কাজল ভট্টাচার্য, বরিষ্ঠ সাংবাদিক, কলকাতাঃ
পাবলিকের নাড়ির গতি কে বেশি ভাল বোঝেন?
বলিউডের প্রয়াত ভেটারেন পরিচালক রামানন্দ সাগর নাকি নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদি-অমিত অনিলচন্দ্র শাহ জুটি?
নিঃসন্দেহে প্রয়াত রামানন্দ সাগর।
কেন?
মাত্র আটাত্তরটি রবিবারে আসমুদ্র হিমাচল ভারতবর্ষকে তিনি একসূত্রে গেঁথে ফেলেছিলেন। সুনামি তুলেছিলেন পুরুষোত্তম রামের ভক্তিরসের। তৈরি করেছিলেন মেগা সিরিয়াল, 'রামায়ণ'।
ঠিক এই কাজটি করতে চান মোদি-শাহ জুটি। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। কিন্তু প্রায় তিন দশক পেরোতে চললেও, ওই একই কাজ ঠিকঠাক ভাবে গুছিয়ে করে উঠতে পারেনি বিজেপি সঙ্ঘ পরিবার।
যার সোজা মানে করলে দাঁড়ায়, রাজনীতিবিদরা মুখে যতই দেশের কথা দশের কথা বলুন না কেন, মানুষের মনের খবর তাঁরা রাখেন না। সেটি রাখে প্রয়াত রামানন্দজির মতো শিল্পীমনের মানুষরাই। শিল্পীমনের আবেগ দিয়ে মানুষের মন জয় করতে না পেরে কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন রাজনীতির কারবারীরা।
জয় শ্রীরাম।
আপাত নিরীহ রাজনীতির স্বাদ-গন্ধহীন এক ধ্বনি। কিন্তু নেপথ্যের খেলাটি মারাত্মক। খেলার শুরু করেছিলেন লালকৃষ্ণ আডবানি। সাল 1990। রামরথ যাত্রার সূচনা করলেন তিনি। উদ্দেশ্য, পুরুষোত্তম শ্রীরামকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া। প্রচুর দাঙ্গা-হাঙ্গামার পর আডবানির রামরথ রুখে দিয়েছিলেন বিহারের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদব।
অন্যদিকে রবিবার সকাল হলেই, রামানন্দ সাগরের রামরূপী অরুণ গোভিলের দর্শনের অপেক্ষায় বাড়ির 'বোকাবাক্সের' সামনে হাজির হতেন তীব্র হিন্দিবিদ্বেষী বলে পরিচিত দক্ষিণীরাও। 'রামায়ণ' সোপ অপেরার সেই বলিউডি রাম দাপিয়ে বেরিয়েছিলেন আসমুদ্র হিমাচল।
1987 সালে শুরু হয়ে রামায়ণ শেষ হয়েছিল তার পরের বছর। নাগাড়ে আটাত্তরটি রবিবার দর্শকরা মুগ্ধ হয়ে দেখেছিলেন সেই মেগা সিরিয়াল।
রামানন্দজির থেকেই হয়ত অনুপ্রেরিত হয়েছিলেন সিনেমাপ্রেমী আডবানি। বিজেপি, সঙ্ঘ পরিবারকে নিয়ে তিনিও তাঁর নিজের মতো করে চেষ্টা চালান। বিজেপির সেই দীর্ঘপ্রয়াস যে বিফলে যায়নি, সদ্যসমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল সে কথাই বলে।
রামানন্দ সাগর, বিজেপি- দু'পক্ষই চেয়েছিলেন
গোটা দেশকে শ্রীরাম রসে মজাতে। পার্থক্য একটাই। রামানন্দজির রাম ছিল ভক্তিরসে জারিত। উদ্দেশ্য, নির্ভেজাল বিনোদন সঙ্গে ব্যবসা।
আর মোদি-শাহের রাম, ধর্মের ভাবাবেগে মোড়ানো রাজনীতির প্রতীক। লক্ষ্য, ভোটের মেরুকরণ। তাই নির্বাচনী প্রচারেও অমিত শাহের মুখে শোনা গেছিল জয় শ্রীরাম।
এগিয়ে থাকলেন কে?
সোজা উত্তর রামানন্দ সাগর। সংখ্যাতত্ত্বের হিসেবে, প্রতি একশোজন ভারতবাসীর মধ্যে রামানন্দজির রামে মজেছিলেন বিরাশিজন। অন্যদিকে মোদি-শাহ জুটির রামে আস্থা রেখেছিলেন একশোজন ভোটারের মধ্যে মাত্র প্রায় সাড়ে সাঁইত্রিশজন। 2019 লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল এরকমটাই বলে।
এই পরিসংখ্যান এক স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়। ধর্মীয় ভাবাবেগে বিষ্ণুর সপ্তম অবতার শ্রীরাম অপ্রতিদ্বন্দ্বী। রাজনীতির পাকমাখা বিজেপির শ্রীরাম কিন্তু মোটেই সর্বগ্রাহ্য নয়।
তবে ধর্মের মোড়কে রাজনৈতিক রাম কিন্তু ইতিমধ্যেই বাংলায় ঢুকে পড়েছেন। আর তাতেই চাপে পড়ে গেছে বাংলার শাসক শিবির।
একদল জয় শ্রীরাম-এর হুঙ্কার দিয়ে গোটা বাংলার রাজনৈতিক দখল নেওয়ার অভিযানে নেমে পড়েছে। আর অন্যদল তাদের রুখবেই। নিউটনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার এই তত্ত্বটাকেই নিপুন হাতে কাজে লাগিয়েছে বিজেপি। যেখানে আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়ে গেছেন দাবার ঘুঁটি। রাম তো নিমিত্তমাত্র। আসল খেলা তো রাজনৈতিক জমি দখলের।
জয় শ্রীরাম শ্লোগানে সরাসরি রাজনীতির গন্ধ নেই। রাজনীতি ঘাপটি মেরে বসে আছে আড়ালে। তাই জয় শ্রীরাম শ্লোগানের বিরোধিতা করা মানেই ধর্মীয় ভাবাবেগে চোট করা। এমনটাই চালানোর জোরচেষ্টা চলেছে। সঙ্ঘ-বিজেপি পরিবারের পাতা এই ফাঁদেই পা দিয়ে বসেছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি যত মেজাজ হারান, ততই উৎসাহের জোয়ার ডাকে বিজেপি শিবিরে। নিত্যনতুন ফন্দি আঁটা শুরু হয় মুখ্যমন্ত্রীর ক্রোধাগ্নিতে ঘৃতাহুতি দেওয়ার। আর তার সমান্তরাল পথে চলতে থাকে ভোটব্যাঙ্ক মেরুকরণের কাজ।
এ পর্যন্ত সবটাই নাহয় রাজনীতি। কিন্তু এর পরের পর্বে অন্য কোনও দুরভিসন্ধি লুকিয়ে নেই তো? বাংলার শাসকদল সমেত অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলিও বারেবারে সেই আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন।
বাংলা ভক্তিরসের পূজারি। তার প্রিয় মাতৃরূপের বন্দনা। আর গো-বলয়ের প্রিয় বীররস। তাই তাদের আরাধ্য শ্রীরাম, বজরংবলী। সামাজিক স্তরে এই দুই রসের সংঘাত ঘটবে নাতো?
স্বীকার করুন কী নাই করুন, ভোট মেরুকরণের পরেই প্রাদেশিক মেরুকরণের পালে হাওয়া অত্যন্ত সুস্পষ্ট ভাবে লক্ষ্য করা গেছে।
ঠিক এ মুহূর্তে প্রশ্ন একটাই, রাজনীতির হাত ধরে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের রাস্তা সাফ হচ্ছে নাতো? ইতিহাস সাক্ষী, শাসক তাঁর নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ধরে রাখতে এই কৌশল বারেবারে ব্যবহার করেছেন।।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours