Probondho
ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়, লেখিকা কলকাতাঃ


নারীশক্তির উত্থানের যুগে যুগে মেয়ে পাইলট,পুলিশ অফিসার,কুস্তীগীর,ট্যাক্সিচালক,টেনিস প্লেয়ার,মহাকাশচারী দের পাশাপাশি আরেক ধাঁচের গ্ল্যামার কুইনদের গল্প সনাতন ভারতবর্ষের ইতিহাসে আজো জ্বলজ্বলে। তখন যুগটা কিন্তু ছিল পিতৃতান্ত্রিক। অথচ মহাকাব্যের পাতায় পাতায় এই মায়েরা সব এক সে বড় কর এক গ্লিটারেটি। সিঙ্গল মাদার আমাদের দেশে নতুন কনসেপ্ট নয়। চাকচিক্যময় মাদারহুডের বিজ্ঞাপনে মোটেও বেমানান নয় এরা। আমাদের দেশের কিংবদন্তীর দলিল বলেছে এদের কথা। নিষ্ঠুর পিতাদের কথাও। আবার সেইসঙ্গে বলেছে একক পিতাদের কথাও।

রামায়ণের গর্ভিণী সীতাকে লক্ষ্মণের সঙ্গে বাল্মিকীর আশ্রমে পাঠিয়ে দিলেন রাম আর তারপর লব-কুশের জন্ম এবং তাদের লালন পালন সীতা একা হাতে করেছেন। পরে রামের সঙ্গে এই দুই বালক যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে রীতিমত কনফ্রন্ট করেছে। সেও আমাদের অজানা নয়। সেখানেই একক মা সীতার চারিত্রিক দৃঢ়তা জিতিয়ে দিয়েছে তাঁকে। টপকে গেছে সীতার মাতৃত্ব রামের পিতৃত্ব কে।
রাজা দুষ্যন্তের সঙ্গে গন্ধর্বমতে বিয়ে করে শকুন্তলার গর্ভের পুত্র ভরত লালিত হয়েছিল কণ্বমুনির আশ্রমেই। দুষ্যন্ত এই পুত্রকে অস্বীকার করেছিলেন। সেই অর্থে শকুন্তলাও একক মায়ের স্নেহ দিয়ে পালন করেছিল ভারতবর্ষের এই ভবিষ্যৎ রাজা কে। দূষ্যন্তের অবাঞ্ছিত পিতৃত্ব তাঁকে হারিয়ে দিলেও পিতৃতান্ত্রিক সমাজ তাঁর পুত্র ভরত কে রাজত্বের অধিকার থেকে বঞ্চিত করেনি।
এমন আরেক একক মা ছিলেন জবালা । বহু পুরুষের দ্বারা ভোগ্যা এই স্ত্রীলোকের গর্ভের সন্তান সত্যকাম। পিতৃপরিচয় অজানা। কৈশোরে উপনীত সত্যকাম কে যখন তার মা গৌতমমুনির গৃহে অধ্যয়নে পাঠালেন তখন মুনি দেখামাত্র‌ই নাম এবং পিতার পরিচয়গোত্র জানতে চাইলেন। সত্যকাম ম'কে এসে জানাল। জবালা দর্পের সঙ্গে ঋষির গৃহে গিয়ে জানালেন তিনি‌ই শিশুর একমাত্র অভিভাবক। তাঁর পরিচয়েই শিশু বড় হয়েছে । জবালার পুত্র‌ই তার একমাত্র পরিচয়। তাই আজ থেকে জবালার পুত্রের নাম জবালী সত্যকাম । এমন উত্তরে মুনি যারপরনাই খুশি হয়ে সত্যকামের অধ্যয়নের ভার নিলেন এবং এই পুত্র বিদ্যায় বুদ্ধিতে জ্ঞানের শিখরে উঠলেন। গৌণ হয়েছিল সত্যকামের পিতৃ পরিচয়।
মহাভারতের আদিপর্বে এলেন আরেক তেজোদৃপ্ত আদিবাসী রমণী। পাণ্ডবদের বনবাস পর্বে অরণ্যের মধ্যে ভীমের দেখা তার সঙ্গে। তার ভাই হিড়িম্ব বোন হিড়িম্বা কে পাঠাল পাণ্ডবদের বধ করে তাদের মাংস নিয়ে আসার জন্য। হিড়িম্ব ভক্ষণ করবে সেই নরমাংস।
দশাশয়ী,পেশীবহুল সুদর্শণ ভীমসেন কে দেখা মাত্র‌ই হিড়িম্বা প্রেমে পড়লেন। আলাপ জমে উঠল। সংহার করা দূরের কথা সে কুটিরে গিয়ে পাণ্ডবভ্রাতা এবং মাতা কুন্তীর দর্শণ পেয়ে যেন বরতে গেল। আহাভীমের মত যদি স্বামী পায় সে!
শুধুমাত্র নিখাদ ভালবাসা দিয়ে পাণ্ডবদের সতর্ক করল আসন্ন বিপদের হাত থেকে। আর জানাল তার ভাইয়ের দুরভিসন্ধি। আর যেনতেনপ্রকারেণ সে তাদের হিড়িম্বের হাত থেকে রক্ষা করবে বলে কথা দিল। অগত্যা ভীম সহ বাকীরাও মোহিত এই আদিবাসী কন্যার ব্যাবহারে। রাজমাতা কুন্তীও সে যাত্রায় খুশি পুত্রনাশের আশঙ্কায় ছেদ পড়ল বলে। এদিকে হিড়িম্ব এই ঘটনাকে সমগ্র রাক্ষসকুলের চূড়ান্ত অপমান বলে মনে করল। সে দৌড়ে গিয়ে ভীম কে আক্রমণ করল কিন্তু ভীমের শক্তির কাছে পরাজিত হয়ে প্রবল যুদ্ধে তার প্রাণ গেল। এরপর যথারীতি হিড়িম্বা ভীমকে বিবাহের উদ্দেশ্যে পাণ্ডবদের অণুসরণ করে ও তাদের বিয়ে হয়। রাজমাতা কুন্তীর রাজনৈতিক চাল ছিল এটাই। আমাদের গুষ্টিকে রাক্ষসদের হাত থেকে বাঁচিয়েছে এই মেয়ে অতএব বিয়েটা দেওয়াই যায়। এই মেয়ে অপরিচিত কিন্তু শুধুই ভীমের প্রেমে পড়ে ভীমকে নয় তাদের সপরিবারে বাঁচিয়েছে,উপকারে লেগেছে অতএব সে লক্ষ্মী বৌমা। উভয়েই উভয়ের প্রতি সে যাত্রায় সদয় এবং যত্নশীল। এই অবধি ঠিকঠাক চলছিল।

কুম্তী বললেন দেখ ভীম আমাদের দুঃসময়। কৌরবেরা অনেক বেশী বলীয়ান। অতএব হিড়িম্বার গর্ভে সন্তান আসুক। সেও হবে তোমার মত বলশালী আর ভবিষ্যত যুদ্ধে তোমার সহায় হবে ঐ পুত্র। যথাসময়ে ভীমের ঔরসে হিড়িম্বার এক পুত্র হল। নাম ঘটোত্কচ। ঘটের ন্যায় মাথার গড়ন যার ।
দূরদর্শী কুন্তীর রাষ্ট্রনীতি আর কে বোঝেহিড়িম্বাকে গ্রহণযোগ্যতার পেছনে এ ছিল তার জোরদার রাজনৈতিক চাল। হিড়িম্বার এহেন একটি পুত্রের জন্মে সবকিছু ঘুরে গেল। এমন এক ছেলে রাজ পরিবারে থাকলে কানাঘুষো চলতেই থাকবে। একে তো অনার্য উপজাতি এক রাক্ষুসী এই ছেলের মা। তারপর দুর্যোধন সকলের বড়। তার এখনো বিয়েই হল না আর তার আগেই ভীমের ছেলে জন্মে গেছে... ইত্যাদি ইত্যাদি। ভবিষ্যতে রাজ সিংহাসনের দাবীদার হতে পারে এই অনার্য পুত্র। অতএব তাকে তার মায়ের সঙ্গে থাকতে দেওয়া হোক। সপরিবারে মোটেও নয়। অরণ্যবাসী অনার্য কন্যা তার অসুন্দর পুত্র নিয়ে অরণ্যেই ফিরে যাক। এই ছিল রাণীমার বিধান। আর মধ্যম পাণ্ডব ভীম সুড়সুড় করে মায়ের অনুগত হয়ে রইলেন। ভীমের পিতৃত্বের বাণী নীরব হল।

হয়ত কুন্তী ভয় পেয়েছিলেন যে পাণ্ডব কুলের প্রথম রাজবধূ হয়ে হিড়িম্বা যদি রাজমহিষীর পদ অভিষিক্ত করতে চায় অথবা তার পুত্র ঘটোত্কচ কে রাজা করতে চায়।
আর দ্রৌপদীর সঙ্গে তার সপত্নী হিড়িম্বার সম্পর্ক জোড়া লাগেনি তা আমরা আগেই দেখলাম তাই দ্রৌপদীর কারণেও বুঝি কলহ এড়াতে এই পন্থা বেছে নিলেন তাঁরা। অতএব হিড়িম্বা একক মাতা হয়েই রয়ে গেলেন মহাভারতে কাব্যে উপেক্ষিতার মত। আর ভীম বাবা হয়েও সেদিন মুখে কুলুপ আঁটলেন। আবার এই ভীম যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের সময় নিজের পুত্র কে দরকার মত ব্যাবহার করলেন।
উপকারীর উপকার মনে রাখেনি মহাভারত। পুত্রের মৃত্যুর পর হিড়িম্বাকেও কেউ হাজির করেনি আর। ঘটোত্কচের মৃত্যুর জন্য কেউ চোখের জল ফেলেনি। ঠিক যেমন হিড়িম্বার জন্যেও কেউ বিন্দুমাত্র ভাবেনি। সহজ সরল প্রেমের বিনিময়ে একদিন এই অনার্য স্ত্রীলোক পাণ্ডবদের প্রাণ বাঁচিয়েছিল।কিন্তু কি হল এই একক মা হয়ে তার বেঁচে থেকেসারা জীবন যার জন্য পড়ে রইল জংগল মহল,একার সংসারে নিজের সঙ্গে নিজের টানাপোড়েন । পুরুষ বর্জিত জীবনে একা হাতে লালন করলেন ভীমের পুত্র ঘটোত্কচে কে। নিজের ভাগ্য নিজেই জয় করলেন তিনি। নিজের জন্য যার বেঁচে রইল না একফোঁটা স্বপ্ন কিম্বা চকিতে জ্বলে উঠল না একবিন্দু আশার আলো।মহাভারতের সব কটি নারী চরিত্রের মধ্যে বিশুদ্ধতম এবং নিঃস্বার্থ ভালবাসার আদর্শ স্বরূপ হয়ে বেঁচে রইলেন স্বাধীন জেনানা হিড়িম্বা হয়ে।কে জানে কথাকার ব্যাসদেব হয়ত দ্রৌপদী কেই মহান করতে চেয়েছিলেন তাই হিড়িম্বা থেকে গেল ব্রাত্য। বাবাগিরি না ফলিয়েও ভীম হয়ে গেলেন মহান। বংশের প্রথম সন্তান হয়েও তাঁর পুত্র ঘটতকচের রাজত্ব পাওয়া তো দূরের কথা সে ডিস্ক্রিমিনেটেড হয়েই রইল। আর সুযোগ বুঝে তাকে কাজে লাগানো হল। কোথায় গেল মহাভারতের কাহিনীকার,আদর্শবান রাজা,কূটনৈতিক,বিদূষক,যুক্তিবাদীদের বাক্যবাণকেন সইলেন তারা এই অনাচার?

আর সেই একক পিতা ভরদ্বাজ মুনিসমুদ্রস্নানে গিয়ে অপ্সরা ঘৃতাচীর রূপ দেখে কামমোহিত হয়ে বীর্যস্খলন হয়েছিল যাঁরসেই বীর্য একটি দ্রোণ বা কলসের মধ্যে সংরক্ষণ করে যে পুত্রের জন্ম হয়েছিল সে তো আমাদের পরিচিত বীর দ্রোণ। যদি ধরেই নি কারোর গর্ভে প্রতিস্থাপিত হয়েছিল মুনির এই দেহরসঠিক আজকের আইভিএফ এর মত অথবা সারোগেট মাদারের দ্বারা কিম্বা টেষ্টটিউব শিশু জন্মের মত তবে তো বলতে হয় শুধু একক পিতৃত্ব বা ফাদারহুড এনজয় করার জন্য‌ অনেক পুরুষ যে আজ এই পন্থায় বাবা হচ্ছেনতাও আমাদের দেশে নতুন নয় । অতবড় বীর দ্রোণের বাবাও ভরদ্বাজ মুনিও সেই অর্থে বিবাহ পন্থায় না গিয়ে একক পিতা। আরও এমন হয়ত কতজন আছেন সে নিয়ে ভাবব পরে কোন একসময়।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours