পলাশ মুখোপাধ্যায়, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

সেদিন আমার এক পরিচিত খুব গর্ব করেই বলছিলেন তার মেয়েকে তিনি ইডি বা সিবিআই অফিসারই বানাবেন। এতদিন ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার বানানোর স্বপ্ন দেখলেও এখন তার মনে হচ্ছে এটাই দারুণ ব্যাপার হবে। শুনে একটু মুচকি হাসলাম দেখে বেশ রেগেই গেলেন মনে হল। গলাটা একটু চড়িয়েই বললেন “এদের কি ক্ষমতা দেখছেন? বাঘা বাঘা লোকেদের কেমন ভয় পাইয়ে দিয়েছে। আর কোনও পেশায় এমন জবরদস্ত ব্যাপার স্যাপার আছে?“ হেসে না বলতেই আশ্বস্ত হলেন। আসলে রাশি রাশি টাকা উদ্ধার হচ্ছে, আর ইডি ক্রমশ সিবিআইকে পাশ কাটিয়ে বাঙালির আলোচনায় ঢুকে পড়ছে। জেগে ঘুমানো জনগণ ফের একটা নতুন দিবাস্বপ্নের আনন্দে মশগুল হচ্ছে।   

সিবিআই আমাদের পরিচিত। কিন্তু ইডি সম্পর্কে এতটা জ্ঞান আমাদের এতদিন ছিল না, যদিও ইডি বহু বছর ধরেই কাজ করছে। ইডি মূলত অর্থ মন্ত্রকের রাজস্ব বিভাগের অধীনে কাজ করে। এটি ১৯৫৭ সালে বৈদেশিক মুদ্রা-সম্পর্কিত লঙ্ঘনের মামলাগুলি দেখার জন্য গঠিত হয়েছিল। কিন্তু ২০০২ সালে, পিএমএলএ প্রবর্তনের পর, এটি আর্থিক জালিয়াতি এবং অর্থ পাচারের মামলাগুলি নিতে শুরু করে, যেগুলির অধিকাংশই অপরাধমূলক প্রকৃতির। কিন্তু ইডির বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ, এই সংস্থা মূলত কেন্দ্রীয় সরকারের হয়ে বিরোধী দলগুলির নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযান এবং জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্যই সক্রিয়। গত কয়েক বছরে ইডির নিশানায় থাকা ব্যক্তিদের তালিকায় একটু নজর দিলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। পি. চিদাম্বরম হোক অথবা ডি.কে-শিবকুমারের মতো কংগ্রেস নেতা, জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস পার্টির শরদ পাওয়ার এবং প্রফুল প্যাটেল হোক বা সমাজবাদী পার্টির প্রধান অখিলেশ যাদব, তৃণমূল কংগ্রেসের অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় হোক বা ঝাড়খণ্ডের হেমন্ত সোরেন, বহু বিরোধী নেতা গত কয়েক মাসে ইডি তদন্তের মুখোমুখি হয়েছেন। 

উল্টো দিকে তাকালেই বোঝা যাবে শাসক দলের অভিযুক্ত নেতাদের প্রতি ইডির নরম মানসিকতা।  বিরোধীরা বার বার অভিযোগ করেছে যে, বিজেপির নেতাদের এবং অন্যান্য দল থেকে যারা এনডিএ-তে যোগ দিয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। উদাহরণস্বরূপ, সারদা চিট ফান্ড কেলেঙ্কারির অভিযুক্ত মুকুল রায় এবং হিমন্ত বিশ্ব শর্মাকে এখনও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি৷ মুকুল তৃণমূল কংগ্রেস থেকে বিজেপিতে চলে যান, হিমন্তও কংগ্রেস থেকে বিজেপিতে যোগ দেন। শুভেন্দু অধিকারীর ক্ষেত্রেও কথাটি খাটে বৈকি। এটা অবশ্য নতুন নয়। ইউপিএ সরকারের আমলেও ইডি-র বিরুদ্ধে বিরোধী রাজনীতিকদের হয়রানির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার অভিযোগ উঠেছে। জগন মোহন রেড্ডির বিরুদ্ধে একটি মানি লন্ডারিং মামলা নথিভুক্ত করা হয়েছিল, যখন তার ওয়াইএসআর কংগ্রেস পার্টি অন্ধ্র প্রদেশে কংগ্রেসের বিরোধী ছিল। সিবিআই এফআইআর-এর ভিত্তিতে ইডি তার তদন্তে বলেছিল যে ২০০৪ সালের মে থেকে, যখন তার বাবা ওয়াই.এস. রাজশেখর রেড্ডি কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, জগন বেশ কয়েকটি কোম্পানি চালু করেছিলেন যেখানে রাজ্য সরকারের সিদ্ধান্তের সুবিধাভোগীরা বিনিয়োগ করেছিলেন। পরে অবশ্য তা আর এগোয়নি। 

 গত ১৭ বছরের দিকে তাকালে দেখা যাবে, ফৌজদারি আইন প্রণীত হওয়ার পর থেকে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট ৫৪০০টিরও বেশি মানি লন্ডারিং মামলা দায়ের করেছে তার মধ্যে এখনও পর্যন্ত মাত্র ২৩জনের বিরুদ্ধে দোষ সাব্যস্ত হয়েছে। অভিযানের নাটকীয় বৃদ্ধির পরেও ইডির তদন্তে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার হার ০.৫% এর মতো। এ থেকেই বোঝা যায় ইডি অভিযান প্রচুর চালালেও অভিযুক্তদের শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের  সাফল্যের হার কতটা। 

ইডির থেকে অবশ্য অনেকটাই ভাল অবস্থা সিবিআইয়ের। সিবিআই ডিরেক্টরের দাবি অনুযায়ী তাদের সাফল্যের হার নাকি ৬৭% এর আশেপাশে। কিন্তু অঙ্কের মারপ্যাচ এড়িয়ে দেখা যাচ্ছে সিবিআইয়ের বিভিন্ন তদন্তে ব্যর্থতার তালিকাও বেশ লম্বা এবং  সাফল্যের হার বেশ হতাশা জনক। ২০০৪ সালের ২৫ মার্চ বিশ্বভারতীর রবীন্দ্রভবন থেকে চুরি যায় নোবেল পদক। সিবিআই ব্যর্থ হয় নোবেল চুরির কিনারা করতে।  হাইকোর্টে এক  জনস্বার্থ মামলার শুনানিতে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি রাকেশ তিওয়ারি সিবিআইকে তীব্র ভর্ৎসনা করেন। প্রধান বিচারপতি বলেন, “নোবেল আমাদের জাতীয় সম্পদ। অথচ তা উদ্ধারের জন্য সে অর্থে কোনও ইতিবাচক পদক্ষেপ এখনও নিতে পারেনি সিবিআই। কেন আপনারা কিনারা করতে পারলেন না এত বছরেও?”এছাড়াও বড় বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে সিবিআইয়ের ব্যর্থতার কয়েকটা উদাহরণ দেওয়া যাক। প্রথমেই আসি ২জি কাণ্ডে। প্রায় ১ লক্ষ ৭৬ হাজার কোটি টাকার ২জি কেলেঙ্কারি কাণ্ড থেকে বেকসুর খালাস হন প্রাক্তন টেলিকম মন্ত্রী এ রাজা ও ডিএমকে নেত্রী কানিমোঝি। কারণ অভিযোগ প্রমাণে ব্যর্থ হয় সিবিআই। আদালতে বিচারকের কাছে ফের তাদের অপদার্থতার জন্য ভর্ৎসিত হন সিবিআই আধিকারিকেরা। এখানেই শেষ নয় রয়েছে আরুষি হত্যা কাণ্ড, কয়লা কেলেঙ্কারি, কর্ণাটকের বেল্লারিতে অবৈধ খনি কেলেঙ্কারি সহ একাধিক তদন্তের ব্যর্থতা। সারদা, রোজভ্যালি বা অন্যান্য চিট ফান্ড তদন্তগুলির কথাই যদি ধরি তাহলে সেখানেও তো অগ্রগতির কোনও চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না, এতগুলি বছরের পরেও। 

এই যে হঠাৎ তৎপর ইডি, সিবিআই। কয়লা পাচার, গরু পাচার, শিক্ষা কেলেঙ্কারিতে ব্যপক ধরপাকড়। সারদা সহ নানা চিটফান্ড কাণ্ডে হঠাৎ ঢেউ উঠেছে, রাশি রাশি টাকা মিলছে, ডেকে পাঠানো হচ্ছে নেতা নেত্রী তাদের আত্মীয়দের। এই নাটক কিন্তু নিয়মিত নিরন্তর, আপনি আমি পুলকিত হচ্ছি, সংবাদ মাধ্যম উত্তেজিত হচ্ছে। বাস্তবে কিন্তু কিছুই হচ্ছে না। আপনার সাময়িক জেগে ওঠা পুলকের মজা নিন, কিন্তু ইতিহাস বলছে এতে কোনও সাংঘাতিক পরিবর্তনের আশা না করাই ভাল। যে মামলায় কেন্দ্রের বিরোধী দলের নেতাদের ডেকে পাঠিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে তৎপর ইডি, সিবিআই, সেই একই মামলাতে শাসক দলের নেতারা বসে থাকেন নিশ্চিন্ত মনে। বড্ড চোখে লাগে। মাঝে মধ্যে কোনও কোনও তদন্ত কোনও একটা বিশেষ কারনে জেগে ওঠে আবার তা ঘুমিয়ে পড়ে বিশেষ কোনও কারনেই। ইডি, সিবিআই তাই সিনেমা, সিরিজেই ভাল লাগে, জোশ জাগায়। বাস্তবে নয়।

(www.theoffnews.com - ED CBI politics)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours