পলাশ মুখোপাধ্যায়, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

চারদিকে শাল পিয়াল নাম না জানা আরও কত গাছ। ঘন গড় জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পায়ে চলা পথ। সামনে পথ দেখিয়ে এগিয়ে চলেছে সুষমা, আমরা পিছনে। যাচ্ছি মর্ত্যে প্রথম যেখানে দুর্গাপুজো হয়েছিল সেই জায়গাটি দেখতে। পশ্চিম বর্ধমানের এই এলাকাটিতে না এলে বোঝাই যায় না এখানেও বাঁকুড়া পুরুলিয়া বা ঝাড়গ্রামের মতই এমন ঘন জঙ্গল আছে। গলার গামছাটাকে ওড়নার মত বুকে ফেলে সেটাকেই হাত দিয়ে পেঁচাচ্ছিল সুষমা। জিজ্ঞাসা করলাম এমন নাম কে রেখেছে? একটু লজ্জা পেয়েই জবাব দিল, মা। তার পরে অবশ্য জানা গেল মা বাবা কেউই বেঁচে নেই। সুষমার এখন তিন কুলে কেউ নেই। একাই থাকে, কত আর বয়স হবে, তিরিশের আশেপাশে। কাছেই দেউল, তার পাশেই ওর বাড়ি। বাপের জমিটা ছিল, পঞ্চায়েত ঘর করে দিয়েছে, সেখানেই থাকে সুষমা। জঙ্গলে কাঠকুটো কুড়িয়ে তা বেচে দিন চলে যায়। মাঝে মধ্যে কাছের আশ্রমে টুকটাক কাজ করে সেখান থেকে কিছু মেলে। সব মিলিয়ে দিনে রোজগার এই তিরিশ থেকে চল্লিশ টাকা মত, তবে রোজ সেটা হয় না। তবে মাস গেলে লক্ষ্মীর ভান্ডার আছে। এতেই খুব খুশি সুষমা। তাই তো আমাদের এক সঙ্গী যখন ওকে কলকাতায় নিয়ে আসার প্রস্তাব দেয়, ভাল ভাল খাবার, পোশাকের লোভ দেখায়, হেলায় তা উড়িয়ে দেয় সুষমা। ও নাকি ভালই আছে? আমরা কুড়িটা টাকা দিতে, সুষমা খুশিতে কি করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। নিজের চটি খুলে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করছে, আবার ধন্যবাদ জানাচ্ছে। ওর খুশি দেখেই বোধ হয় একটু ভিজে এল চোখটা, মেয়েটা এত খুশি হবে জানলে বোধহয় আর কয়েকটা টাকা বেশিই দিতাম না হয়। কুড়ি টাকাতেই এত আনন্দ! 

ঐ জঙ্গলেই কাঠ কাটছিল অভয় এবং তার পোয়াতি স্ত্রী। তাদেরও একই কথা, ভালই আছে তারা। দুটাকায় চাল মেলে, এখান পাঁচশোও মিলছে। অসুবিধা নেই। এরা সকলেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চেনে, তাকে সরানোর কোনও ইচ্ছেই এদের কারও নেই। এই বাংলার প্রধান প্রতিপক্ষ বিজেপির কোনও বড় নেতার নামই তারা কেউই জানে না। এখানেই গড়ে উঠছে পার্থক্যটা। সামনেই পঞ্চায়েত ভোট। গ্রাম বাংলা একটু ঘুরলেই বোঝা যায়, আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে বাংলার বিরোধী দলগুলির প্রস্তুতি কেমন। শহরে যখন নানান দুর্নীতি, মামলায় জেরবার শাসক দল, ডিএ না দেওয়ার কারনে ক্ষোভে ফুঁসছেন সরকারি কর্মীরা, বিভিন্ন ভাতা দেওয়ার জন্য কটাক্ষের তুবড়ি ছোটাচ্ছেন শহুরে শিক্ষিত মানুষ। এসবের আঁচ কিন্তু পড়েনি এই প্রান্তিক মানুষগুলির জীবনে। তারা তাদের নিস্তরঙ্গ অভ্যাসে কিছু সামান্য সুবিধাকেই  আঁকড়ে ধরে মমতাকেই চেনে, চেনে টিএমসিকেই। হ্যাঁ গ্রামের মানুষ কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেসের চেয়ে টিএমসিকেই বেশি চেনেন। 

এখানেই সফল মমতা। আবেগের বশে নয়, সুদক্ষ রাজনীতিক এবং চতুর শাসক হিসেবেই তিনি একের পর এক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। শহুরে মানুষ যখন তাকে উপহাস করছে, তার লক্ষ্মীর ভান্ডার, কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, মোয়াজ্জেম ভাতা প্রভৃতি প্রকল্পকে ভিক্ষার সঙ্গে তুলনা করছে। তখন এই কাজগুলিই মমতাকে আরও কাছে এনে দিয়েছে সুষমা অভয়দের। এত দিনে বিজেপির বোধোদয় হয়েছে, তাই এখন তারা বলছে ক্ষমতায় এলে তারা পাঁচশো নয়, দুই হাজার টাকা করে দেবে। কিন্তু এতে কি ভুলবে গ্রামের সরল মানুষগুলি? তারা তো এই শাসকের প্রতি অনাস্থা দেখিয়ে বিজেপিকে অনেকটাই সমর্থন জানিয়েছিলেন। লোকসভা ভোটে তাই বিজেপি উত্তর ও দক্ষিণ বঙ্গে গ্রামীণ এলাকায়, জঙ্গল অধ্যুসিত এলাকায় বিপুল সমর্থন পেয়েছিল। কিন্তু তার পরে? কেন্দ্রের বিভিন্ন গরিব বিরোধী কাজ, বাংলায় সারাক্ষণ বিজেপি নেতাদের অসংলগ্ন কথাবার্তা, প্রবল গোষ্ঠীদ্বন্দ, একটা বিরোধী দলের জন্য যা সব দিক থেকে খারাপ। মানুষের সেই ভরসার জায়গাটাতেই পৌঁছাতে পারেনি বিজেপি, বামেদের তাত্বিক, উচ্চমার্গের লড়াই এখন ইতিহাস, কংগ্রেস জীবন্ত জীবাশ্ব। নিট ফল, একাই খেলছে তৃণমূল। 

আচ্ছা একটা বলুন তো? শিক্ষক নিয়োগে কজনের চাকরি হবে? প্রাথমিক, উচ্চমাধ্যমিক সব ধরেও  মেরেকেটে পঞ্চাশ হাজার? ডিএ পাওয়া সরকারী কর্মীর সংখ্যা কত? রাজ্য সরকারি কর্মচারী, শিক্ষক ও অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী মিলিয়ে ছয় লক্ষের বেশি মানুষ। অর্থাৎ তথাকথিত এই সরকারি কর্মী বা শিক্ষিত মানুষদের ডিএ বা চাকরি দিলে খরচ যেমন বেশি, তেমনই মাত্র সাড়ে ছয় থেকে সাত লক্ষ পরিবার এতে উপকৃত হচ্ছে। ভোটারের হিসেব ধরলে একটি পরিবারে কমবেশি তিন থেকে চার জন (শহুরে শিক্ষিত পরিবার সাধারণত ছোটই হয়) ধরলে সেটাও তিরিশ লক্ষ পার করবে না। এদিকে শহর ও গ্রাম মিলিয়ে বিভিন্ন আর্থিক অনুদান পাওয়া মানুষের সংখ্যা প্রায় আড়াই কোটির উপরে। এই আড়াই কোটি মানুষ সরাসরি সাহায্য পাচ্ছেন বা পেয়েছেন। তাদের পরিবার ন্যুনতম চার জন করে হলেও প্রায় দশ কোটিরও বেশি। খুব চাপ হয়ে যাচ্ছে? আচ্ছা সহজ হিসেব করা যাক, কলকাতা থেকে দূরে কোনও জেলার একটি গ্রামে সরকারী চাকুরিজীবির সংখ্যা কত হয় সাধারণত? দুই থেকে দশ জন মত, কোথাও বা তাও নেই। কিন্তু গ্রামে মহিলা কত জন থাকেন? কম পক্ষে তিনশো থেকে হাজার। এবার বোঝা গেল লক্ষ্মীর ভান্ডার কেন এত কার্যকরী। 

মমতা তার ভোটের হিসেব বুঝে নিয়েছেন। কিন্তু বিরোধীরা তা এখনও করে উঠতে পারেননি। পঞ্চায়েত ভোটে জেতার জন্য বিরোধীদের মূল এজেন্ডা কি, সেটাই তাদের কাছ থেকে এখনও স্পষ্ট করে পাওয়া যায়নি। সংবাদ মাধ্যমে দেখলাম বাংলার বিজেপির হাল ধরতে আসা মিঠুন চক্রবর্তী বীরভূমে গিয়ে স্থানীয়দের বলেছেন এই এলাকার গ্রাম পঞ্চায়েতে তাদের (বিজেপি) জেতালে তিনি আবার আসবেন। আরও কিছু তারকা নিয়ে এসে গান গেয়ে, সিনেমার ডায়লগ বলে ও নেচে দেখাবেন। আচ্ছা বলুন তো মিঠুনের নাচ দেখার জন্য পঞ্চায়েত ভোটে বিজেপি জিতে আসবে এমন চিন্তা করা যায়? এখনও এটাই বিজেপির অস্ত্র। শুভেন্দু একবার মমতার সঙ্গে দেখা করে তার পরের এক সপ্তাহ শুধু অজুহাত দিতেই ব্যস্ত। গ্রামের মানুষের কাছে প্রতিপক্ষের দুর্বলতা, নিজেদের লক্ষ্য পৌঁছবে কে? বঙ্গ বিজেপিতে তা এখনও স্পষ্ট নয়। তাই সুষমা অভয়রা পঞ্চায়েত ভোট দেওয়ার জন্য কোনও বিকল্পকেই সামনে পাচ্ছেন না। একা মাঠে তাই একাই খেলে যায় টিএমসি, মাঝে মধ্যে তাই অফসাইডও হয় দেদার। কিন্তু বাঁশি দেওয়ার রেফারি কই?

(www.theoffnews.com - West Bengal Panchayat election)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours