষম অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। সব বুঝেও বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিরুপায় অবস্থান নিতে বাধ্য হচ্ছেন। অভিভাবকরা সঠিক পরামর্শ না পেয়ে আরও বিভ্রান্ত ও অসহায় হয়ে পড়ছেন। আবার এই সব বিশেষ শিশুদের আচরনগত নানান সমস্যার কারণে অন্যান্য স্বাভাবিক শিশুর অভিভাবকের হাজারো অভিযোগ বিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের কাছে জমা হতে থাকে। সচেতনতার অভাবে স্বাভাবিক ভাবেই দুই ধরনের অভিভাবকদের মধ্যে এক বিবাদমান আবহাওয়া সৃষ্টি হয়। যা বিদ্যালয়ের দৈনন্দিন পঠনপাঠনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।  এই সমস্ত ভিন্নভাবে সক্ষম শিশুদের মধ্যে যারা বুদ্ধাঙ্কের বিচারে সাধারণ ভাবে সামান্য উপরের দিকে তাদের অ্যাকাডেমিক শিক্ষা দেবার পদ্ধতি এবং পাঠক্রম একদম ভিন্ন। NIOS (National Institute of Open School, Delhi ) নির্দেশিত পাঠক্রম এই বিশেষ শিশুদের উপযোগী করে তৈরি করা। পরীক্ষা দেবার পদ্ধতিও খানিকটা পৃথক। পরীক্ষা শেষে প্রাপ্ত শংসাপত্রের মূল্যমান এবং সাধারণ পাঠক্রম শেষ করে প্রাপ্ত শংসাপত্রের মূল্যমান এক। তবে শিশুদের এই শিক্ষা প্রদানের জন্যেও বিশেষ প্রশিক্ষক প্রয়োজন। আরও প্রয়োজন এই শিক্ষাক্রম সম্বন্ধে অভিভাবক এবং শিক্ষক- শিক্ষিকাদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর। সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে বিদ্যালয়গুলিতে ধারাবাহিক ভাবে এই সচেতনতা শিবির চালু করা উচিত একমাত্র বিশেষ শিশুদের স্বার্থে। তবে সর্বাগ্রে এই inclusive education এর ধারণার খানিক বদল দরকার।
বিশেষ শিশুদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলিতে যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় তার বেশিরভাগই বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে। এই বিশেষ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলিই যদি শহর বা গ্রামের বিভিন্ন প্রান্তে না হয়ে পৃথক ভাবে সাধারণ বিদ্যালয়ের পরিকাঠামোর মধ্যেই তৈরি করা হয় তবে একটা বড় উদ্দেশ্য সফল হয়। সমস্ত ধরনের শিশুরা একটি বিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রী হওয়ার কারণে তারা পরস্পর পরস্পরের প্রতি সমানুভবি হয়, একসাথে প্রবেশ প্রস্থান, খেলাধুলা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করার ফলে একে অপরের অসুবিধার প্রতি সচেতন হয়ে ওঠে। বিশেষ শিশুদের প্রতি অন্যান্য শিশুদের এই সমানুভবি মানসিকতা যদি শৈশবেই গড়ে ওঠে তবে সমাজে একটা সচেতন প্রজন্ম তৈরি হয়ে যাবার সদর্থক সম্ভাবনা তৈরি হয়। পরোক্ষ ভাবে অভিভাবকদের মধ্যেও আন্তরিক এবং মানবিক সম্পর্ক গড়ে উঠবে একথা নিশ্চিত করে বলা যায়। অথচ একই বিদ্যালয়ের দুটি ভিন্ন ভবনে দু রকম শিক্ষা ব্যবস্থা চলতে থাকে বলে পঠনপাঠন নিয়েও কোনও সমস্যা তৈরি হয় না। এই ধরনের বিদ্যালয় সংখ্যায় কম হলেও ভারতের বিভিন্ন জায়গায় আছে। শিক্ষা সংক্রান্ত এই বিশেষ ব্যতিক্রমী বিষয়কে নিয়ে সকলেরই ভাবা প্রয়োজন।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours