About trance gender
সুবীর পাল, এডিটর, দ্য অফনিউজঃ ভাদ্রের ঘেউ ঘেউ দুপুরে হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠেছিল। ও প্রান্তে যে রানি মজুমদার। রূপান্তরকামী সে। বছর দশেক আগে পরিচয়। সুশিক্ষিত। না, বরং তাকে সুশিক্ষিতা বলাটাই শ্রেয়। এক কথায় অত্যন্ত মার্জিত। লেখার হাত তো চমৎকার। তার আবদার সরাসরি। “দাদা আমাদের জীবণ নিয়ে একটা লেখা লিখুন না প্লিজ।” রানিদের জীবণ সংগ্রাম জানি বলে তাকে “না” বলতে পারিনি। অনেকে ছক্কা বললেও আসলে রুপান্তরী মেয়েটাকে আমি আজও কুর্ণিশ করি। তাঁর বেঁচে থাকার লড়াই আমাকে প্রেরণা দেয়। সমস্যাটা বাঁধলো অন্য জায়গায়। কি লিখি এটা ভাবতেই কয়েক দিন অতিক্রান্ত। উপায়ন্ত না দেখে পাকড়াও করেছিলাম একজনকে। বাস্তবিক অর্থে তিনি যে নিজেই একেশ্বরী। জেদী অথচ আধুনিক মনস্কা প্রফেসনালস।সুচাকুরে তবে মানবিক সুক্ষ গুনগুলো বেশ প্রকট। অগত্যা তারই স্মরণাপন্ন। তখন দুজনে ম্যাসেঞ্জারে চুটিয়ে চ্যাট পর্ব চলছে। কোনও এক শনিবার দুপুরে। সুযোগ বুঝেই বললাম, কি লিখি বলতো? আমার মুশকিল আসানের তৎক্ষণাৎ উত্তর, “এই যে সুপ্রিম কোর্টের রায় টা বেরোলো সেটার ওপর বেস করে লেখো।আগের আর পরের সামাজিক অবস্থান বা এই রায় টা সামাজিক ভাবে কতটা গ্রহণযোগ্য।প্রত্যক্ষ আর পরোক্ষ প্রভাব। এখন তো চারদিকে শুধু এই নিয়েই আলোচনা হচ্ছে।“ ফার্স্ট স্লিপে ব্যাটসম্যানের তোলা লোপ্পা ক্যাচ তালুবন্দি করার সুযোগ পেয়ে পালটা বললাম, সমকামী যৌনতা আর অপরাধ নয়। সুপ্রিম কোর্টের এই রায়কে তুমি কি ভাবে দেখছো? উত্তরটা স্পষ্ট, “আমার মতে খুবই সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। পরিবর্তিত সময় আর মানুষের মানসিকতাকেই মান্যতা দেওয়া হয়েছে।দুটি মানুষ যদি নিজেদের ধারনা অনুযায়ী তাদের জীবন নিয়ে সুখী হতে চায় সেখানে আইনের এবং সমাজের অন্তরায় হওয়া কখনোই উচিত নয়।যদি না এটা সমাজের বা কোনো ব্যাক্তি বিশেষের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ক্ষতির সূচনা করে।” আসলে কি জানো, আমরাই ঠিক করে ফেলেছি কোনটা প্রাকৃতিক যৌনতা আর কোনটা হবে অপ্রকৃস্থ যৌনতা। এটা বলতেই সে কিন্তু দারুণ কথাটা বলে ফেললো। “কোনটা ঠিকই কোনটা স্বাভাবিক আর কোনটা অস্বাভাবিক যৌনতা সেটা আমরা ঠিক করার কে? এটা তো গর্হিত অপরাধ নয়। কত লোক কত বড় বড় অপরাধ করেও সমাজে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারা তো লজ্জা পায় না। আর এরা আর যাই করুক তিন মাসের বাচ্চাকে বা আশি বছরের বৃদ্ধাকে রেপ তো করবে না। যারা নরমাল তারা তো এইসব অপরাধমুলক কাজগুলো অবলীলায় করছে। আমরা যখন চোখের সামনে এইসব নরমাল হিসেবে অসামাজিক কাজগুলো মেনে নিয়েছি তখন একটু অ্যাবনরমালও না হয় থাকুক চোখের সামনে ব্যতিক্রম হিসেবে।” এবার সে বলেই চলছে অনেটা বুলেট ট্রেনের গতিতে। নিজের খেয়ালেই। “তবে হ্যাঁ আরও একটা কথা। এটা নিয়ে কাগজে বইতে সম্মেলনে বা চায়ের টেবিলে গরম গরম কথা বলা এক আর নিজের ঘরে এটা মেনে নেওয়া কিন্তু একেবারে ভিন্ন মেরু্র ব্যতিক্রমী অবস্থান। তার জন্য আমাদের আর একটু মানসিক প্রস্তুতি লাগবে। আরও একটু সময় প্রয়োজন এই ব্যতিক্রম কে নিজের ঘরে দেখার জন্য।তুমি তো বেশ চমৎকার কথা বললে। হুম, তবে এর আইনগত দিকটাও স্পষ্ট থাকা দরকার।এদের বিয়েটা যেন আইনত স্বীকৃতি পায়। আর যদি এরা কোনও সন্তান দত্তক নেয় তারও যেন আইনত মান্যতা থাকে।” সমকামে তুমি অংশ নিতে প্রস্তুত? তোমার কাছে সমকামের মান্যতা কি? জবাব বেশ চমকপ্রদ। “আমার তো সেরকম কোনও টেন্ডেন্সি নেই। হ্যাঁ সামাজিক ভাবে আমি এটাকে নিশ্চই মানি। মানতে হয়ত একটু কষ্ট হয়। ভাবতেও একটু অবাক লাগে। তবুও ভেবে দেখেছি মানাটাই ঠিক। সেটাই উচিত। এর প্রতিবাদে যদি কেউ এখন বলে তাহলে যদি কোনও মানুষ পশুর সাথে সেক্স করে আনন্দ পায় তাহলে সেটাও কি মানতে হবে? আমি বলবো না। কারণ সেক্ষেত্রে পশুটির এতে সম্মতি নেই। কিন্তু যেখানে দুটি মানুষ নিজের ইচ্ছায় একসাথে জীবন কাটাতে চায় সেটাকে মান্যতা দেওয়াই উচিত। আমি সেটাকে খুব ভালোভাবেই নেব। কারণ আমি তাদেরকে সবার আগে একজন মানুষ হিসেবেই দেখি। কারণ আমার মনে হয় তাদের যত মূল স্রোতে আমরা মেনে নেব ততই তাদের পক্ষে এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকাটা সহজ হবে।” ধরো হঠাৎ পরিচয় হলো এক সমকামী বা রূপান্তরকামীর সঙ্গে। তোমরা রেস্টুরেন্টে বসে আড্ডা মারছো। পাশের টেবিল থেকে কেউ টিপ্পনি করলো। তুমি যা অগ্নিশ্বরী, নিশ্চয় প্রতিবাদ করবে। “দেখ রাগের বহিঃপ্রকাশের স্থান কাল পাত্র কিন্তু আলাদা। প্রতিবাদ হয়ত করা উচিত কিন্তু আবার আমার মনে হয় কখনও কখনও অবজ্ঞার থেকে বড় প্রতিবাদ হয় না। রাস্তার কুকুরকে যত অবজ্ঞা করবে সে তত ডাকা আর ভয় দেখানো বন্ধ করবে। সবার সামনে দাঁড়িয়ে এই নিয়ে গলা তুলে প্রতিবাদ করলে হয়ত বিতর্কের কেন্দ্রে থাকা মানুষটিকে আরও বেশি অপমান করা হবে।” “শোনো তুমি কি আমার সঙ্গে চ্যাট করছো? এতো পুরো ইন্টারভিউ হয়ে গেল দেখছি।” ঠিকই বললে। তোমার বক্তব্যই তো আমার লেখার সা রে গা মা। এই মন্তব্যই হবে লেখার বিষয়বস্তু। “সে তুমি যা করার করো। আসলে কি জানো একটা আইনত স্বীকৃতিই সব নয়। মানসিক আর সামাজিক স্বীকৃতি টাই আসল। তারজন্য এদের সমাজের মূল স্রোতের সাথেই থাকতে হবে। নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে নয়। আর একটা কথা এই আইনত স্বীকৃতি কে মূলধন করেই নিজেদেরকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। হিজড়া পরিচয় পিছনে রেখে আরও অনেক আগে এগোতে হবে তাদেরকেও।” সমকামী ও রূপান্তরকামীদের প্রসঙ্গে একেশ্বরী ম্যাসেঞ্জারে যখন বেশ সপ্রতিভ চ্যাট কাম ইন্টারভিউ দিতে ব্যাস্ত তখনই ডেক্সটপের অন্য পেজে অনলাইনে খোলা একটি ওয়েব জার্নাল। সেখানেই আচমকা নজরে এলো, প্রয়াত চিত্র পরিচালক ঋতুপর্ণ সেনগুপ্তর বডি ল্যাংগুয়েজ প্রসঙ্গে বিষ্ফোরক মন্তব্য করলেন বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী শুভাপ্রসন্ন ভট্টাচার্য। তিনি আঙুল উঁচিয়ে বলেন, “সমকাম কে মানে? কেউ মানে না। ঋতুপর্নর গুনকে আমি সম্মান করি কিন্তু কোনও কারণে পাশে বসলে আমার গা রি রি করতো।” ম্যাসেঞ্জারের আধুনিক মনষ্কার চ্যাট, অন্যদিকে ওয়েব পোর্টালের শুভাপ্রসন্নর এক্সক্লুসিভ বচন যে আমার লেখার সাড়ে সত্যানাশ ঘটিয়ে দেবে তা নিশ্চয় বলার অপেক্ষা রাখে না। ভাবলাম একটা ককটেল পাঞ্চ করবো ফিনিশিং টাচে। হলো উল্টোটাই। স্রেফ তেলে জলের হজবরল পরিবেশন। আরে বাবা লেখাটা শেষ করি কিভাবে? একজন ‘আমি অন্তঃপুরের মেয়ে’ মনে করেন তারা মানুষ, আবার এক প্রথিতযশা চিত্রকর বলেন তাঁর গা রি রি করে। এই ডুয়েল এঙ্গেলের জয়েন্ট ভেঞ্চারটাই ভাবতে গিয়েই রাতের ঘু্মের অন্দরমহলের গাঢ় অনুপ্রবেশ। সেই নিত্যদিনের মতো রবিবারেও সকালে জেদেশ্বরীর ঘুম ভাঙানো নিরন্তন ফোনে। ঘুম ভাঙতেই এবার হোয়াটসঅ্যাপে নজর। সেখানে তার প্রভাতী ম্যাসেজ, “এটা তোমার লেখাতে হেল্প করতে পারে।” সঙ্গে একটা লিংক। অন্য একটা ওয়েবনিউজের একটি খবর। লিংক খুলতেই পেয়ে গেলাম আমার লেখার ফিনিশিং আঁকিবুকি। লিংকের শেষ দুই লাইনে যে লেখা রয়েছে, ‘এখন শুধু অর্ধেক কাজ সম্পন্ন হলো মাত্র। আইনি পরিভাষার ৩৭৭ নম্বর ধারা হিমঘরে ঢুকলো ঠিকই। কিন্তু এটা শুধুমাত্র একটা ম্যারাথন রেসের প্রথম মাইলস্টোন।’ ইউরেকা ইউরেকা। প্রথম মাইলস্টোন তো পৌঁছানো গেল। কি বলো রানি মজুমদার? 



Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours