শামা আরজু, লেখক, বাংলাদেশ:

'আরে মরছি মরছি, আমি মরছি-তোমরা মইরো না গো, তোমরা মইরো নাগো! '

সিডরের সালটা মনে নেই, কেবল মনে আছে ওই রাতটা। আমি তখন প্রথম সারির জাতীয় পত্রিকাতে নিয়মিত এসাইনমেন্ট পাচ্ছিলাম। সেই সূত্রে পরিচয় তার সাথে। কয়েকদিন ধরে কথা হচ্ছিল, দেখা হয়নি আমাদের কখনো। দেখা হবে সেটাও ভাবিনি। সে রাতে ও পটুয়াখালী দ্বীপে। ফিচার লেখার জন্য। আমরা এটুকু পরিচয়ে কথা বলেছিলাম গোটা রাত। সাহিত্য নিয়ে, নারী নিয়ে, বিপ্লব নিয়ে, শিশু নিয়ে। কি কথা বলেছিলাম তাও মনে নেই। কেবল রেশটুকু মনে আছে আর এইটুকু মনে করেই জন্ম জন্মান্তর পার করে দেওয়ার মত মেয়ে মানুষ আমি, তাও হলো না। আমার কোন দোষ নেই, তবুও হলো না। সবাই বলে এক হাতে নাকি তালি বাজে না, আমি বলি এটা ভুল। এক হাতেও তালি বাজে। 

অনেক বছর পর আমি এখন প্রায় প্রতিদিন একজন মানুষের আসার অপেক্ষা করি। যে মাত্র একটা দিনই পরেছিল এই লুঙ্গি। অনেকদিন ধুইনি।  আমি ঘুমানোর সময় ওর ঘ্রাণ নেওয়ার জন্য এটা নাকের কাছে নিয়ে ঘুমাতাম। একটাই লুঙ্গি আর একটাই গেঞ্জি আমার ঘরে তার। কতদিন আর না ধুয়ে সেটা রাখা যায়! কয়েকদিন আগে ধরে রেখেছিল তারপর আর কয়েকদিন আমি সেটা ঘুমানোর সময় নিতাম না। ভাবতাম এখন তো আর সেই ঘ্রাণ নেই। কিন্তু আজ এই ঝড় বাদলের দিনে, 'আমার মন কেমন করে!' বাতাসের হু হু শব্দ আর থেমে থেমে বৃষ্টি, টিনের চালে। আমি ওর লুঙ্গিটা আজ আবার নিয়ে ঘুমাতে এলাম। কি অবাক কান্ড! আমি নিশ্চিত এটা ওরই গন্ধ। লাফ দিয়ে বসলাম, লিখব বলে। আজকাল কাগজে কলমে আর লিখি না। মোবাইলে ভয়েস কিবোর্ডে লিখি। ছোট্ট দুই রুমের ঘর। তাও নিজের না। পাশেই ছেলে বউ।সেভাবে লিখতেও পারছি না। তবু কেন আজ লেখার ইচ্ছেটা পোড় খাওয়া এই বুকে এমন তীব্রভাবে জেগে উঠলো, জানি না। মোবাইলে চার্জ নেই, চোখ জল-ঘুমে ঝাপসা হয়ে আসছে। তবু সবকিছু ছাপিয়ে আজ আমার লেখার ইচ্ছেটাই আমাকে পেয়ে বসলো। এই লেখার ইচ্ছে, এই পাগল পাগল ঘ্রাণের বিষয়টা মনে করে আমার নিজের কাছেই নিজেকে পাগল বলে মনে হচ্ছে। 

এসব পাগলামি আমার নতুন নয়। কিশোর বেলায় বাবার না থাকা দিনগুলোতে আমি বাবার গেঞ্জি নিয়ে ঘুমাতাম। মেয়েবেলায় ভুল সোয়ামির গেঞ্জি। যৌবনে আনিসের গন্ধ। আমার ওপর জেদ করে আমারই ঘরে বিশটি বেনসন সিগারেট খেয়ে  এমনই এক বৃষ্টির দিনে আনিস চলে গেল। আর এল না। সেই না আসা দিনগুলোতে আনিসের ফেলে যাওয়া সিগারেটের অবশিষ্টাংশ আর যত্নে তুলে রাখা কৌটা খুলে নিয়ে প্রায়ই কাঁদতে বসতাম। সেও কম না। অনেকগুলো বছর। তারপর এল অমিত। যার একটা লাবন্যও লাগে। টানা একবছর কেবল কথাই বলেছি ফোনে। তারপর কি করে যেন একরকম অবসন্নতায় আমি দূর্বল হয়ে পড়েছিলাম, নিজেও টের পেলাম না। আমাদের দু'জনের প্রেম কারো প্রতি কারোই কম ছিল না। কেবল প্রচলিত প্রথার কাছেই আমরা হেরে গেলাম, যেতেই হলো। আমার অমিতকেও আমি হারালাম।

মনের বয়স আমার বরাবরই একইরকম ছিল। তবে প্রেমের তীব্রতা ছিল আনিসের প্রতি। যদিও আজকাল মনে হয় ও আসলে প্রেম নয়, ভান করেছিল প্রেমের।

আমি কিন্তু কারো সঙ্গেই ভান করিনি, তবু হু হু করা বাতাস কেবল আমার বুকেই। আমার বুকের ভেতরই আসলে সিডরের বাস।

(www.theoffnews.com - Bangladesh love)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours