ইরানী বিশ্বাস, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, নাট্যকার ও পরিচালক, বাংলাদেশ:

‘নারী’ শব্দটি যেন সৌন্দর্য্যের প্রতীক হিসেবে ধরে নেওয়া হয়েছে মনুষ্য সমাজে। নারীর সৌন্দর্য্য মানেই গৌরবর্ণ, উন্নত নাসিকা, ব্যক্র গ্রীবা, স্ফীত বক্ষ, কুটিল কোটিদেশ বোঝানো হয়ে থাকে। সৌন্দর্য্যের সংজ্ঞা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেশ, কাল, সংস্কৃতি অনুযায়ী বদলায়। যুগে যুগে নারীর রূপ এবং সৌন্দর্য্য নিয়ে রয়েছে অনেক কড়চা। তবে কোন পুরুষ যখন কোন নারীর সৌন্দর্য্যের প্রকাশ করে তখনই ঘটে বিপত্তি। কখনো নারীর সৌন্দর্য্যের বহিঃপ্রকাশে পুরুষ হয়েছেন প্রশংসিত, আবার কখনো ঘটেছে তার উল্টা। অর্থাৎ নারীর রূপের প্রশংসা করতে গিয়ে সমাজের কাছে হেও হয়েছেন। এমনকি আইনের আওতায় তাকে কারাবদ্ধ করার নজিরও কম নেই। 

সৃষ্টির উষালগ্ন থেকে সৌন্দর্য্যের প্রতি মানুষের আকর্ষণ এবং আরো সুন্দর হয়ে ওঠার প্রবণতা লক্ষনীয়। সময় বদলেছে, বদলেছে মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গি। কারণ আধুনিক প্রযুক্তির দৌলতে পুরো বিশ্বকে আধুনিকতা পেয়েছে মনুষ্য সমাজ। তাই সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পাল্টে যাচ্ছে সৌন্দর্য্যের ব্যাখ্যা, ধরণ, মাধ্যম ও উপাদান।

নিজেকে রঞ্জিত করার উদ্ভব ঘটে সম্ভবত সর্বপ্রথম আফ্রিকায়। পরবর্তীতে অর্থাৎ খ্রিষ্টের জন্মের দশ হাজার বছর পূর্বে মিশরীয়রা সর্বপ্রথম এই সৌন্দর্য্য চর্চা বা নিজেকে অন্যের চোখে আকর্ষনীয় করার বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠে। ধারনা করা হয়, এ সময় থেকেই বিভিন্ন ধর্মীয় বা সামাজিক আচার অনুষ্ঠানে বিভিন্ন ধরনের সাজসজ্জার প্রচলন শুরু হয়। মিশরীয়দের মমিগুলোতে এ ধরনের সাজসজ্জা পরিলক্ষিত হয়।

আদিম যুগে মানুষের আত্মরক্ষার কোন স্থান ছিল না। বন্যপ্রানী থেকে নিজেদের রক্ষা, আর বিরূপ প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার জন্য নিজেকে নানা বর্ণে রঞ্জিত করতো। এছাড়া পশু শিকারের সুবিধার্থে নিজেদেও শরীরে ব্যবহার করত মাটি, পাথর, বিভিন্ন গাছের পাতা, ফুল, ফল থেকে আবিস্কৃত রঞ্জক পদার্থ, যা দিয়ে বর্ণচোরা হতে নিজেদের গায়ে উল্কি বা নকশা আঁকতো।

যুগে যুগে মানুষ নিজেকে অন্যের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলতে কিংবা কখনো আত্মতৃপ্তি লাভে নিজেকে সাজিয়েছে ভিন্ন ভাবে। আদি থেকে শুরু করে আধুনিক যুগ পর্যন্ত নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সময়ের সঙ্গে তারা নিজেদেরকে সাজিয়েছে নানান কৌশলে, রঙে, বর্ণে, আবরণে এবং আভরণে। এ সময়ে প্রকৃতি থেকে আহোরিত বিভিন্ন মূল্যবান উপাদানই ছিল মানুষের সৌন্দর্য চর্চার নিত্যসঙ্গী। পশুর চর্বি থেকে তৈরি হতো মানুষের ত্বকের জন্য ময়েশ্চারাইজার। যা বর্তমান যুগে স্কিন কেয়ার রুটিনে অপরিহার্য। অলিভওয়েল, নানারকমের খড়ি মাটি, রঞ্জক পদার্থ, ফুলের নির্যাস, পশুর চর্বি, পাতার নির্যাস, সামুদ্রিক লবণ, ফলের রস, সুগন্ধি কয়লা, গোলাপজল, মধু, বিভিন্ন রকমের তেল ও মসলা, হেনা, জাফরান, ইত্যাদি উপকরন প্রাচীনকাল থেকে এখন পর্যন্ত রূপচর্চার কাজে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

প্রসাধনী শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ ‘কসমেটিকস’ থেকে খ্রিষ্টীয় ১৭ শতকে। মূলত গ্রীকরাই এই শিল্পকে দিয়েছে অনন্য মাত্রা। পরবর্তীতে রোমানরা এই ক্ষেত্রে অনেক অবদান রাখেন। ধীরে ধীরে সভ্যতার ক্রমবিকাশ ঘটার ফলে মধ্যপ্রাচ্য, চীন, জাপান, ইউরোপ, আমেরিকা এবং অস্ট্রেলিয়া সহ অন্যান্য দেশে প্রসাধনী শিল্পের বিকাশ ঘটে। ধারনা করা হয় ১৯০০ সালের দিকে অভুতপূর্ব স্থান দখল করে নেয় প্রসাধনী শিল্প। মেকাপ বা ত্বকের যত্নের বিষয়টি রীতিমতো বিখ্যাত হয়ে ওঠে অভিজাত মহলে। ত্বকের রঙ সাদাটে রাখার প্রচলনই ছিল তখনকার রীতি। ১৯১০ সালে ইউরোপ ও আমেরিকায় ব্যাপক প্রসার ঘটে প্রসাদন সামগ্রীর। ‘দ্যা ডেইলী মিরর বুক’ এর মতে ‘প্রসাধনী শিক্ষিত ও অভিজাত শ্রেনীর ব্যবহারের জন্য’।

প্রসাধনীর দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই আজ থেকে ২০ হাজার বছর আগের ক্রো-ম্যানোরাই এই প্রসাধন রীতির সর্বজন স্বীকৃত প্রবর্তক। তখন মানুষ ছিল অজ্ঞ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, তাঁরা বুঝতো না, জানাতো না আকাশে বজ্রপাত কেন হয়, দাবানল কেন জ্বলে। ঝড়-বৃষ্টি কেন হয়, বন্যা কেন তাদের ঘর বাড়ি ভাসিয়ে নিয়ে যায়। তাই প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর মৃত্যুকে তাঁরা ভীষন ভয় করতো। ভয়কে জয় করতে তারা নানান রঙে-বর্ণে অলঙ্কারে নিজেকে সাজিয়ে কল্পিত দেবতাকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করতো। এ সময়কালে মেয়েরা সাধারণত থাকতো মন্ত্র সুরক্ষিত গুহায়। আর পুরুষরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শিকারে যেতো। তাই শিকারের ঝুঁকি থেকে এড়াতে এ সময় তাদের গায়ে, মুখমন্ডলে রং দিয়ে ভালো করে তা মেখে নিত।

তৎকালীন মিশরে প্রসাধনী রং বলতে ছিল কালো এবং সবুজ। রামেসিস ও টলেমিদের সময় মেয়েদের ঠোঁটে এবং কপালে গেরি মাটি বা কারমাইন এর লাল রং প্রসাধন চালু হয়। তখন সবুজ রং তৈরি হতো ম্যালাকাইট এর পরিবর্তে সবুজ কপার হাইড্রো সিলিকেট দিয়ে। পিঁপড়ের ডিম বেটে তারা চোখে রং করতো। কিন্তু এর ব্যবহার ছিল অভিজাত সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ।

১৮৩৭-১৯০১ সময়কালকে বলা হয় ভিক্টোরিয়ান যুগ। এই সময়ে বিশাল ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে পাওয়া মুনাফা এবং ব্রিটেনের শিল্পবিপ্লবের ফলে একটি বড় আর শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেনি গড়ে ওঠে। অন্য দিকে সমাজে দরিদ্র লোকের সংখ্যাও কম ছিল না। যাদের জীবনধারণের জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হতো। কায়িক পরিশ্রম না থাকায় ধনী শ্রেনির জীবনযাপনে বিলাসিতা আর কৃত্রিমতার প্রভাব পড়ে। অভিজাত নারীরা নিজেদের ছবির মতো সুন্দর দেখাতে ব্যস্ত হয়ে পড়তো। এ সময় বিভিন্ন প্রসাধনীর সঙ্গে সঙ্গে শরীরের গঠন নিয়ে চর্চা চলতো। তাই কোমরে পরত চাপা করসেট আর ত্বকে লাগাতো এনামেল পেইন্ট। মূলত তারা পুরুষের চোখে আকর্ষনীয় রাখতে এই চর্চা শুরু করে। 

বর্তমান সময়ে সুন্দরীদের মধ্যে ভিক্টোরিয়ান চর্চা বেড়েছে। তার মধ্যে অন্যতম করসেট ব্যবহার। এটি এক ধরনের তারের তৈরি আঁটসাঁট বেল্ট জাতীয় পোশাক। এর মাধ্যমে বুকের খাঁচা ও কোমরের আকার নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। অনেক সময় কোমর চিকন আর নিতম্ব ও বুক চওড়া দেখাতে ভিক্টোরিয়ান যুগে এত আঁটসাঁট ধাতব করসেট পরতেন তাতে অনেক নারীর শরীরের হাড় বেঁকে যেত। শক্ত ধাতব তারের খাঁচায় বন্দি শরীর আর নানা রঙের প্রলেপের নিচে ঢাকা ত্বকের আসল রঙ, বর্তমান সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জনপ্রিয় তারকাদের প্রচারিত নারীর আদর্শ সৌন্দর্য। নারীর সৌন্দর্যের সীমারেখা নির্ধারনের এই প্রচেষ্টা নতুন নয়।

সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশে বহুজাতিক কোম্পানিসহ নানা দেশি প্রতিষ্ঠান-এর রং ফর্সাকারী ক্রিম, লোশন এবং সাবানের জামজমাট বাজার। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর বিজ্ঞাপনের সিংহভাগই দখল করে আছে এসব বিজ্ঞাপন। তাদের বিজ্ঞাপনে চাকরির সাফল্য, বিয়ে সবকিছু নির্ভর করছে রং ফর্সা হওয়ার ওপর। বর্তমান সময়ে বিশ্বব্যাপী এসব কোম্পানীদের সহযোগিতায় সুন্দরী প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়ে থাকে। সেখানে একজন সুন্দরী প্রতিযোগীর স্তনের মাপ, কোমরের মাপ, উচ্চতা হচ্ছে সৌন্দর্য্যের মাপকাঠি। সৌন্দর্য্যের এই ধারনাকে পুঁজি করে পৃথিবী জুড়ে চলছে বিলিয়ন বিলিয়ন টাকার বানিজ্য। সৌন্দর্যহীনতার হীনম্মন্যতা সৃষ্টির মাধ্যমে বানিজ্য প্রতিষ্ঠানগুলো নারীকে শেখাচ্ছে নিজের চেহারা কিংবা শরীরের প্রতি অবহেলা এবং অপছন্দ করতে। নারীর সৌন্দর্য তার বাহ্যিক শারীরিক অবয়বে থাকে না। বরং তার মেধায়, মনণে, চিন্তায়, চেতনায় ও আচরণে ফুটে ওঠে। নারীর সৌন্দর্য্য তার আত্মবিশ্বাসে, আত্মবিশ্বাস থেকেই জন্ম নেয় সৌন্দর্য্য। এটি শুধু নারী নয়, পুরুষের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। 

বিশ্বজুড়ে সুন্দরী প্রতিযোগীতার মাধ্যমে নারী দেহের রূপের মাপকাঠি তৈরি করা হয়েছে। যে কারণে বিশ্বজুড়ে নারীদের মনে সেই মাপকাঠিতে নিজের রূপের পরিধি নির্ণয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। এ জন্য মিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করে নিজেকে রূপের রানী হিসেবে তৈরি করতে চলছে জোর প্রস্তুতি। আমরা জানি প্রতিবছর বিশ্বজুড়ে সুন্দরী খোঁজার প্রথম শ্রেনির কয়েকটি প্রতিযোগীতা অনুষ্ঠিত হয়। এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহনের জন্য সারা বিশ্বে তাবৎ নারীর আগ্রহের কমতি নেই। আর এরই ফায়দা লুটতে এক শ্রেনির প্রসাধনী কোম্পানী এবং পোশাক, জিম এবং গ্রুমিং কোম্পানী পসরা সাজিয়ে বসেছে। প্রজ্জ্বলিত প্রদীপের মতো এই সুন্দরী প্রতিযোগীতায় অংশগ্রহনের জন্য পতঙ্গের মতো সুন্দরী নারীরা আত্মাহুতি দিতে দ্বিধা করছে না। আমরা যদি কান চলচ্চিত্র উৎসবের দিকে তাকাই তাহলেও দেখতে পাবো পোশাকের আড়ালে নিজের পরিপাটি শরীরটিও প্রদর্শন করতে পিছপা হচ্ছে না সুন্দরী খ্যাত এসব বিশ্ব নারীগণ। সহ্য করতে হয় এদের কম না। কোমর বন্ধনী, বক্ষ বন্ধনীর অত্যাচার সহ্য করে সকলের সামনে হাসিমুখে সাত ইঞ্চি হাই হিল পায়ে নিজেকে উপস্থাপনের যন্ত্রনা কিন্তু কম নয়। তার সঙ্গে রয়েছে সারাক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা এবং কোথাও বসতে না পারার তীব্র শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রনা। তবুও এসব প্রতিযোগী নীরবে কষ্ট সহ্য করে যায় শুধু মাত্র সুন্দরী তকমা আঁটোসাঁটো করে নামের সঙ্গে আটকে রাখার জন্য।

নারীর দেহের সৌন্দর্যের মাঝে প্রকৃতিকে আবিস্কার করার মতো সেই চোখ কারও হয় কাব্যিক, যেখানে অশ্লীলতা বা কদর্যতা চোখেই পড়ে না। আবার কারও জন্য একই বিষয়ে গালিগালাজ প্রযোজ্য হয়ে পড়ে। সার্বজনীনতা দিয়ে কোন বিষষকে তুলনা করা আর ব্যক্তিগত ঈর্ষা বা ক্ষুদ্র মনোবাসনা চরিতার্থ করার চেষ্টায় সেসবের ব্যবহার এক জিনিস নয়। কিন্তু সেই দেখার চোখ আর আছে কই? নারীকে বেশিরভাগই একটি সেক্স অবজেক্টেই সীমাবদ্ধ রেখে দিতে পছন্দ করে। নারী যদি হয় চিন্তা করতে সক্ষম, যদি হয় কৌশলী, সহজে পোষ না মানার মত ব্যক্তিত্ব তবে তো আর কথাই নেই। সেসব নারীকে দূর থেকে দেখে মুগ্ধ পুুরুষ কাছে এসে বুঝতে পারে সে খুব সহজ কারও কাছে আসেনি। এই নারীকে বস মানানো তার কাজ নয়। সেতো আমার যেমন খুশি লেখার কবিতার খাতা নয়। চতুর পুরুষেরা নীরবে সরে গিয়ে নিজেকে বাঁচাতে চায়। খোঁজে থাকে একটু কম বুদ্ধিসম্পন্ন কারও যে বিনা প্রশ্নে মেনে নিবে সবকিছু। পুরুষকে দেবতাজ্ঞান করেই দিনের পর দিন তার প্রণতি জানিয়ে যাবে। 

অপেক্ষায় থাকি সেই আধুনিক মানুষের, যে নারীর শরীর নিয়ে নয়, নারীর মন নিয়ে সৃষ্টি করবে সবচেয়ে সুন্দর কাব্য। তার মনে বাজাবে ভৈরবী সুর। নারীকে আয়ত্ব নয়, জয় করতে শিখবে। 

(www.theoffnews.com - Bangladesh women beauty)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours