utsob
 সঞ্জয় সরকার, বিষ্ণুপুরঃ উৎসবের নাম ‘শিকার’। আদিবাসী মানুষদের কাছে বীরত্বের সংস্কৃতি। ভারতের আদিবাসী সম্প্রদায় বরাবরই ছিলেন জঙ্গলের জীবন নিয়ে। তাই হিংস্র জন্তুর সঙ্গে প্রতিনিয়ত লড়াই করে তাঁদের বেঁচে থাকতে হয়েছে। আবার জীবনধারণও করেছেন শিকার করা পশুর মাংস খেয়ে। তাই এই আদিপুরুষদের রক্তে মিশে ছিল শিকার। সময় বদলের সঙ্গে সঙ্গে এখান যা পরিণত হয়েছে ‘শিকার উৎসবে’। 
এক সময়ে জীবনের প্রয়োজনে শিকার এখন ওই সমাজের ধারাবাহিক সংস্কৃতি। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শিকারে যাওয়ার সময় ওই সমাজের যা রীতিনীতি ছিল, আজও অনেক ক্ষেত্রে তা রয়ে গিয়েছে শুধুমাত্র পরম্পরার বাহক হয়ে। 
৫ বৈশাখ বিষ্ণুপুরের জঙ্গলে শিকার উৎসবে এসে এমনটাই জানালেন আদিবাসী মানুষরা। প্রতিবছর নিয়ম ধরে এই দিন বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, মেদিনীপুর এবং ঝাড়খন্ডের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কয়েক হাজার আদিবাসী মানুষ তির-ধনুক, বল্লম, টাঙি, তরোয়াল, কুঠার এমন সব অস্ত্র নিয়ে হাজির হন বিষ্ণুপুরের জঙ্গলে।
 আদি প্রথা মাফিক শিঙ্গা ফুঁকে জঙ্গল ফুঁড়ে শিকারও হয়। আগে জঙ্গলে হরিণ, ময়ূর, খরগোস, সাপ, চিতা আরও অন্যান্য যা চোখের সামনে পাওয়া যেত তাই মারা হত। কিন্তু বর্তমানে পশু সংরক্ষণ আইনের জন্য এসবের কোনটাই শিকারের লক্ষে থাকে না। থাকে শুধু বুনো শুয়োর। শিকারীদের কথায় ‘বনশুয়োর মানুষের ক্ষতি করে। ঝাঁক ঝাঁক বন শুয়োর মানুষের কষ্টের ফসল খেয়ে যায়। জঙ্গলের রাস্তায় ওই শুয়োরের আক্রমণে অনেকের মৃত্যু হয়েছে। তাই আমাদের এই আদি উৎসবে শুধু শুয়োরই মারি’। আদিবাসী ভাষায় ‘সেন্দ্রা’ অর্থাৎ শিকার করতে এসে আগে শিকারীদের দলের প্রতিটি অস্ত্র একত্রীত করে ‘সেন্দ্রা বোঙা’ অর্থাৎ শিকারী ঠাকুরের পুজো দিতে হয়। পুজো করেন তাঁদের ‘দিহরীবাবা’ অর্থাৎ সমাজের পুরোহিত। সারাদিন শিকার শেষে যারা যা শিকার করেছে সে সব নিয়ে যেতে হয় ‘সেন্দ্রাসুতানটান্ডি’-তে। অর্থাৎ আদিপুরুষদের নির্দিষ্ট করে দেওয়া শিকার জমায়েত স্থলে। সেখানে শিকারকে ঘিরে চলবে দেশি মদ ও ঘরে তৈরি হাঁড়িয়া খাওয়ার সঙ্গে ধামসা-মাদলের তালে নাচ। গোটা রাত ওই উৎসবের শেষে সকালে শিকার নিয়ে বাড়ি ফেরা। বাড়িতে গৃহিনীরা শিকারী স্বামীদের আপ্যায়ন করবেন জল দিয়ে পা ধুইয়ে পায়ে তেল মাখিয়ে। স্বামী শিকারে যাওয়ার সময় স্ত্রীরা হাতের শাঁখা পলা খুলে রাখেন। এটাই আদি রীতি। আজও এই রীতির হেরফের নেই। এখন শিকারে জীবনের ঝুঁকি নেই জেনেও আদিকালের প্রথাকে ধরে রেখেছেন উৎসবের অঙ্গ হিসাবে। কারণ স্বামীর পদসেবা করার পর ঘরের মানুষটাই যে নিজে হাতে আবার ওই শাখা-পলা পরিয়ে দেবেন। সংগ্রামী জীবনে এই মধুর স্বাদটুকু কেই বা ছাড়তে চায়? এমন ভালবাসা তো বছরে একবারই মাত্র আসে। 



Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours