Politics
রণজিৎ গুহ, সমাজকর্মীঃ দু-একটি রাজনৈতিক দল বহুদিন ধরে যত্ন নিয়ে এ বঙ্গের বৈচিত্র্য সন্ধানী বাঙালীর যে চারিত্রিক বিন্যাস তা আমূল পাল্টে একপেশে করে দিতে অনেকটাই সফল হয়েছেন ।তুমুল প্রচার নিনাদে 'সাধারণের আচরিত ধর্ম মানবতার শত্রু' বা 'নিরপেক্ষতা আসলে শ্রমিক স্বার্থ বিরোধী' ইত্যকার কিছু আপাত হাইপোথিসিস এ রাজ্যের মানুষজনের হাড়ে মজ্জায় ঢুকিয়ে দিতে পেরেছেন। এ বঙ্গের বাঙালির আরেক বৈশিষ্ট্য ' শাক দিয়ে মাছ ঢাকা'র অবিরত চেষ্টা। যেটা আছে, সেটা দেখি না, যেটা মনোগত ইচ্ছা সেটাই দেখতে চাই। বাস্তবকে স্বীকার করিনা এড়িয়ে চলি।কল্প গল্পর নমুনা খুঁজে হয়রান হই। প্রতিনিয়ত নিজেদের বঞ্চিত এবং অন্য সকলকে ষড়যন্ত্রকারী প্রতিপক্ষ ভেবে আমরা এক অনন্য জাতিসত্তা হিসাবে নিজেদের পরিচয় দিতে ভালবাসি।অধমের সাথে তুলনা করে উত্তম সাজার অভিপ্রায় যে আমাদের অধঃপাতে নিয়ে যাচ্ছে তা ভেবেও দেখিনা। উপরের কথাগুলো বঙ্গ সমাজ সংস্কৃতির বিচ্যুতির দিকে নিছক অঙ্গুলি নির্দেশ নয়। তথাকথিত প্রগতিশীল হওয়ার বাসনায় আমরা যে অবিজ্ঞানকে বাহবা দিচ্ছি তারই প্রাক কথন। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে কলেজে ভর্তির আবেদন পত্রে পড়ুয়াদের পালিত ধর্ম জানতে বিদ্যাদিগগজ কলেজ কর্তৃপক্ষ এক চুড়ান্ত হাস্যকর অবস্থান নিয়েছেন। হিন্দু মুসলমান খৃষ্টান ও মানবতাকে একই পংক্তিতে ফেলে সমাজ সংস্কারের বাহাদুরি পেতে চেয়েছেন। আমাদেরও আহ্লাদের শেষ নেই।বঙ্গ বুদ্ধিবাগীশরা যারা নিজেদের ধর্মবিরোধী বলে নিজেদের পিঠ চুলকেছেন তারাও বেশ ডগমগ। ভাবখানা এমন যে দেখো কেমন প্রমাণিত হয়ে গেল যারা পাঁচ ওয়ক্ত নমাজ পড়ে বা ত্রিসন্ধ্যা জপ করে বা কদাচ মসজিদে মন্দিরে চার্চে যায় না কিন্তু ধর্ম মানিনা বলে সোরগোলও তোলে না তারা সকলেই মানবতা বিরোধী অমানবিক। কলেজ কর্তৃপক্ষ কোন অধিকারে হিন্দু মুসলমান খৃষ্টান শিখ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের অমানবিক বলে অপমানিত করতে পারেন?আচরিত ধর্মগুলোর বিকল্পে ধর্মনিরপেক্ষ/কোনটাই না বা নিদেন নাস্তিক লেখাই যেত।ইভিএম এ যেমন নোটা বিকল্প থাকে।নোটার জায়গায় নির্বাচন কমিশন কি' সৎ মানুষ ' লিখতে পারেন? সমাজ সংস্কারের অতি উৎসাহে চট জলদি এমন ব্যবস্থা উপকারে তো লাগেই না বরং কর্তৃপক্ষের প্রকৃত উদ্দেশ্যই প্রশ্নের মুখে পরে।মানবতাকে অন্য আচরিত ধর্মগুলোর বিকল্প হিসাবে বসালে ধর্মীয় সংগঠনগুলোর তেমন ক্ষতিবৃদ্ধি নাও হতে পারে হয়তো। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসাবে সমাজ সমীক্ষায় যে আবশ্যিক দায়বদ্ধতা তার গুরুতর হানি ঘটে যায়।আমাদের সমাজ নানা অর্থনৈতিক স্তরে বিভাজিত তো বটেই।একই সঙ্গে জাতি উপজাতি বা ধর্মীয় গোষ্ঠীতে প্রবলভাবে বিভক্ত। ভাষাগত বা নানা সংস্কারগত ভাবেও স্পষ্ট বিভাজন দেখা যায়।এমনকি শহুরে- গ্রামীণ ভেদাভেদও বেশ টের পাওয়া যায়। মুসলমান, মতুয়া, পৌণ্ড্র ক্ষত্রিয়, পুর্ববঙ্গীয়, তামিল,সুন্নী, মুণ্ডা, মাহিস্য, এরকম শতেক পরিচয়ে আমরা বিভক্ত এই বাস্তব অস্বীকার করলে সমস্যার সমাধান তো হয়ইনা বরং সত্য গোপন করে তা জিইয়ে রাখা হয়।কলেজের আবেদন পত্রে বা অন্য কোন জন তথ্য সংগ্রহে যদি গোষ্ঠী পরিচয় যথাযথ না থাকে তবে সমাজ সমীক্ষায় গুরুতর ত্রুটি ঘটে যাবে।জনগণের বিভিন্ন অংশের চাহিদা নিরূপণে, আর্থসামাজিক ভাবে পিছিয়ে থাকা গোষ্ঠীর অসাম্য ঘোচাতে, দেশের সার্বিক উন্নয়নে, আমাদের দেশে বিভিন্ন জন সমীক্ষায় গোষ্ঠী পরিচয় এখনও জরুরী। আমরা গোষ্ঠী পরিচয় অবলুপ্তির কথা ভাবতেই পারি।ক্ষুদ্র পরিচয়ের গণ্ডি ছাড়িয়ে বৃহত্তর সমাজের অন্যতম হয়ে উঠতেও বর্তমানের বাস্তবতা স্বীকার করেই এগোতে হবে।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours