Vromon
সুজিত চট্টোপাধ্যায়,কলকাতা, নাট্যকার ও লেখক: অনেকদিন হয়ে গ্যালো , তাই এই উত্তর বঙ্গের ভ্রমণ কথা লিখতে বসে লিখতেই হলো "উত্তরকথা "। ২০১৮ সালের অক্টোবর মাস ।  লক্ষীপুজোর ঠিক দিন দুই আগে ।  আকাশে কোজাগরী পূর্ণিমায় সেজে গুজে  বেরোনোর জন্য চাঁদও  প্রসাধন চর্চা শুরু করে দিয়েছে মনে হয় । বেশ একটা লজ্জা নরম চাঁদ উঠছে আকাশে ।  বাতাসে  হিমেল রেশ । এমন একটা দিনে আমরা খুব কাছের তিনটে পরিবার বেরিয়ে পড়লাম উত্তরবঙ্গের উদ্দেশ্যে ।  যদিও  যতো সহজে বললাম ততো সহজে সবকিছু  হয় নি ।  তারজন্য ঐ যে রবিঠাকুর তাঁর গানে বলেছেনঃ "তুমি ডাক দিয়েছো কোন সকালে , কেউ তা জানে না "।  না ,  কেউ না জানলেও আমরা সেই ডাক আরো অনেক আগে শুনতে পেয়েছিলাম ।  তা না হলে ট্যুর প্ল্যান করে , রিজার্ভেশান করে , থাকার জন্য  ঘর বুক করে ,  একগাদা  লাগেজ ,  যার যার নিজস্ব একটা করে  গোটা বৌ , লটবহর সঙ্গে করে নিয়ে  যাওয়া কি চাট্টিখানি  কথা ? ?  নিন্ম মধ্যবিত্তের সাধ্যের সীমানার বাইরে গিয়েও  ঐ দার্জিলিং মেলের এ সি থ্রী টায়ারে যাবার টিকিটটা পাওয়া গেছিলো ,  তাই রক্ষে ।  না হলে একে পুজোর ছুটি , তায় বাঙালীর ভ্রমণ পিপাসু মন একেবারে "তা থৈ  তা থৈ " নৃত্য করছে ।  শিয়ালদহ স্টেশানে রথ দোলের ভীড় । উত্তরবঙ্গ অনেক আগে জবাব দিয়ে দিতো।  বাঙালীর "উত্তর বাংলা " দর্শন অধরা থেকে যেতো ।  যাই হোক ,  রাতের লুচি আলুর দম ।      আমার ট্যুর প্ল্যানার বন্ধুটি  আমার মতো নয় ।  বেশ করিৎকর্মা । নেমেই দেখলাম একটা দশ আসন বিশিষ্ট  গাড়ী স্টেশানের বাইরে অপেক্ষারত ।  বাঙালী উঠে পড়লো ।  নিউ জলপাইগুড়ির ঘিঞ্জি জনবসতি ছাড়িয়ে ন্যাশনাল হাইওয়ে  ৩১ ধরে কিছুদূর গিয়েই একবারে একটা অন্য জগতে ।  রাস্তার দুধারে শুধু জঙ্গল ।কালো রাস্তাটা যেন  সবুজ শাড়ীর  মাঝে একটা  মিশকালো বিভাজন।প্রকৃতি এক অদ্ভুত  ডিজাইনার ,  অনেক বড়ো আর্কিটেক্ট । ঠিক ছিলো আমরা কিছুটা পাহাড় আর  কিছুটা জঙ্গল ঘুরবো ।  আরো একটা শর্ত  ছিলো ....ট্যুর কোম্পানিগুলোর  মতো ঘোড়ায় জীন চড়িয়ে  ঘুরবো না । যেখানে  ভালো লাগবে সেখানেই একটু বেশী সময় আমাদের পানসি নোঙর করবে ।  তাতে যতোটা যাওয়া যায় , ততোটুকুই  যাবো ।  ঐ ফিরে এসে ট্রেনে বাসে , অফিসে গপ্পো করার জন্য অনেক জায়গায়  যাবার চেষ্টা করবো না । আর এই  বয়সে কতোই বা  দৌড়ানো  যায় ? সে বয়েস পেরিয়ে এসেছি যে । এখন আর কোথাওই  যাবার তাড়া  নেই ।  রবীন্দ্রনাথ  শরণ নিয়েছি  যে ...."আমার সকল  নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায় "। তাই  আর  কিছুরই পরোয়া করিনা ।  সেবক পেরিয়ে একটা গঞ্জমতো অখ্যাত জায়গায় দাঁড়িয়ে আবার সকালের  উপবাস ভঙ্গ করা হলো ।  উপবাস ভঙ্গই  বটে ।  গাড়ীতে  শুকনো খাবার ,  ঠান্ডা পানীয় কিছুই বাদ যায় নি। কিন্তু তবুও .....             শুরু হোক পথ চলা। কখন একসময়  একটু ঘুম লাগা চোখে ন্যাশনাল হাইওয়ে ১০ ধরেছি নিজেই জানি না ।  ড্রাইভার  রাজেশকে  জিগ্গেস করে জানা গ্যালো আমরা এখন কালিম্পংয়ের রাস্তায় ।  আমাদের প্রথম তাঁবু পড়বে শীটংয়ে । কালিম্পংয়ের রাস্তা থেকে একটা ছোট্ট আঁকাবাঁকা রাস্তা পেরিয়ে একটা খুব ছোট্ট ছায়াঘেরা গ্রাম শীটং । এখানেই আমাদের প্রথম তাঁবু ফেলা .....দীঘল লেপচার  হোমস্টে "ইয়াকসা "। বেশ ঝকঝকে । গিয়ে পৌঁছাতেই দার্জিলিং চায়ের উষ্ণ  অভ্যর্থনা। তারপর খাওয়াদাওয়া , সে বর্ণনা না হয় পরে হবে ।  জায়গাটার কথা একটু বলে নেওয়া আবশ্যক ।  বিষয়ী  মানুষের বর্ণনায় ঠিক একটা গামলার মতো ।  চারদিকে  শুধু সুউচ্চ পাহাড় । মধ্যিখানে শীটং। গাছে গাছে কমলালেবু  ফলে রয়েছে ।  ছোটো ছোটো গাছ ।  নিজেকে " আদেখলা " বাঙালী বলতে খারাপ লাগলেও হাত দিয়ে দু চারটে লেবু পেড়ে ফেললাম। সেই সময় লেবু পাকে নি এবং বেশ টক ।  কিন্তু তাতে কি ? সেলফি তোলা এবং ফিরে এসে দেখানোর জন্য সেই লেবুই ছিঁড়তে বাধ্য হলাম । আমাদের আনন্দে জল ঢেলে দিয়ে  দীঘেল সাহেব দুপুরের খাবার জন্য পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন । ডাইনিং টেবিলে বসিয়ে যেভাবে খাওয়াতে লাগলেন উনি ও ওঁর পরিবার ভুলে যাচ্ছিলাম হোমস্টে না শ্বশুরবাড়ীতে এসেছি। বাঙালীর দিবানিদ্রার যে  দুর্নাম আছে , তাকে সত্যিতে পরিণত করতে এবং রাতের আধোঘুমের রেশ আমাদের পৌঁছে দিলো ঘুমের দেশে ।ঘুম ভাঙলো চা পরিবেশনকারীর কলিংবেলে হাতের ছোঁয়ায়।  চা খেয়ে একটু বাইরে বেরোতে যেতেই সাবধান বাণী শুনিয়ে দেওয়া হলো ....."জ্যাদা দুর মৎ যানা সাব,নজদিগই  রহে  না "। হোমস্টের সীমানা পেরিয়ে একটু যেতেই একটা পথের বাঁকে একটা চাতাল  মতো জায়গায়  খোলা আকাশের নীচে বসে রবীন্দ্র সঙ্গীতের ঝুলি খুলে শুরু হলো আমাদের চন্দ্র বন্দনা ।  একে একে " চাঁদের  হাসি বাঁধ  ভেঙেছে ", "আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে" র  গানে গানে আমরা বুঝিয়ে দিলাম আমরা "বাঙালী এবং চাঁদপাগল "।  রাস্তা দিয়ে দুএকটা স্থানীয় মানুষ যাচ্ছিলো । তারা আমাদের গানে গল্পে হাসি দিয়ে বুঝিয়ে গেলো "এই  তো জীবন কালীদা "।  পরের দিন সকালে জলখাবার খেয়ে শীটং থেকে  মংপুতে মৈত্রেয়ী  দেবীর বাড়ী,  যেখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মাসাধিককাল বাস করেছিলেন সেই পূণ্যভূমি এবং সেই বাড়ীর ঠিক উল্টোদিকে  কুইনাইন (যা ছিলো একসময় ম্যালেরিয়ার অব্যর্থ ওষুধ )ফ্যাক্টরী সব দেখে নিলাম ।  ও হ্যাঁ ,  যাবার পথে বয়ে যাওয়া "রঙ্গী" নদীর বারান্দায় একটু বসে ,  ছবি তুলে ,  চা খেয়ে এবং কিছুটা অলস সময় কাটিয়ে , কাটিয়ে দিলাম একবেলা । লিখে ফেললুম একটা  কবিতা, শুধু এমন সময়েই বোধহয় মানুষ কাব্যিক হয়ে পড়ে । আমিই বা  তার ব্যতিক্রমী হই কি করে ? ? মারো গোলি পাঁচশ শব্দে.... তোমাদের শোনাই কবিতাটা... এখানে কবিতা কথা বলে প্রকৃতির সাথে ।  পাহাড়ী গাছপালা ঝরনার সাথে চুম্বনে মাতে ,  কুয়াশারা যেন বা মজায় মেতেছে  শব্দহীন , ভাষাহীন ॥  দুর্বোধ্য , অজানা ভাষায় নির্বাক ক'রে --- "নিষ্প্রভ হয় ....প্রগলভ, সুসভ্য নাগরিক জীবন " ॥ ॥                 ফিরে এসেই খাওয়া দাওয়া করে আবার দৌড় নতুন আবিস্কৃত  "হালহামলা " সানরাইজ পয়েন্টের দিকে । সে এক কঠিন রাস্তা !  এখনো তেমনভাবে রাস্তাঘাট তৈরীই  হয় নি । তবে আমাদের ড্রাইভার রাজেশ বোধহয় জন্ম ড্রাইভার ।  অস্বাভাবিক দক্ষতায় পাহাড়ী পাকদন্ডী বেয়ে পৌঁছে দিলো এমন একটা জায়গায় যাঁর বর্ণনা আমার পক্ষে করা সম্ভব নয় । একদিকে  চা বাগান অন্যদিকে  সিনকোনা চাষ । পাহাড়ের ঢালে  ঢালে  বিষন্ন বিকেলের অন্ধকার আর ফুরিয়ে যাওয়া সুর্য্যের আলো জানান দিচ্ছে  দিনশেষের। হালহামলা থেকে বেরিয়ে ফেরার পথে এক জায়গায় রাজেশ  তার গাড়ী থামিয়ে  দিয়ে বললো ..."যাইয়ে,  দেখকে  আইয়ে,  সাতশ সাল কা  পুরানা  মনাস্ট্রি "। দেখতে গেলাম।  একেবারেই  আড়ম্বরহীন । কিন্তু তার নিঃশব্দতা ,  প্রাচীনত্ব কোথায় যেন এক সম্ভ্রম আদায় করে নেয় এবং  এখানেই মনাস্ট্রির  পিছনে রাজেশ দুরের দিকে আঙুল নির্দেশ করে দেখিয়ে দিলো কাঞ্চনজঙ্ঘা রেঞ্জে স্বর্ণময় চূড়া । হঠাৎ ক'রে মনে হলো ..."স্বর্গ যদি  কোথাও থাকে , তা এখানেই ,  তা এখানেই "। ফিরে এলাম দীঘল লেপচার  নীড়ে ।  সন্ধ্যেয় দীঘল সাহেব তাঁর  বসার ঘরে আমাদের দিয়ে এক তাৎক্ষণিক জলসা বসিয়ে ,  ছবি তুলে,  চুক্তির বাইরে বেরিয়ে দুবার কফি পকোড়ার  আতিথেয়তায় কেন জানি না আমাদের বিষয়ী মনকে বেশ লজ্জায় ফেলে দিলেন ।  আমরাও আমাদের নিয়ে যাওয়া সরপুরিয়া, রসগোল্লায় তাঁদের সবাইকে আপ্যায়িত  করে কিছুটা গ্লানিমুক্ত  হলাম ।  আগামীকাল সকালে চলে যাবো । বেশ জমিয়ে কেটে গ্যালো দুটো দিন । পরদিন  সকালে বিদায় মুহূর্তে উত্তরীয়  প্রদান অনুষ্ঠানের পর  একটা অদ্ভুত আত্মীয় বিয়োগ ব্যাথা অনুভব করলাম ।  পরবর্তী গন্তব্যঃ লামহাট্টা বা  লামাহাটা , তিনচুলে এবং তাকধা। শীটং থেকে বেরিয়ে সারাটা পথই  প্রায় সঙ্গ দিয়ে গ্যালো কাঞ্চনজঙ্ঘা রেঞ্জ ।  মাঝে মাঝে রাস্তায় দাঁড়িয়ে তাঁর রূপ উপভোগ করলাম , ছবি তুললাম ।  কিন্তু "বাঙালী চড়ানোয় " অভিজ্ঞ  রাজেশ বাধ্য করলো  গাড়ীতে তুলে লামাহাটা,  তিনচুলে ঘুরিয়ে তাকধায় পৌঁছে দেবার জন্য ।  লামাহাটাঃ দেখার তো কতো কিছুই আছে ।  তবে যেটা দেখার একটা বিশাল পাইনবন । গল্পে  গল্পে  জানতে পারলাম এই  পাইনবনের প্ল্যান্টেশান  শুরু হয়েছিলো ১৮১৮ সালে ইংরেজ শাষণকালে । একবগ্গা ,  ঋজু পাইন গাছগুলো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ।  যার  সামনে লজ্জা করে বেশীক্ষণ  দাঁড়াতে ।  যেন  শুনতে পাই ঐ  পাইনবনের  উচ্চারিত  ধ্বনি ...."দ্যাখো ,  দ্যাখো তোমরা মানুষেরা যা পারো নি মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে ক্ষুদ্র স্বার্থের কাছে , কিন্তু আমরা পারি "।  বেশীক্ষন  দাঁড়াতে পারলাম না এবং পূর্ব শর্ত অনুযায়ী  তিনচুলেতে একেবারেই প্রায় বুড়ি ছুঁয়ে চলে এলাম তাকধা।  এখানে আমাদের থাকার ব্যবস্থা ছিলো হেরিটেজ বাংলো ৬য়ে ।  এই বাংলোটি একসময়  ছিলো দার্জিলিং রেঞ্জের স্থপতিবিদ বা  আর্কিটেক্টের ।  তিঁনি  যখন দেশ স্বাধীন হবার পর চলে যান তখন দানপত্র করে যান ঐ  বাংলোর  মালী কাম কেয়ার টেকার বা  তত্তাবধায়ককে ।  তাঁরই  বংশধর  মিঃ  থাপা (যিনি এখন হায়ার সেকেন্ডারী স্কুলের  শিক্ষক ও  তাঁর স্ত্রী ) এখন এই  বাড়ীতে হোমস্টে করেছেন ।  অত্যন্ত সুসজ্জিত । প্রতিটি ঘর,  ব্যবস্থাপনায় উপভোগ  করলাম আভিজাত্যের ছোঁয়া । বনেদীয়ানা   কাকে বলে  আরো একবার অনুভব করলাম তাঁর রুচিবোধ ও পছন্দে । সবকিছুই কি আর  লেখ্য ভাষায় প্রকাশ করা যায় ? ভদ্রলোক  ছিলেন না ।  ওঁর  স্ত্রী রাস্তায়  লোক পাঠিয়ে ,  নিজে বাড়ীর দরজায় দাঁড়িয়ে যেভাবে অভ্যর্থনা করলেন তা  সত্যিই  ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।  তাকধায়  কি দেখার ছিলো জানি না কিন্তু ওঁদের স্বামী স্ত্রীর আতিথেয়তায়  এমন কিছু ছিলো যা  অন্য অনেক কিছুকেই ম্লান করে দেয় । ওঁর বাড়ীটাই  একটা ইংরেজ আমলের গন্ধ এনে দিলো । রাতে অনেক গল্পগুজব করলাম ,  দেখলাম একশো বছরেরও  বেশী পুরোনো দূরবীন । পুরোনো  ঐতিহ্যময় আসবাব ।  আর  কিইবা পাবার আছে ? পরেরদিন সকালে ব্রেকফাস্ট করে  বেরিয়ে পড়লাম ডুয়ার্সের পথে ।  তাঁর আগে এখানেও উত্তরীয়  প্রদান এবং ওঁদের সাথে কাটানো কিছু  মুহূর্তের ছবি ফ্রেমবন্দী  করে রাখলাম ।                      আমাদের ড্রাইভার রাজেশ চা বাগান পেরিয়ে , একসময়  আমাদের করোনেশন  ব্রীজের পাশে দাঁড় করিয়ে দ্বিতীয় সারথী বাপ্পা রায়ের হাতে তুলে দিয়ে গ্যালো । এতক্ষণ একটা ভাষাগত সমস্যা কিছুটা ছিলো রাজেশের  সাথে । বাপ্পার সাথে সেই সমস্যটা মিটে যাওয়ায় আমরা যেন সাপের পাঁচ পা দেখলাম ।   বাপ্পা আমাদের ডুয়ার্সের পূর্ব নির্ধারিত  জায়গায় ঠিক সময়ে পৌঁছে দিলো ।একেবারে  "নেওড়া " নদীর ধারে "সোনার গাঁও " রিসর্টে।  খুব ক্ষিধে পেয়েছিলো ।  কোনরকমে  চেক ইন করেই  ডাইনিং হলে । খাওয়া দাওয়া একেবারে  রাজকীয় । পা ডুবে যাওয়া কার্পেটের বিশাল ঘরে থাকার ব্যবস্থাও ।  কাঁচের দেওয়ালময় জানলা দিয়ে হঠাৎ দেখা গ্যালো ময়ূর তার  রাজকীয় ভঙ্গীতে হেঁটে যাচ্ছে ।  একটু দুরের জঙ্গলে  খানিক বাদে হরিণেরও দেখা মিললো ।  রিসর্টের ম্যানেজার বলেই দিয়েছিলেন অনুগ্রহ করে এখানে রিসর্টের বাইরে হাঁটতে  বেরোবেন না ।  জংলী জানোয়ারেরা কিন্তু  এখানে আসে । তখনই চোখ পড়লো  অনেক উঁচু করে বেশ মোটা তারের  বেড়া দেওয়া আছে ।  অতএব,  কথাটা  নিছকই  কথার কথা নয় ।  সন্ধ্যেয়  গাড়ী নিয়ে বেরিয়ে একটু দোকানপাট ,  একটু কেনাকাটা  করতে বেরিয়েছিলাম ।  আমার বন্ধুপত্নীর জন্মদিন  পালনের জন্য প্রয়োজনীয় কেনাকাটা  সেরে  চলে আসলাম ।  সন্ধ্যেটা বেশ আনন্দ মুখর হয়ে উঠলো জন্মদিন  পালন করে ।  পরেরদিন সকালে উঠেই স্নান ও ব্রেকফাস্ট  সেরে বেরিয়ে পড়লাম জলঢাকা নদীর পাড়ে ঝালং ও বিন্দুর উদ্দেশ্যে ।  সারাদিনের প্রোগ্রাম । সঙ্গে প্রয়োজনীয় টুকিটাকি এবং বেশ বড়ো এক ফ্লাস্ক গরম জল ।  আমাদের সাথে টী  ব্যাগ,  কফি ও চায়ের যাবতীয় সরঞ্জাম নেওয়াই থাকে, মায় একটি বেবী  হিটার পর্যন্ত্য । কারন ,  ঐ যে  আমরা চা বেশী পান করি , তাই চাতাল ।  প্রসঙ্গত,  বলে রাখি সম্ভব হলে যাঁরাই এই  ধরনের ভ্রমণে বেরোবেন  তারা যদি আমাদের মতো "চাতাল " হন তাহলে এই সরঞ্জাম আপনাদের প্রভূত খরচই  শুধু বাঁচাবে  না  তৃপ্তিও অনেক বেশী পাবেন । ৬০ মি.লি র  এক কাপ চায়ের দাম ওখানে  দশ টাকা ।  এবার হিসাব করতে থাকুন । যাই হোক ,ফিরে যাই মুল স্রোতে ।   রাস্তায় মহাকাল মন্দিরে  প্রণাম জানাতে গিয়ে আরো এক অভিজ্ঞতার  মুখোমুখি ।  মন্দির বলতে একটা বড়ো গাছের নীচে এক প্রস্তর খণ্ড ।  বাপ্পার কথায়  জানতে পারলাম  এই জাগ্রত মহাকালের কথা ।  হঠাৎ শুনতে পেলাম একটানা  টিং টিং টিং টিং একটা ঘন্টাধ্বনি । যেন আড়ালে থেকে কোনো পুরুত মশাই  ঘন্টা বাজিয়ে পুজো করে যাচ্ছেন ।  বাপ্পা কে  কৌতুহল জানাতেই  ও বললো ..."এটা একটা পোকার  ডাক । খুব অবাক হলাম  ।  নেহাৎ দিনের আলোয় তাই ,  সন্ধ্যেয় হলে ওখানে দাঁড়ানো  চাপ ছিলো । রাস্তায় ভিউ পয়েন্ট  অ্যাপেল রক ও রকি আইল্যান্ড  দেখে চললাম  ঝালং ।  যেতে যেতে সামসিং ও মূর্তি নদীর দেখা মিললো ।  যদিও  জল নেই তবুও নদীর মড়াখাত  দেখেই সন্তুষ্ট  থাকতে হলো ।অবশ্য  সেও দেখারই মতো । ঝালংয়েই  দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে নিয়ে রওনা হলাম বিন্দুর উদ্দেশ্যে ।  একটা ছোট্ট জনপদ ।  কিন্তু গুরুত্ব অপরিসীম ।  জলঢাকা নদীর এপাড়ে ভারত ওপারে ভুটান ।  নদীতে জল নেই ,  কোথাও বা  একহাঁটু জল । সীমান্ত প্রহরীর সাথে খানিক গল্পগুজব ,  ছবি তোলা হলো । এবার ফিরে আসার পথে উপরি পাওনা লাটাগুঁড়ির "মৌলানী মেলা "।যে কোনো জায়গায় যদি কখনো কোনো মেলা পেয়ে যান অবশ্যই সেই মেলা দেখার অনুরোধ রইলো ।  কারন,  মেলা সেই অঞ্চলের  স্বীয় কৃষ্টি ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় । ঐ মেলা রাত আটটার পর শুরু হয় এবং সারারাত ধরে চলে ।  এতো কিছু জানতে পারলাম আমাদের ড্রাইভার বাপ্পা রায়ের সৌজন্যে ।  অন্যান্য অনেক কিছুর সাথে এতো পানের দোকান আমি  আর  কোথাও দেখিনি ।  মেলা পরিক্রমা  শেষে সোনার গাঁওয়ে এসে পরিপাটি ডিনার করে ,  আবার খানিক আড্ডা মেরে ঘুমের দেশে ।  কিন্তু ঘুমাবো  তার কি উপায় আছে । পরদিন সকালে  জঙ্গল সাফারি করে দুপুরের ট্রেনেই যে  ফিরে আসা ।  সকাল  সকাল  থুড়ি ভুল বললাম ভোরের আলো ফোটার  আগেই আমাদের কয়েকজনকে  জঙ্গল সাফারির টিকিটের ব্যবস্থাপনায় যেতে হলো ।  এখানে এক মজা ।  বেশী পয়সা দিতে হবে কিন্তু গিয়ে লাইনে দাঁড়াতে হবে ।  দালালরাজ চলছে , চলবে । দালালদের হাতেই সব ব্যবস্থাপনা ।  তাদের হাতেই কর্তৃত্ব । যাক গে , জঙ্গলের আমন্ত্রণপত্র , গাড়ী ও গাইডের ব্যবস্থা ঠিক করে আমাদের দলের অন্য সদস্যদের আনিয়ে  ঢুকে  পড়লাম গরুমারা ন্যাশনাল ফরেস্টে । খুব যে কিছু দেখতে পেলাম তা নয় । কিছু ময়ূর , দুটো একটা হাতী ,  ব্যস ,  এতোটুকুই ।  আর না দেখতে পাবার আরো  একটা কারন আমার মনে হলো যে ,  আমার আগে বত্রিশটা গাড়ী ,  তাদের  যান্ত্রিক শব্দে কেউই বোধহয় খুশী ছিলো না , তাই সরে  গ্যাছে গভীর অরণ্যের গভীরতায় ।  তবে জঙ্গলের যে নিজস্বতা,  গন্ধ সেটা কুড়িয়ে নিলাম প্রাণ ভ'রে ।  এবার ফেরার পালা ।  গোছগাছ  রাতেই করে রাখা ছিলো ।  কিন্তু ঐ যে,  বাঙালী কোথাও যাবে আর  ব্যালকনিতে  লুঙ্গি গামছা মেলবে  না , তাহলে কিসের বাঙালী ? যতো দামী ঘরই  নাও , ওতে এবং দোকানে গিয়ে দরদস্তুরের মধ্যে দিয়েই যে বাঙালী চেনা  যায় । (সত্যি সবসময়ই  কঠিন ,  মেনে  নিলেই  আনন্দ )।দুপুরের  লাঞ্চ সকালে করে এবং সকালের ব্রেকফাস্ট  প্যাক করে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম । বিদায় ডুয়ার্স ।  বিদায় উত্তরবঙ্গ ।  যদি সত্যি বলতে বলো তাহলে বলবো, যে উষ্ণতা  পাহাড়ে পেয়েছি ,  নীচে নেমে  তার কিছু ঘাটতি  অনুভব করেছি ।  সেটাও  ঠিক বলে বোঝানোর নয়  ।   স্টেশানে পৌঁছে  বাপ্পার বাড়ীতে অপেক্ষায়  থাকা ওর ছোট্ট মেয়েটার জন্য দুটি চকোলেটের  ভালোবাসা   দিয়ে শেষ করলাম উত্তরবঙ্গ ভ্রমণ ।  আর  নয় ।  ঐ তো নিউজলপাইগুড়ি  স্টেশানের মাইকে  জলদগম্ভীর  ও  কেজো গলায় ঘোষিত  হচ্ছে  আমাদের গাড়ীর নাম ও  নম্বর । অতএব , আবার  রবীন্দ্রনাথ .... "এখন আর  দেরী নয়,  ধর গো তোরা হাতে হাতে ধর গো।  আজি  আপন পথে ফিরতে হবে  সামনে মিলন স্বর্গ ॥



Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours