NRS hospital
কাজল ভট্টাচার্য, সিনিওর জার্নালিষ্ট, কলকাতাঃ

- ;ডাক্তাররা আন্দোলন করে ঠিক করেছেন।- ;ডাক্তাররা আন্দোলন করতেই পারে। তবে রোগীর চিকিৎসা বন্ধ করে কোনমতেই নয়।এই দুই মত ঘিরে স্পষ্ট বিভাজন দেখা দিল বাংলার সমাজে।

রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, আন্দোলনকারী ডাক্তার, অনড় ছিলেন দুপক্ষই। তবে এঁদের চেয়েও নিজেদের অবস্থানে
এক কাঠি বেশি অনড় দেখা গেছিল সাধারণ সমাজকে। আর কোথাও রাজনীতির খেলা থাকুক না থাকুক, সাধারণ
মানুষের বিভাজনের মধ্যে কিন্তু প্রচ্ছন্ন ভাবে লুকিয়ে ছিল সেই দলীয় রাজনীতি।

আন্দোলনের পক্ষধারীদের যুক্তি ছিল, ডাক্তারদের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছিল। কর্মবিরতিতে না গিয়ে তাঁরা
কিই বা করতেন!
যাঁরা এই কর্মবিরতির পক্ষে তাঁদের অনেকেরই পরিবারের কেউ না কেউ ডাক্তারি পড়ছেন। অথবা চিকিৎসা
পেশার সঙ্গে জড়িয়ে আছেন। নিদেনপক্ষে বন্ধু-বান্ধব। এঁরা সবাই এতদিন ধরে বোঝানোর চেষ্টা করে গেলেন,
কী অকল্পনীয় পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে যেতে হয় পড়ুয়া, চিকিৎসকদের। তাঁরা সবাই সমাজের একেকটি রত্ন।
আর কিনা, তাঁদেরই গায়ে হাত!

এরকম রত্নদেরই একজন ছিলেন জসিমুদ্দিন। এনআরএস মেডিক্যাল কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র। হস্টেলের
পিলারে দড়ি দিয়ে বেঁধে, এক মানসিক রোগী যুবককে  সেরেফ পিটিয়েই মারার অভিযোগে জসিমুদ্দিনকে গ্রেপ্তার
করেছিল পুলিশ। মৃতের নাম কোরপান শাহ। সন্দেহ করা হয়েছিল কোরপান মোবাইল চোর।
2014 সালের 16 নভেম্বর। হাসপাতাল চত্বর থেকে পুলিশ উদ্ধার করেছিল কোরপানের প্রাণহীন দেহ। খুনের
জট খুলতে হিমশিম খেয়ে গেছিল পুলিশ। প্রমাণ লোপাট, সাক্ষীর অভাবে। সেদিন খুনীকে ধরতে দেরি হওয়ায়,
মানবাধিকার সমেত মানুষের কড়া সমালোচনার শিকার হয়েছিল পুলিশ। ঠিক আজকের মতোই।
আদালতে শুনানি চলার সময় জসিমুদ্দিনের সতীর্থ পড়ুয়ারা এতটাই বিশৃঙ্খল হয়ে উঠেছিলেন যে অ্যাডিশনাল
চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট অর্পিতা ঘোষ বলতে বাধ্য হয়েছিলেন- আগামিদিনে যাঁরা ডাক্তার হতে চলেছেন,
তাঁরা আদালতে এমন ব্যবহার করেন কী করে?

আজও এই হবু ডাক্তাররা একইরকম বেপরোয়া। আন্দোলনের নামে শিকেয় তুলেছিলেন চিকিৎসা পরিষেবা।
হাসপাতালের ;সাইলেন্স জোনে; চলেছিল সোল্লাসে মিটিং, মিছিল। আর তাঁদের এই অমানবিক কান্ড-কারখানাকে
সমানে উৎসাহ জুগিয়ে গেলেন রাজ্যের বিশিষ্ট কিছু চিকিৎসকরা। আর এই গোটা ঘটনায় এক চরম
আত্মতৃপ্তিতে ভুগলেন এক শ্রেণীর নাগরিক।

পুরোন কাসুন্দি ঘাঁটা অর্থহীন।
তবু ওই প্রসঙ্গ টেনে আনার কারণ একটাই। যাঁরা ডাক্তারী পড়ছেন তাঁরা নিঃসন্দেহে মেধাবী। তবে মেধাবী
হলেই যে মানুষ হিসেবে ভালো, বিবেচক হবেন, তার কোনও মানে নেই। তাই ডাক্তারি পড়ুয়াদের রত্ন বলে
ঠাওড়ানোর কারণ কোনভাবেই নেই। কখনও যদি তাঁরা পাক্কা ক্রিমিনালের মতো ঘটনাও ঘটিয়ে ফেলেন, তাতেও
চমকানোর কিছু নেই। ঠিক যেভাবে আচমকাই কোনও পেশেন্ট পার্টি ঠ্যাঙাড়ের মতো হিংস্র হয়ে উঠলেও, তা
অস্বাভাবিক কোনও ঘটনা নয়।

এনআরএসের কোরপানহত্যা ঘটনা নিশ্চয়ই এক বিচ্ছিন্ন ঘটনা। তা দিয়ে সামগ্রিক ভাবে ডাক্তারি পড়ুয়াদের
বিচার করা চলে না। ঠিক একইরকম ভাবে সোমবার এক পেশেন্ট পার্টির ডাক্তার পেটানোও এক বিচ্ছিন্ন
ঘটনা। ওই ঘটনার জন্য রাজ্যবাসীকে চিকিৎসা পরিষেবা দিতে অস্বীকার করাও সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।
অমানবিক।
আন্দোলনকারী ডাক্তারদের পাশে দাঁড়াতে দেখা গেল নার্সদেরও। মানবিক কারণে। সেদিন ওই মানবিকতা
কোথায় গেছিল, যেদিন এনআরএসের দুই ট্রেনি নার্স পিটিয়ে মেরে ফেলেছিল ষোলটা কুকুরছানাকে? বেশিদিনের
না, গত জানুয়ারি মাসের ঘটনা। তাহলে কি দলভারি করতেই ধর্মঘটি ডাক্তারদের পাশে দাঁড়ালেন নার্সরা?

আমাদের সৌভাগ্য পরিবহ ক্রমেই সুস্থ হয়ে উঠছেন। কিন্তু ডাক্তারদের ভুলে রোগীর প্রাণ যাওয়ার ঘটনাও
ঘটে। যদিও ডাক্তারদের দাবি তাঁরা ভগবান না। সবার প্রাণ বাঁচানোর ক্ষমতাও তাঁদের নেই। সঠিক কথা। কিন্তু
চিকিৎসা বিভ্রাটে প্রাণ গেলে? আর সেরকম ঘটনার সংখ্যাও নেহাত কম না।
তবে আইন ;চিকিৎসা বিভ্রাটের; ঘটনাকে মোটেই হালকা করে দেখে না। আর তার কিছু প্রমাণও আছে। তবে এ
ব্যাপারে সুবিচার পাওয়ার ব্যাপারটা যে কী ভীষণ কঠিন তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল অনুরাধা সাহার
মৃত্যু।

পেশায় শিশু মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডক্টর অনুরাধা সাহা(36) মার্কিন মুলুকের ওহিয়ো থেকে এসেছিলেন তাঁর শহর
কলকাতায়। সঙ্গে তাঁর স্বামী ডাক্তার কুণাল সাহা। এসেছিলেন কিন্তু ফিরে যেতে পারেননি অনুরাধা। কারণ
ডাক্তারদের ভুল চিকিৎসায় অকালেই প্রাণ গেছিল তাঁর। দিনটা ছিল 18 মে, 1998।

1999 সালের মার্চ মাস। ডাক্তার কুণাল সাহা ঘটনার বিহিত চেয়ে দ্বারস্থ হন আদালতের। একজন দুজন না,
গোটা ঘটনায় ডক্টর সাহার আইনি নোটিশ পেয়েছিলেন  মোট ছাব্বিশজন চিকিৎসক। ওয়েস্ট বেঙ্গল
মেডিক্যাল কাউন্সিল এবং  রাজ্যের হাইকোর্টে মামলা হেরে যান তিনি। তবে ন্যাশনাল কনজিউমার ডিসপিউটস
রিড্রেসাল কমিশন রায় দেন ডক্টর কুণাল সাহার পক্ষে। আদেশ দেওয়া হয়  এক কোটি সত্তর লক্ষ টাকা
ক্ষতিপূরণের। কমিশনের রায়েও সন্তুষ্ট হননি মৃতা ডাক্তার অনুরাধার স্বামী। মামলা গড়ায় শীর্ষ আদালতে।
সালটা ছিল 2009।
জাস্টিস এস জে মুখোপাধ্যায় এবং ভি গোপাল গৌড়া তাঁদের দুশো দশ পাতার রায়ে মোট পাঁচ কোটি ছিয়ানব্বই
লক্ষ টাকার ক্ষতিপূরণের আদেশ দেন। সুদসমেত টাকার অঙ্ক দাঁড়িয়েছিল মোট এগারো কোটি টাকা। দোষী
সাব্যস্ত করা হয়েছিল তিনজন চিকিৎসককে।
তবে চিকিৎসায় গাফিলতির জন্য তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুর সুবিচার পাওয়ার জন্য ডক্টর কুণাল সাহাকে অপেক্ষা
করতে হয়েছিল সুদীর্ঘ পনেরো বছর। 2013 সালে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে ক্ষতিপূরণের টাকার অঙ্কতেই স্পষ্ট,
দেশের সর্বোচ্চ আদালত চিকিৎসকদের অবহেলায় রোগীমৃত্যুর ঘটনাকে কতটা গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তবে
সুবিচার পাওয়ার এই জটিল এবং দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাওয়ার সামর্থ্য ঠিক কজনের আছে?

ডাক্তারদের চলতি আন্দোলনে চিকিৎসার অভাবে যাঁরা মারা গেলেন, তাঁদের হয়ে বিচার চাইবে কে?
ঘটনায় স্পষ্ট, ভগবান নই, চিকিৎসা করতে গিয়েও রোগীর মৃত্যু হতে পারে। ডাক্তারদের এই সহজ সাফাই
অর্থহীন। স্বাভাবিক কারণে রোগী মৃত্যু হতেই পারে। তবে তা হতে পারে চিকিৎসকদের অবহেলাতেও। আর
সেক্ষেত্রে তা দন্ডনীয় অপরাধ।

এনআরএসে জুনিয়র ডাক্তারদের ওপর পেশেন্ট পার্টির হামলা নিঃসন্দেহে পাশবিক, তা সে যে কারণেই হোক না
কেন।  স্বাভাবিক ভাবেই নিজেদের নিরাপত্তার দাবিতে সোচ্চার হতেই পারতেন আক্রান্ত ডাক্তাররা।
সরকারের দেওয়া আশ্বাস যথেষ্ট না মনে হলে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের ওপর নিশ্চয়ই চাপ বাড়াতেও পারতেন।
খোলা ছিল আদালতের দরজাও।
কিন্তু এক্ষেত্রে দাবি আদায়ের যে রাস্তাটি বেছে নিয়েছিলেন, তা মোটেই সমর্থনযোগ্য ছিল না। সরকারকে
চাপে ফেলতে কর্মবিরতির ডাক দিয়ে, রাজ্য জুড়ে চিকিৎসা ব্যবস্থা অচল করে দিয়েছিলেন ডাক্তাররা।
আন্দোলনকারী ডাক্তার আর সরকারের পাঞ্জা কষাকষিতে প্রাণ গেল একাধিক রোগী, নবজাতর।
ডাক্তারদের আন্দোলন মিটে গেল। সহাস্য মুখ্যমন্ত্রীও কথা দিলেন, এবার একদিন হাসিমুখে এনআরএস
পরিদর্শনে যাবেন। কালকের আন্দোলনকারী ডাক্তাররা সেদিন ছুটে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে হাত মেলাবেন।

কিন্তু ডাক্তারদের এই লম্বা কর্মবিরতিতে যাঁদের প্রাণ গেল, তাঁদের হয়ে সুবিচার চাইবে কে?;বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours