Politics
প্রতিম বসু, সিনিওর জার্নালিস্ট ও লেখক, কলকাতাঃ বাংলায় একটা প্রবাদ আছে - যা রটে, তার কিছু বটে। এই যেমন ধরা যেতেই পারে সাংবাদিকতার প্রসঙ্গে কত লোকের কত কথা। আমার মত একাংশ সাংবাদিক সেই রটনার সপক্ষে বহু ক্ষেত্রে কথাও বলছেন। মাত্র দুদিন আগেই টিভি সাংবাদিক, অঞ্জনা ওম কাশ্যপ, হাসপাতালে প্রবেশ করে ডাক্তার, নার্সকে পুলিশের মত জেরা করছে, আর জাজের মত অর্ডার দিচ্ছে, সে বলতে কিন্তু পিছিয়ে আসেননি। কিন্তু ডাক্তাররা, নিজের জাতের গুষ্টির, তুষ্টি করছে এমন পোস্ট আপনাদের কজনের চোখে পড়েছে? লোকে যে ডাক্তার (আর উকিল) কে কসাই মনে করে – এনিয়ে খুব একটা বলতে দেখেছেন কি? তাহলে সত্যি কি সাংবাদিকের ক্ষেত্রে রটনার সত্যতা আছে আর ডাক্তারের ক্ষেত্রে না? আমি বিশ্বাস করিনা সাংবাদিকের কাজ জগত উদ্ধার করা। ওটা ওঁচাটে দর্শক আর ভুল টিভি সাংবাদিকতার ফসল। টিভির বুমটা বন্দুক নয়, তার ‘ক্ষমতার উৎস’ হবার দরকার নেই। মুশকিল হল সাধারন এবং অ-সাধারন সবরকম মানুষ ওটার ভুল ব্যবহারে উৎসাহ দেন। তাতেই চ্যানেলের উৎসাহ বৃদ্ধি পায়। এবং সেক্ষেত্রে আমার বিরুদ্ধতা শোভা পায় না। কারন আমার ছেলেকে দামী স্কুল, কলেজে পড়াতে লাগে, অসুখে পড়লে ডাক্তারদের ফিজ আর তারা যেসব ডায়াগ্নোস্টিক সেন্টার থেকে পেশেন্ট প্রতি টাকা পান, সেখানে মোটা বিল দিতে হয়। আমারও ঘরে এসি লাগে। আর উঞ্ছবৃত্তি করে আমি খেতে পারি না। কিন্তু এত কিছু সত্বেও, আমরা অনেকেই আম-পাবলিকের মাঝে আত্মসমালোচনা করি। উল্টোটা দেখুন। কলকাতা শহরে হাতে গোনা কিছু ডাক্তার, আর জানা মতে তিনটে ডায়াগনোস্টিক সেন্টার বাদ দিলে, বাকি পুরোটাই ব্যবসা। টেস্ট করালে, নার্সিং হোম বা বেসরকারি হাসপাতালে রেফার করলেই গরমাগরম টাকা। নাম করে করে বলে দিতে পারি, কারন খুব ভালো কিছু ডাক্তার বন্ধু আছে আমার। এতেই শেষ না। এরপর আছে ফার্মা কোম্পানি, হারটের স্টেন্ট কোম্পানি, যন্ত্র বেচা কোম্পানি নেই? পাইয়ে দেবার নানা উপায় আছে, ওই যে এত কনফারেন্স হয়, ওগুলো কি সব বিদ্যা অর্জনের জন্য? ডাক্তার ভগবান-টগবান না। যখন টেকনোলজি ছিল না, ম্যালেরিয়ায় পিলে ফুলে যেত আর মা হতে গিয়ে হাজারে-হাজারে মরত, তখন অতিপ্রাকৃত শক্তির উপর বিশ্বাস করা ছাড়া উপায় ছিল না। ডাক্তার ছিলেন তার প্রতিভূ। এখন আলাদা গল্প। আরো অনেক জিনিসের মতই, ডাক্তারি অসম্ভব রকম টেকনোলজি আর টিম নির্ভর। আর সেই টেকনোলজি বছরে বছরে উথালপাথাল বদলায়। ভগবান ছাড়া আর কোন 'ভগবান' যদি থাকেন সেটা ওই টেকনোলজিওয়ালারা। বেশিরভাগ ডাক্তারের ক্ষেত্রেই টেকনোলজির এই গতির সঙ্গে তাল রাখা মুশকিল। (এটা সব পেশার ক্ষেত্রেই সত্য।) তাই রোগ-নির্ণয়ে বা উপশমে তাদের ভুমিকাও আগের থেকে অনেক কমে গেছে। আরো কমবে। এর বাইরে সংখায় কম, একদল পড়ুয়া ডাক্তার আছেন, যেমন সব পেশায় থাকে, তারা টেকনোলজির সঙ্গে বা আগে দৌড়ন। সুভাষ মুখারজি এরকম ডাক্তার ছিলেন। আর তাকে অন্য ডাক্তাররাই কিন্তু হ্যাটা করেছিল, পলিটিশিয়ান আর ব্যুরোক্র্যাট রা না। এরা আগেও কল্কে পেতেন না, এখনও পান না। হ্যাটারা সংখ্যায় বহুগুন। মিডিয়াতেও তাদেরই নাম বেরোয়। না বেরোলে, চাকরি নিয়ে টানাটানি করে দেবেন, এমন ক্ষমতা। সাধারন ভাবে, সরকারি হাসপাতাল ছেড়ে দিন। ওখানে টিম-ওয়ার্ক দুরের কথা, ওয়ার্কের পরিবেশটাই নেই। যন্ত্র থাকলে তাতে রাজনীতিবিদের কুকুরের চিকিৎসার উদ্যোগও নেওয়া হয়। আমার এক বন্ধু প্লাস্টিক-সার্জেন, সরকারি হাসপাতালে প্রফেসরি ছেড়ে প্রাইভেট প্রাক্টিসে এসেছেন নতুন নতুন সার্জারির অভিজ্ঞতার জন্যে। সরকারি হাসপাতালে, প্রয়োজনীয় সুতোটাও পান নি। কারন সরকারি হাসপাতালের রোগী আসে বাসন্তী থেকে, তার গায়ে কোন দাগ কতটা রইল, তাতে কে মাথা ঘামায়? কলকাতার বেসরকারিও আহামরি না একেবারেই। এ যুগটা আসলে স্পেশাইলেজশনের। আর স্পেলাইজেশন মানে থেমে থাকা না। রোজ এগোতে হয়। আমরা যে যা পেশায় আছি এটা সবার ক্ষেত্রেই সত্য। আমি লিখি, তাই হয়ত নেট থেকে পড়ে নিজেকে এগিয়ে রাখতে পারব। কিন্তু ডাক্তারের উপযুক্ত হাসপাতাল-ব্যবস্থা দরকার হয়। আর সেই হাসপাতালে ক্রমাগত বিনিয়গের প্রয়োজন হয়। এক কলকাতার ডাক্তার বন্ধু রোবটিক্স ব্যবহার করে, বাচ্চাদের শ্বাসনালীর অপারেশনে হাত পাকিয়েছিলেন। এখন আর কাজ পান না। মাঝে মাঝে বম্বে গিয়ে হাতটাকে সচল রাখার চেষ্টা করেন। কলকাতার কোন হাসপাতাল এত বিনিয়োগে রাজী নয়। জানেন কিনা জানি না। কলকাতার বেশিরভাগ সুপার-স্পেশালিটিতে যুগোপযোগী ব্যবস্থা নেই। কারন ডিমান্ড কম। যাদের একটু রেস্ত আছে, তারা যেমন সরকারি স্কুল বা হাসপাতালে যায় না; ঠিক তেমনিই যাদের আরেকটু রেস্ত আছে তারা দিল্লি, হায়দ্রাবাদ, চেন্নাই চলে যায়। আর খুব সত্যি কথাটা হল, ওখানে চিকিৎসাটা কলকাতার তুলনায় অনেক সৎ ভাবে হয়। কারন, ওখানে চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান নির্ভর। বাস্তবে কলকাতার চিকিৎসা ব্যবস্থা চালান ডাক্তারেরা। আমার এক ভাই কর্মসুত্রে দক্ষিনে থাকত। সেখানের একটি ছোট শহরে, তুলনামুলকভাবে অনামী এক হাসপাতালে মেয়ের জটিল রোগ ধরা পড়েছিল। বন্ধুর দক্ষিনের থেকে কলকাতায় বিশ্বাস বেশি। সে একজন নামকরা শিশুরোগ বিশারদের কাছে দেখাবে বলে মনস্থির করে। ঘটনা হল, আমিও একবার বন্ধু-শিশুরোগ বিশেষজ্ঞের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে সেই বড় ব্রান্ডের কাছে ছেলেকে নিয়ে গেছিলাম। ডাক্তার মানুষের মনটাও ভালো বোঝেন। আমার যে মোটা টাকার ইন্স্যুরেন্স আছে, আর ফুটো-পকেট নয় সেটা চট করে বুঝে ফেললেন। তারপর দুচারতে রোগের নাম বললেন তাতে আমার পিলে চমকে গেল। এবং আমি আরও ব্যা-ব্যা করে আত্মসমর্পণ করলাম। এবং সঙ্গে সঙ্গেই নামী নার্সিংহোমে রেফার। যেভাবেই হোক বাইরে বেরিয়ে আমার বুদ্ধিসুদ্ধি ফিরে আসে। আমি ডাক্তার বন্ধুর পদপ্রান্তে ডাইভ দেই। এবং আমার ছেলে ফটাফট সুস্থও হয়ে যায়। বন্ধু ও তার স্ত্রী (সেও ডাক্তার) অবশ্য গোটা দুই রাত পড়াশুনো করেই কাটিয়েছিল। এই অভিজ্ঞতা থেকেই ভাইটিকেও আগে বন্ধু-ডাক্তারের কাছে পাঠাই। বন্ধু সব কাগজপত্র দেখেশুনে দুটো কথা বলেছিলঃ দক্ষিনের অনামা হাসপাতালটি যে রোগনির্ণয় করেছে তা সঠিক এবং সেটা বেশ আশ্চর্যের ব্যাপার কারন, ওই রোগ এত খুব কম মানুষের হয়, যে তা নিয়ে চর্চা নেই বললেই চলে। দ্বিতীয়তঃ এ রোগের চিকিৎসা কলকাতায় হবে না। কারন একে তো পরিকাথামো নেই। তার ওপর ডাক্তার ও হাসপাতাল পেশেন্ট ধরে রাখার জন্যে এত ঘোরাবে যে তাতে মুল্যবান সময় নষ্ট হবে। এর মানে এটা নয় আমাদের আশেপাশে যে ডাক্তাররা আছেন তারা অশ্রদ্ধার পাত্র। আদৌ সেকথা বলছি না। মানুষের জীবন নিয়ে যাদের কাজ, তা ডাক্তার, নার্স বা ওয়ার্ড বয় যেই হোক না কেন, তাদের আলাদা সম্মান থাকবেই। কিন্তু যেটা বলতে চাইছি তা হল, ওই সম্মানটাকে হাত বোমার মত ব্যবহার করা ঠিক নয় - কথা না শুনলেই ফাটিয়ে দেব। ওই সম্মানটা আমরা ডাক্তারকে দেই। সম্মান প্রাপ্য বলে ধরে নিলেই মুশকিল। নিজেই নিজেকে ভগবান ভাবা যায় কি? ডাক্তার ছাড়া যেমন চলবে না তেমনি সাংবাদিকেরও দরকার। বেশিরভাগ লোকের দরকারটা ক্ষুদ্র স্বার্থে। ফেসবুক জুড়ে ওম কাশ্যপের ছবি আর তার সঙ্গে সুদানে অনাহার ক্লিষ্ট শিশুর ছবি। সাংবাদিককে শকুন বলে প্রচার চলছে। লিখেছেন ডাক্তার, শেয়ার করছেন ডাক্তার। লোকেও খাচ্ছে। এটা না জেনেই খাচ্ছে যে, ওই টিভি মিডিয়ার চিল-চিৎকার ছাড়া ডাক্তারবাবুদের আন্দোলন জলে ভেসে যেত। তার ওপর আবার বায়না আছে। আমরা মিটিং করব সেটা লাইভ করতে হবে। আপনারা কে, যে ঠিক করবেন আমি পয়সা খরচ করে ‘লাইভ’ করব কি করব না? আপনার ইচ্ছে হয়, আপনি মিটিঙ্গের ভিডিও করুন! আমি যদি চ্যানেল চালাতাম তাহলে অবশ্যই ওই লাইভ নাটক করতাম না। তাতে অবশ্য আবার আমাকেই গাল পাড়ত। সে যা পারেন, পাড়ুন।
খালি কয়েকটা কথা মনে রাখলে আপনাদেরই ভালো। আপনি যেমন পেশার প্রয়োজনে কষ্ট করেন। আমরাও করি। যেকোনো পেশাদার করে। আর সেটা নিয়ে ঢাক পেটানোর কিছু নেই। আমি তো আপনাকে বলতে যাই নি, যে শক্তিধরেরা আমায় কতবার চমকেছে! আপনি যেমন ঢিল খান, আমরাও মার খাই। তার থেকেও যেটা বেশি তাহল, শক্তিধরেদের আঁতে ঘা লাগলেই ভাতে মারা, জেলে পচানোর ব্যবস্থা পাকা। কারন আপনাদের মাথা আর আমাদের মাথারা আসলে এক। আমরা প্রকৃতই উলুখাগড়া। আরেকটা কথা, আপনি আমি কিন্তু একই সমাজ থেকে আসি। প্রলোভনগুলোও একই। আপনাদের যত শতাংশ সাধারন মানের ডাক্তার বা তারও কম; আমাদেরও তাই। আপনাদের মতই, আমাদেরও একটা শ্রেনী দক্ষ এবং সৎ। এবং তারা নানা ভাবে আপনার দেশের উন্নয়নে ভুমিকা রাখে। সাংবাদিকতার পেশার বাইরেও তাদের দাম আছে। হ্যাঁ আপনাদের সঙ্গে আমাদের একটা ফারাক আছে। মূলত টেকনোলজির কারনে, আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থনৈতিক ভিতে এখন ঘুন ধরেছে অনেকখানি। তাই মোটের ওপর সম্প্রতি আমাদের পেশাটা অনেকটা বিপন্ন। আপনাদের অবস্থা তেমন নয় এটাও ঠিক। কিন্তু হতে কতদিন? বর্তমানে তো মোবাইলই নাড়ি দেখে দেয়। আগামীদিনে কি হবে কে জানে? তাই অনুগ্রহ করে গাল দেবেন না। আসলে ওটা যে খুব সস্তা কর্ম। বাস্তবে শকুন মরে গেলে তার প্রয়োজনের অনুভবগুলো ভীষন নাড়া দেয়।যত পারেন করুন না আমাদের সমালোচনা। কিন্তু তাতে কি চিড়ে ভিজবে? আত্মসমালোচনার আয়নার সামনে একটু দাঁড়ান – – যেমনটা অহরহ আমরা করে চলেছি, আর করেও যাব।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours