তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:

১৯১৯ সাল। সারা বাংলা জুড়ে স্বদেশী আন্দোলনের জোয়ার। কলকাতা, খুলনা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম সবত্রই স্বদেশী ভাবধারায় জেগে উঠছে এক নতুন প্রজন্ম। এখানে সেখানে প্রতিদিন গড়ে উঠছে ছোটখাটো বিপ্লবীদের দল। এমন কয়েকটি বিপ্লবীদের আড্ডায় ঠিক হলো, সবাইকে এক ছাদের তলায় আনতে হবে। তবেই স্বদেশী আন্দোলনে সফলতা আসবে। তার জন্য সেরা উপায় হল দুর্গা পুজো। ঠিক করা হলো, দুর্গা পুজোকে উপলক্ষ করে স্বদেশী চেতনায় উদ্বুদ্ধ যুবকদের একত্র করা হবে। উৎসবও হবে আর দেবী বন্দনার সঙ্গে সঙ্গে দেশ মাতৃকার বন্দনায় তরুণ প্রজন্মকে জাগরিত করার আয়োজন চলবে।

এর মধ্যেই ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে গণ আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস বারোয়ারি দুর্গোৎসবকে বেছে নিলেন। ১৯২৭ সালে বার্মার জেল থেকে ছাড়া পেয়ে কলকাতায় ফিরে এসে নেতাজী বিভিন্ন সামাজিক এবং সেবামূলক কাজে জড়িয়ে পড়েন। সে সুবাদে পরবর্তীকালে তিনি বেশ কিছু বারোয়ারি দুর্গা পুজোর সঙ্গে যুক্ত হন। দক্ষিণ কলকাতার আদি লেক পল্লীর পুজো, মধ্য কোলকাতার ৪৭ পল্লীর পুজো, উত্তর কলকাতার বাগবাজার, কুমারটুলি, সিমলা ব্যায়াম সমিতি- এই বারোয়ারি পুজোগুলোর সঙ্গে নেতাজী বিভিন্ন সময়ে যুক্ত ছিলেন। ১৯২৬ সালে উত্তর কলকাতার মানিকতলায় কংগ্রেস নেতাদের তত্ত্বাবধানে আয়োজিত হয় সার্বজনীন দুর্গোৎসব।

তিনি পুজোগুলোয় উপস্থিত হয়ে সেখানকার অধিবাসীদের মধ্যে একতা আর জাতীয় চেতনা গড়ে তুলতে চেষ্টা করতেন। দুর্গা পুজোকে উপলক্ষ করে এই অঞ্চলের মানুষের মনে স্বদেশী ভাবধারা জাগিয়ে তোলাই ছিল এই পুজোর উদ্যোক্তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য। এসব পুজো প্রাঙ্গণে পুজোর ক'দিন স্বদেশী গান-বাজনার ব্যবস্থা হতো। স্বাধীনতা সংগ্রামী চারুচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও এসব সার্বজনীন দুর্গা পুজোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। ফলে পূজা মণ্ডপগুলো হয়ে উঠলো স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মিলনস্থল। নেতাজী পুজো প্রাঙ্গণে উপস্থিত হলে তাকে দেখার জন্য মানুষের ঢল নামতো।

সিমলা ব্যায়াম সমিতির উদ্যোগে পরিচালিত বারোয়ারি পুজোয় সুভাষ চন্দ্র বোস ও শরৎচন্দ্র বোস প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। ঋষি অরবিন্দ ও বাঘা যতীনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী যুগান্তর দলের নেতা বিপ্লবী অতীন্দ্রনাথ বসু সিমলা ব্যায়াম সমিতির প্রতিষ্ঠা করেন। এই সমিতি ছিল লাঠি খেলা, তলোয়ার চালনা, কুস্তি খেলা প্রভৃতি শেখার প্রধান আখড়া। দেশমাতৃকার আরাধনার উদ্দেশ্য নিয়ে অতীন্দ্রনাথ ১৯২৬ সালে সিমলা ব্যায়াম সমিতির উদ্যোগে দুর্গোৎসব শুরু করেন। সারা বছরের শরীর চর্চা আর সাহসিকতার পরীক্ষার দিন হিসেবে বেছে নেওয়া হতো মহাষ্টমীর দিনটিকে। এই দিনটি তারা বীরাষ্টমী দিবস হিসেবে পালন করতেন। 

এই বীরাষ্টমী অনুষ্ঠানে দেবী দুর্গার সামনে লাঠি খেলা, ছুরি খেলা, কুস্তি, মুষ্টিযুদ্ধ আর তরবারি খেলার মাধ্যমে সাহস আর শক্তি দেখানোর পরীক্ষা হতো। সুভাষ চন্দ্র বোসের সঙ্গে এই বারোয়ারি পুজো কমিটির গভীর সম্পর্ক ছিল। তিনি বেশ কয়েক বছর এই বীরাষ্টমী উৎসবের উদ্বোধন করেছিলেন। ১৯২৮ সালের সিমলা ব্যায়াম সমিতির তৃতীয় বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, সে বছর খুব জাঁকজমকভাবে বীরাষ্টমী উৎসবের আয়োজন করা হয়েছিল। উৎসবে উপস্থিত ছিলেন শরৎচন্দ্র বোস, সুভাষচন্দ্র বোস, ভুপেন্দ্রনাথ দত্ত, উপেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়, কিরণ মুখোপাধ্যায়, যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তের মতো প্রখ্যাত ব্যক্তিরা।

১৯৩০ সালে নেতাজী কলকাতা পুরসভার মেয়র নির্বাচিত হন। ওই বছরেই সিমলা ব্যায়াম সমিতি সভাষচন্দ্র বসুকে প্রথম কোনো সার্বজনীন পুজো কমিটির সভাপতি নিযুক্ত করে। নেতাজীর উদ্যোগে ও স্বদেশী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে সিমলা ব্যায়াম সমিতির পুজোতে প্রতিমাকে তখন দেশীয় খাদি বস্ত্র পরানোর চল শুরু হয়। দেবীর পরনের অলঙ্কার সবই মাটির। অস্ত্র দেশীয় লোহা, তামার। বীরাষ্টমী উৎসব ছাড়াও মণ্ডপে পুতুল খেলা, যাত্রা পালা ও কবিয়াল গানের মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরা হতো।

এছাড়াও পুজো প্রাঙ্গনগুলোতে বিভিন্ন বাণী লেখা পোস্টার শোভা পেত। সে সময়ের ইংরেজি পত্রিকা ‘অ্যাডভান্স’ এ সিমলা ব্যায়াম সমিতির পুজোকে ‘স্বদেশী ঠাকুর’ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। ব্রিটিশ সরকার ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোতে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করার সাহস করতো না। কিন্তু সিমলা ব্যায়াম সমিতির পুজোয় বিপ্লবীদের অংশগ্রহণ বেড়ে যাওয়ায় ১৯৩২ সালে ইংরেজ সরকার এই পুজোকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। পরপর তিন বছর এ পুজো নিষিদ্ধ ছিল। ১৯৩৯ সালে আবার নতুন করে এই পুজো শুরু হয়। এবার এ পুজোয় অগ্রণী ভূমিকা নেন স্বামী বিবেকানন্দের ভাই মহেন্দ্র দত্ত। 

১৯২৯ সালে বাগবাজারের এই পুজোয় এক প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। ১৯৩০ সালে কলকাতা পুরসভার ওল্ডারম্যান দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় বাগবাজার সার্বজনীন দুর্গোৎসব কমিটির সভাপতি হন। তারই উদ্যোগে এই পুজো এক নতুন রূপ পায়। দেশাত্মবোধচ্ছতিনি এই পুজোর নামকরণ করেন, ‘বাগবাজার সার্বজনীণ দুর্গোৎসব ও প্রদর্শনী’। প্রকৃতপক্ষে ওই বছর থেকেই এই পুজোর গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের শুরু। 

এই দুর্গাপুজোর যে বিশেষ প্রদর্শনীর আয়োজন করা হতো, তা স্বদেশী শিল্প মেলায় রূপান্তরিত হয়। দুর্গাচরণের উদ্য‌োগেই পুজোর সঙ্গে যুক্ত হয় দেশীয় শিল্প সম্পর্কিত একটি পূর্ণাঙ্গ প্রদর্শনী। গ্রামীণ শিল্পের সঙ্গে কলকাতার মানুষদের পরিচয় করিয়ে দিতেই মূলত তাঁর এই পদক্ষেপ। সে বছরই সুভাষচন্দ্র এই পুজোর সঙ্গে যুক্ত হন। সুভাষ চন্দ্র ১৯৩৮-১৯৩৯ সাল পর্যন্ত এই দুর্গোৎসব কমিটির সভাপতি ছিলেন। এছাড়া ১৯৩০ এবং ১৯৩৯ সালে তিনি বাগবাজারের সার্বজনীন দুর্গোৎসবের সমাপ্তি অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন।

সুভাষ চন্দ্র বোসের নেতৃত্বে বাংলার বিভিন্ন পূজা মণ্ডপগুলোতে স্বদেশী আন্দোলনের ভাবনা তীব্র হতে থাকে। সেই সময় অনুশীলন সমিতির লাঠি খেলা, শরীর চর্চা ইত্যাদি প্রদর্শন করার জায়গা ছিল বাগবাজার সার্বজনীন পূজা প্রাঙ্গণ। এই অনুষ্ঠানটি হতো বীরাষ্টমী উৎসবের দিনে। ১৯৩৬ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাইঝি সরলা দেবীর পরিচালনায় বাগবাজারে সর্বপ্রথম বীরাষ্টমী উৎসব শুরু হয়। এই পুজোর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “কাপুরুষতা, ভীরুতা সব মায়ের চরণে অর্পণ করে দেশমাতৃকার পুজোর জন্য তৈরি হতে হবে। সে পূজার জন্য প্রয়োজন শুধু ত্যাগ।”

উল্লেখ্য, আজও মহাষ্টমীর দিনে এখানে বীরাষ্টমী উৎসব পালিত হয়। জাতীয়বাদী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে এই পুজোর সূচনা বলে এই দুর্গা পুজোকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল স্বদেশ ভাবনার এক নব জাগরণ। সুভাষ চন্দ্র ছাড়াও আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, নলিনীরঞ্জন সরকার এবং আরও অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি এই পুজোর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

পরাধীন ভারতবর্ষ তখন স্বাধীনতা আন্দোলনে উত্তাল। বিরাট জনসমাগম দেখলেই ইংরেজরা ভয় পেতে শুরু করে। এভাবেই বারোয়ারি পুজোর মাধ্যমেও বহু মানুষকে একত্র করার পরিকল্পনা তখন পরাধীন দেশের বিভিন্ন অংশে শুরু হয়ে যায়। খানিকটা এভাবেই উদ্বুদ্ধ হয়ে ১৯৩২ সালে হরিমোহন পালের সভাপতিত্বে এবং সম্পাদক দ্বারিকানাথ দাসের নেতৃত্বে কুমোরটুলি অঞ্চলের কিছু যুবক কুমারটুলি সার্বজনীন দুর্গোৎসবের শুভ সূচনা করেন।

দুর্গা পুজোর মহাষ্টমীর দিনে অনুশীলন সমিতির উদ্যোগে লাঠি খেলা, শরীর চর্চাসহ বিভিন্ন অস্ত্র খেলার আয়োজন করা হয়।  

১৯৩৮ সালে সুভাষ চন্দ্র বোস এই সার্বজনীন পুজো কমিটিরও সভাপতি নির্বাচিত হন। তবে সে বছরই দুর্গা পুজোর পঞ্চমীর দিন পূজামণ্ডপটি ভস্মীভূত হয়। ফলে সে বছর পুজোটি নিরানন্দভাবে সম্পন্ন হয়। তখন নেতাজীর অনুরোধে ভাস্করশিল্পী গোপেশ্বর পাল এই পুজোতে নতুনত্ব নিয়ে আসেন।

এভাবে দুর্গােপুজোর মাধ্যমে সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়তে থাকে স্বদেশী চেতনার এক নব জাগরণ। বিভিন্ন জায়গায় সার্বজনীন পুজোর মাধ্যমে ঘটতে থাকে ব্রিটিশ বিরোধী চেতনার এক নব উন্মেষ। সে উদ্যোগের মধ্যমণি হিসেবে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোসের নাম জড়িয়ে থাকলেও তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আরও অনেক সাহসী বিপ্লবী যোদ্ধার নামও। বাঙালির ঐতিহ্য, সাহসিকতা, আত্মসম্মানবোধ এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের এক পর্ব এর মধ্যে দিয়ে সূচিত হয়।

This article is in Bengali language. This is a brief history about Durga Puja, the journey from a Zamindari status symbol to a nationalism project. The ostentatious celebration of Durga Puja helped the zamindars in asserting their influence in an era of drastic political and social change in Bengal.

রাজ্যের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র মুকুটমণিপুর থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে অম্বিকানগর। ভগ্ন রাজবাড়িতে লুকিয়ে রয়েছে অগ্নিযুগের ইতিহাসও। পুরোনো স্মৃতি সম্বল করে দাঁড়িয়ে রয়েছে ভাঙাচোরা দালান, রাসমঞ্চ। কান পাতলে শোনা যায় বাংলার বিপ্লবীদের পদধ্বনি। সেই গল্পও শোনালেন গৌরীশঙ্কর ও বিশ্বজিৎ। অম্বিকানগর রাজ পরিবারেই জন্মে ছিলেন বীরযোদ্ধা রাজা রাইচরণ ধবলদেব। তিনি ছিলেন ষষ্ঠতম রাজা। পরবর্তী যে রাজপ্রাসাদের ঐশ্বর্য ছেড়ে তিনি বেছে নিয়েছিলেন বিপ্লবের দুর্গম পথ। ব্রিটিশ শাসন থেকে দেশকে মুক্ত করার শপথ নিয়ে বিপ্লবীদের দলে নাম লিখিয়েছিলেন। তাঁর নেতৃত্বেই জঙ্গলমহলে গড়ে উঠেছিল বিপ্লবী বাহিনী। নিয়মিত যাতায়াত ছিল প্রফুল্ল চাকী, বারীন ঘোষ, ভূপেশ দত্ত, নরেন গোঁসাইদের। এই রাজবাড়িই ছিল তাঁদের মন্ত্রণাকক্ষ। গৌরীশঙ্কর বলেন, 'অম্বিকানগর থেকেই গভীর রাতে ঘোড়ার পিঠে চড়ে বিপ্লবীরা যেতেন দুর্গম ছেন্দাপাথরে গোপন ডেরায়। সেখানে গুহার মধ্যে ছিল বোমা, বন্দুক-সহ নানান অস্ত্র তৈরির গুপ্ত কারখানা।

হ্যাঁ কারখানা। তবে বিপ্লবীদের এই সব কর্মকাণ্ডের নিয়মিত খোঁজ রাখত ব্রিটিশ গুপ্তচররা। একবার পুরীর পান্ডার ছদ্মবেশে এক গুপ্তচর আশ্রয় নিয়েছিল অম্বিকানগর রাজবাড়ির সিংহদ্বারের কুঠুরিতে। পরে চার্লস টেগার্ট বিশাল বাহিনী নিয়ে রাজবাড়িতে হানা দেয়। আলিপুর বোমা মামলায় গ্রেপ্তার হন রাজা রাইচরণ ধবলদেব ও তাঁর তিন সঙ্গী। যদিও পরবর্তীতে রাজসাক্ষী নরেন গোঁসাই খুন হওয়ায় প্রমাণের অভাবে মুক্তি পেয়ে যান রাজা রাইচরণ সহ বহু বিপ্লবী। মুক্তি পেয়ে সেবার দুর্গাপুজোর ষষ্ঠীর দিন সঙ্গীদের নিয়ে অম্বিকানগরে ফেরেন রাইচরণ। তার কয়েক বছর পরেই ১৯২৬ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। রাইচরণের সময়কালে পুজোর ক'দিন অম্বিকানগরে আত্মগোপন করে থাকতেন বহু বিপ্লবী।'

আর এখন দুর্গাপুজো হল ভোটের রাজনীতির অঙ্গ এবং কর্পোরেটদের মুনাফার উৎস যার সঙ্গে সাধারণ মানুষের কোনো সম্পর্ক নেই। তখন দুর্গাপুজো ছিল দেশপ্রেমিকদের সাধনার মন্ত্র, এখন কি চলছে তা তো মানুষ স্বচক্ষেই দেখছে।

(www.theoffnews.com - Puja Bengali freedom fighters)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours