Fathers day
সুবীর পাল, এডিটর, দ্য অফনিউজঃ আজ পিতৃদিবস। সারা বিশ্বের সার্বিক পিতা সমাজ আজ সন্মানিত। অথচ বাংলার সাংবিধানিক পিতা যে অপমানিত, হয়তো অনেকটা উপেক্ষিত এই পিতাময় দিনে। বড্ড মনে পড়ে বিখ্যাত সেই ‘সিরাজদৌল্লা’ নাটকের চিরস্মরনীয় উক্তি, ‘বাংলার ভাগ্যাকাশে আজ দুর্যোগের ঘনঘটা, কে তাকে আশা দেবে, কে তাকে ভরসা দেবে...?’ রাজভবনের একান্ত কুঠরীর বেদনাময় দেওয়ালগুলিকে ফের সাক্ষী করে তাই পিতৃদিবসের ঠিক প্রাক সন্ধ্যায় এই বাংলার সাংবিধানিক পিতা জানাতে বাধ্য হলেন, ‘তিনি ব্যাথিত।’ আসলে ‘ফের সাক্ষী করে’ বলতে পিছিয়ে যেতে হয় বিগত দশকের চিলকোঠায়। ছোটবেলায় স্কুল জীবনে পাঠ্যপুস্তকে পড়েছিলাম এস ওয়াজেদ আলীর ‘রেঁনেশাস’ প্রবন্ধটি। এখন তো আবার স্কুল পড়ুয়ারা পড়ে মমতা বন্দ্যোপাধায়ের কবিতা। আসলে সেই মনে রাখার মতো প্রবন্ধে সম্ভবত শেষ দিকে লেখা ছিল, সেই ধারাবাহিকতা এখনও চলছে। হ্যাঁ ঠিকই। এক উপেক্ষার ধারাবাহিকতা। এ যেন রাজ্যের সাংবিধানিক পিতার অমর্যাদার করুণ রেঁনেশাস। নন্দীগ্রামের স্মৃতির চিলেকোঠায় ঘাটাঘাটি করতে গিয়ে মনে পড়ে, বারে বারে আমিও তখন সেখানে ছুটে গিয়েছিলাম খবরের তাড়নায়।
বারুদের গন্ধ আর রক্তের হোলি খেলার সার্কাস চলছে শাসক সিপিএমের স্পন্সরশীপে। বিরোধি নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আক্ষেপ করে বলেছিলেন, অসংখ্য লাশ গায়েব করা হচ্ছে। সেদিনও বসে থাকেননি রাজ্যের সাংবিধানিক পিতা গোপালকৃষ্ণ গাঁধী। তিনি ছুটে গিয়েছিলেন রক্তের মরুভুমি নন্দীগ্রামে। চমকে গেলেন তিনি। ফর্সা মুখ পাংশু হয়ে গেল নিমিষে। তিনি বললেন, ‘হার হিম করা পরিবেশ।’ আসলে রাজ্যের সাংবিধানিক পিতা রক্তস্নাত নদী পেড়িয়ে এসে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু রাজ্য পিতার হার হিম করা ভয়কে তদাণীন্তন প্রশাসনিক রাজ্য প্রধান উপেক্ষার আস্ফালনে পরিণত করেছিল কংসের মেজাজে। ‘এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি’ ছড়া লিখিয়ে কবির ভাইপো তথা তদানীন্তন বঙ্গ প্রশাসনেশ্বর দাম্ভিক বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সেই হার হিম আতঙ্ককে তোয়াক্কা না করে নতুন তত্ত্ব সাজালেন। ‘ওরা আমরা’ থিওরি। যেন ঈশ্বরকে জয় করেছেন এমন বডি ল্যাঙুয়েজে বলেছিলেন, আমরা ২৩৫ ওরা শুধু ৩৫। কি বুদ্ধদেববাবু, আজ আপনারা কত আর ওরা কত? সেদিন রাজ্যপিতার ভয়কে পদদলিত করেছিলেন ক্ষমতায়নের বৃত্তে আর আজ আপনি নিজেই মানুষের ভোটবাজারে অপাংতেয়। সিঙ্গুর আন্দোলন তখনও তুঙ্গস্পর্শী হয়নি। একদিন হঠাৎ রাত ন’টায় ডিআইবি সূত্রে খবর পেলাম বিরোধী নেত্রী বীরভূম থেকে সিঙ্গুর যাবেন মাঝরাতেই। একদম গোপন এই যাত্রাপথ। আমার কাছে আগেই খবর ছিল, পুলিশ উনাকে সিঙ্গুরে ঢুকতে দেবে না। প্রয়োজন হলে পুলিশ বলপ্রয়োগ করতে পারে। তাই দৌড়ালাম পানাগড়ের দার্জিলিং মোড়ে। উনার এক্সক্লুসিভ বাইট নেব বলে। প্লাস দিদিকে সতর্ক করব বলে। রাত দশটা থেকে শুধুই অপেক্ষা। মাঝে মধ্যে মোবাইলে আশ্বাস শুনছি, তিনি আসবেনই। অবশেষে এলেন রাত তিনটেতে। হাত দেখাতেই গাড়ি থেকে নামলেন। উনার সফরসঙ্গী ছিলেন কলকাতার সদ্য প্রাক্তন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়। সবাই মিলে গেলাম রাস্তার ধারে এক ধাবায়। ধারে পাশে একজনও সমর্থক ছিল না। কাঠের অর্ধ নোংরা বেঞ্চে বসে আমরা সবাই। আপনিও। সেদিন বিরোধী নেত্রী হিসেবে ছিলেন সবার প্রাণের দিদি। আমারও বুক ভরা এক আদর্শ ছিলেন। আপনি বললেন, তোমরা চা খেতে পার। আমিও খাব। কিন্তু এর বেশি কিছু খাওয়াতে পারব না। তোমাদের দিদির যে সেই ক্ষমতা নেই। আমি বললাম, দিদি এই রাতে একা এই ভাবে সিঙ্গুর যাবেন না। তিনি আমার পিঠে হাত রেখে বলেছিলেন, ‘সিপিএমের হার্মাদদের আমি ভয় পাই না। আমাকে সিঙ্গুর যেতেই হবে। বাংলাকে বাঁচাতে আমার যা করণীয় তা আমি করবই।’ আজও মনে পড়ে দিদির সেই পিঠ স্পর্শে কি মমতারই না ছোঁয়া ছিল। সাংবাদিক পেশায় হলেও এক মানবিক স্পর্শে দিদির কথাগুলো যেন খুব অন্তর সত্য মনে হতো তখন। যদিও দিদির সেই রাতে সিঙ্গুরে পা পড়েনি এটাও সত্য। আর আজ। আজও আমি সাংবাদিক। আর আপনি রাজ্যের প্রশাসনিক অভিভাবিকা মুখ্যমন্ত্রী। মাঝখান দিয়ে দশক ছুঁই ছুঁই সময়ের বিকেল অতিক্রান্ত। অথচ আজকাল সোস্যাল সাইটে আপনাকে তীর্যক করে কেউ কেউ বলেন, ‘মমতা নামটা কে যে রাখল।’ আর তখনই ভাবি আপনার মমতাময় সেই স্পর্শটা। সেই আন্তরিকতাটা। সেই কমিটমেন্টগুলো। গতকাল। নবান্নে আপনি প্রেস কনফারেন্স করলেন। আপনি বললেন, আপনি রাজ্যপালকে ফোন করেছিলেন। কিন্তু রাজভবন পত্রপাঠ আপনার দাবি খারিজ করে দিয়েছে। বাংলার মানুষ আজ বিভ্রান্ত। কে মিথ্যা বলছেন? রাজ্যের প্রশাসনিক মাতা না সাংবিধানিক পিতা? রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠী এনআরএস কান্ড সমাধানে আপনাকে তলব করছেন সাক্ষাতের তাগিদে। অথচ কি অসীম শীতলতায় আপনিও কবি ভাইপোর মতোই আচরণ করছেন ডোন্ট কেয়ার আইকনে। যেই যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবন। এই প্রবাদ সত্য প্রমাণিত করে আপনিও ওরা আমরা ভোটবাক্সের পাটিগণিত ফর্মুলায় শুরু করে দিলেন ‘বাঙালি-অবাঙালি-বহিরাগত’ ইকুয়েশন। আপনি না প্রশাসনিক রাজ্যমাতা! আপনার কাছে তো ভারতীয় নাগরিকেরা সেই মমতাময়ী অন্তর আবেদনটাই আশা করে নাকি? কি অদ্ভুত? নবান্নে পাঁচ অশরীরি জুনিয়র ডাক্তার এসেছিলেন কাল সন্ধ্যায়। যা একমাত্র আপনিই দেখতে পেয়েছিলেন। আপনিই কথা বলতে পেরেছিলেন শুধুমাত্র। বারমুডা ট্রাঙ্গেলের রহস্যের সাদৃশ্যে তারপর ওই পঞ্চভুত কোথায় যে বিলীন হল তা বঙ্গবাসী ঠাকুমার ঝুলি খুঁজেও ঠাহর করতে পারছেন না। এনআরএসের আন্দোলনকারীরা তো বলছেন আপনি মিথ্যে ভাষণ দিয়েছেন। এরপর আরও প্রকাশ্য। অনেকেই অভিযোগ করছেন, ওই পঞ্চভুতের ইন্দ্রজালে আপনি যাদু দেখালেন ‘ইচ্ছুক-অনিচ্ছুক’ মতবাদের। আপনার অগ্রজ যেমন সিঙ্গুর প্রসঙ্গে সোনার পরশকাঠি দেখিয়েছিলেন ইচ্ছুক অনিচ্ছুক জমিদাতার ইস্যুকে কেন্দ্র করে। তেমনি আপনিও সাংবাদিকদের জানালেন ‘জনা কয়েক জুনিয়র ডাক্তার কাজে যোগ দিতে ইচ্ছুক।’ আর সঙ্গে সঙ্গেই অনিচ্ছুকরা বললেন, কাঁরা কাজে যোগ দিতে চান নাম প্রকাশ করা হোক। ব্যাস, আপনিও পাল্টা চ্যালেঞ্জের মুখে নীরব ধ্যানস্থ। সেই দিনের দিদি না বলে আজ আপনাকে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী বলতে বাধ্য। কারণ প্রোটোকল তাই নির্দেশ দেয়। সেদিনও ওই গভীর রাতে আপনাকে একা সেদিন সিঙ্গুর যেতে বারণ করেছিলাম। এক দিদিকে ভালবেসে। আপনার স্রেফ নিরাপত্তার কথা ভেবে। আর আপনাকে আজ আবার বলছি বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে, আপনার পুর্ববর্তী মুখ্যমন্ত্রীর অনুকরণে ‘ওরা-আমরা’, ইচ্ছুক-অনিচ্ছুক’ নীতি অনুগ্রহ করে বর্জন করুন। ইতিহাসের পাতায় বুদ্ধদেব বাবুর প্রস্থান যে আপনিই মসৃণ করে দিয়েছিলেন। নিজের কেন্দ্রেই তিনি মাথা নিচু করে মানুষের প্রত্যাখান মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। কে জানে রাজনীতির গোকুল মঞ্চে কোনও গদ্দার না আবার কৃষ্ণ বনে যায়। গণতন্ত্রে মসনদ যে বড়ই পিচ্ছিল। তবু বলি আপনি রাজ্যবাসীর মাতৃরূপে বাংলার অভিভাবিকাই হয়ে থাকুন। আমরা আবার যেন সেই ভুলে যাওয়া স্লোগান ফের তুলতে পারি, আপনি হলেন বাংলার সততার প্রতিমূর্তি। বদলা নয় বদল চাই। শুধু এই পিতৃদিবসে একটাই অনুরোধ আপনার কাছে, সংবিধানের রাজ্য পিতা যেন উপেক্ষিত আর না হন এই বাংলায়। তাঁকে যেন আর বলতে না হয়, তিনি ব্যাথিত। এটা যে পশ্চিমবঙ্গের লজ্জা। বিশ্বাস করুন, পিতৃদিবসে পিতার দীর্ঘশ্বাস কিন্তু শুভ ইঙ্গিতকারক নয়। তাই ভয়ে ভয়ে বলি, ‘বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি, ধর্মং শরণং গচ্ছামি, সঙ্ঘং শরণং গচ্ছামি। আবার জপি, ‘বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি...’


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours