ইরানী বিশ্বাস, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, নাট্যকার ও পরিচালক, বাংলাদেশ:

বাংলাদেশ একটি মুসলিম প্রধান দেশ। এ দেশে মুসিলম সংখ্যা গরিষ্ঠ হলেও অন্যান্য ধর্মের মানুষ বসবাস করে। তবে হিন্দুদের অবস্থান দ্বিতীয়। মুসলিম আইনে তালাক পরবর্তী এবং বিধবা নারীদের বিয়ে স্বীকৃত। তবে সেই একই দেশে হিন্দু বিয়ে বিচ্ছেদ বা বিধবা বিয়ে নেই বললেই চলে। এ বিষয়ে সকলেরই কৌতুহলের শেষ নেই।

মানব সভ্যতার অন্যতম অনুসঙ্গ বিবাহ। প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পর সু-শৃঙ্খল যৌনজীবন পরিচালিত করতেই মানুষ সামাজিক বা আইনগত স্বীকৃতি হিসেবে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। আবার বিবাহ পরবর্তীতে স্বামী-স্ত্রী বা পারিপার্শ্বিক বিষয়ে মতানৈক্য হলে বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনাও স্বীকৃত। উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশে বাড়ছে বিবাহ বিচ্ছেদের সংখ্যা। গত ২০২১ সালের জানুূয়ারী থেকে মে পর্যন্ত ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে তালাকের আবেদন করেছেন ৫ হাজার ৪৮৭ জন। বিবাহ বিচ্ছেদজনিত আবেদনের ৭০% আবেদনকারীই নারী। সেখানে একই দেশের নাগরিক হয়েও হিন্দু বিবাহ বিচ্ছেদ নেই বললেই চলে। কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে, বাংলাদেশে হিন্দু বিবাহের আইনগত বৈধ কোন স্বীকৃতি না থাকার কারণে বিচ্ছেদ ঘটানো সম্ভবপর নয়। যে বিবাহে দালিলিক কোন প্রমানপত্র নাই তা বিচ্ছেদ ঘটানোর জন্য প্রযোজ্য নয়। শুধু যে বিবাহ বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে সমস্যা তা কিন্তু নয়। প্রবাসী কোন ছেলে বাংলাদেশে বিয়ে করে স্ত্রীকে বিদেশে নিয়ে যাবার সময় ঘটে ভোগান্তি। কারণ সেখানে অগ্নি সাক্ষীর কোন মূল্য নেই। তারা চায় বৈবাহিক প্রমানপত্র। এই দূর্দশার কথা মাথায় রেখে এবং এর থেকে মুক্তি পেতে বাংলাদেশ সরকার ২০১২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন আইনের প্রজ্ঞাপণ জারি করে। এসময় সারাদেশের প্রায় সকল উপজেলায় একজন করে হিন্দু বিবাহ নিবন্ধক নিয়োগ করে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রনালয়। তবে এই আইনে বিবাহ নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হয়নি। বাধ্যবাধকতার শিথিলতা, প্রচারণার অভাবের কারণে সব বিয়ে নিবন্ধন হচ্ছে  না।

হিন্দু নারী উত্তরাধিকার আইন পৃথিবীর সব থেকে কঠিন এবং কঠোর আইন। হিন্দু মেয়েরা পিতার স্থাবর কোন সম্পত্তির অধিকারী নয়। প্রাচীনকাল থেকে হিন্দু আইন মোতাবেক মেয়েদের সম্পদ দুই প্রকার। ১. উত্তরাধিকার ২. স্ত্রীধন।

উত্তরাধিকার বলতে বোঝানো হয়েছে স্বামীর সম্পত্তির উপর স্ত্রীর কতটুকু অধিকার থাকবে, না থাকবে তার মাপকাঠি। স্বামী জীবিত থাকা অবস্থায় স্বামীর সম্পদের উপর স্ত্রীর কোনরকম অধিকার নেই। কেবল মাত্র ভোগ করতে পারবেন। তবে ১৯৩৭ সালের অবিভক্ত ভারতীয় হিন্দু আইন অনুযায়ী স্বামী মারা যাবার পর হিন্দু বিধবা নারী তার স্বামীর সম্পত্তিতে সন্তানদের পাশাপাশি  ভাগ পাবেন এবং তা ভোগ করতে পারবেন। কিন্তু বিক্রয় করতে বা হস্তান্তর করতে পারবেন না। একে সহজ ভাষায় জীবনস্বত্ব বলে। এমনকি তীর্থে যাবার বা চিকিৎসার প্রয়োজনেও স্বামীর সম্পত্তি বিক্রয় করতে পারবেন না। বিধবার মৃত্যু হলে তার প্রাপ্ত সম্পত্তি পরবর্তী পুরুষ উত্তরাধীকারীদের হাতে ফিরে যাবে।

হিন্দু নারীদের কেবল মাত্র স্ত্রীধনের উপর অধিকার আছে। এখন জানা প্রয়োজন স্ত্রীধন আসলে কি? বিবাহ এবং বিবাহ সংক্রান্ত ব্যাপারে একটি মেয়ে বাপের বাড়ি, শ্বশুরবাড়ির আত্মীয় স্বজন বা বিবাহে উপস্থিত যে কারো কাছ থেকে উপহার, উপঢৌকন পেয়ে থাকেন সেগুলি। স্বামীর কাছ থেকে প্রাপ্য যে কোন উপহার সামগ্রী। বাবা মা এবং ভাই বোন যেসব উপহার দেন বিশেষ করে অর্থকড়ি, সোনা এবং মূল্যবান অলংকারসামগ্রী।

হিন্দু মেয়েদের বিয়ের অর্থ হলো কন্যা সম্প্রদান। পুরো কন্যা সম্প্রদানের অনুষ্ঠানকেই বিয়ে বলা হয়। কন্যা সম্প্রদানের সময় মেয়েটিকে গোত্র ত্যাগ করে স্বামীর গোত্রভুক্ত করে দেওয়া হয়। এই নিয়মের নাম কনকাঞ্জলি। মুলতঃ সমাজ এবং আত্মীয়-স্বজনের সামনে কনকাঞ্জলি নেওয়ার পর মেয়েটি শ্বশুরবাড়ির অংশ হয়ে যায়। এরই সঙ্গে মেয়েটি তার পিতার সমস্ত সম্পত্তির উপর থেকে অধিকার হারায়।

তবে অবিবাহিত মেয়েদের ক্ষেত্রে নিয়ম ভিন্ন। কোন হিন্দু মেয়ের বিবাহ হওয়ার আগে যদি তার পিতা মারা যায়, তাহলে অন্যান্য ভাইদের সঙ্গে সেই মেয়ে সমান হারে বাবার সম্পত্তির মালিকানা পায়। কিন্তু হিন্দু সমাজে অবিবাহিত মেয়ে সংসারে রাখা নিষেধ। তবে বিবাহের আগ পর্যন্ত শুধুমাত্র বাবার সম্পত্তি ভোগ করতে পারবে। কখনও বিক্রি করার অধিকার পায় না।

বেদে এবং মনুস্মৃতিতে বলা হয়েছে, যারা যারা মৃত ব্যক্তির পিন্ডদান করবে তারা সবাই মৃতের সমস্ত সম্পদের অধিকারী হবে। সাধারণ নিয়মে ছেলেরাই পিতার পিন্ডদান করে থাকে। তাই ছেলেরাই পিতার সম্পত্তির প্রথম উত্তরাধীকারী হয়ে থাকে। ছেলে না থাকলে ছেলের ছেলে বা ছেলের নাতি সেই উত্তরাধীকারী হবে। তাও যদি না থাকে তবে মেয়ের ছেলে পিন্ড দান করে। সরাসরি মেয়ে নয়। মেয়ের ছেলে হবে এই সম্পত্তির উত্তরাধীকারী। তাও যদি না থাকে তবে ভাইয়ের ছেলেরা মৃত ব্যক্তির পিন্ডদান করে, ওই সম্পত্তির উত্তরাধীকারী হবে।

১৯৫৬ সালের ভারতীয় হিন্দু ব্যক্তিগত আইন (হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন) নারীকে উত্তরাধীকার সূত্রে সম্পত্তি প্রাপ্তির অধিকার প্রদান করে। পুত্রসন্তানরা পূর্বপুরুষের সম্পত্তি একটি অংশের প্রাপক ছিলেন, কিন্তু কন্যাসন্তানরা কেবলমাত্র তাদের পিতার প্রাপ্ত অংশের উপর একটি অংশ পেতেন। একজন পিতা যদি তার পূর্বপুরুষের সম্পত্তির দাবি ত্যাগ করতেন, তাহলে তার কন্যা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হতেন। তবে তার পূত্র তার নিজের অংশের উপর অধিকার বজায় রাখতে পারতেন। এমনকি বৈবাহিক জীবনে নিপীড়নের সম্মূখীন মহিলাদেরও তাদের পূর্বপুরুষের বাড়িতে বসবাসের কোন অধিকার ছিল না। বেশির ভাগ ভারতীয় পরিবারের মহিলাদের নামে কোন সম্পত্তির মালিকানা নেই। তাদের পৈত্রিক সম্পত্তির অংশ পায় না। তাদের সুরক্ষার্থে থাকা আইনগুলির যথাযথ প্রয়োগের অভাবে নারীরা এখনো বহু ক্ষেত্রে জমি ও সম্পত্তির প্রকৃত অধিকার পায় না। ভারতে সম্পত্তির উপর নারীর অধিকার ধর্ম ও গোত্রের উপর নির্ভরশীল। বহু আইনি ও প্রথাগত জটিলতার জালে আবদ্ধ। ২০০৫ সালে হিন্দু উত্তরাধিকার আইন সংশোধনের ফলে নারীকে এখন পুরুষের সমান ও বৈধ অধিকার প্রদান করা হয়েছে। বাংলাদেশের হিন্দু আইনয়ের কোন রকম পরিবর্তন বা সংশোধন করা হয়নি। এখনও ১৯৩৭ সালের আইন বলবৎ রয়েছে।

পরিশেষে বলা যেতে পারে বাংলাদেশে বসবাসরত হিন্দু সম্প্রদায়ের বিবাহ পদ্ধতি এখনও আইনগত স্বীকৃতি পায়নি। এছাড়া হিন্দু নারী তাদের পৈত্রিক সম্পত্তির অধিকার পায় না। সেখানে বিবাহ বিচ্ছেদ হওয়া অবাস্তব চিন্তা ভাবনা। 

ধরে নেওয়া যেতে পারে, কোন মেয়ে বিয়ের পর তার স্বামীর সাথে বনিবনা হচ্ছে না। মেয়েটি যদি চিন্তা করে সে স্বামীর সংসার করবে না। তখন সে কি করবে? বাপের বাড়িতে চলে যাবে? হ্যাঁ গেল সেখানে। হয়তো বাবা-মা জীবিত আছে, তারা আশ্রয় দিবে। এরপর শুরু হবে পাড়া প্রতিবেশীদের কটুক্তি। ধরে নিলাম সেই সব সহ্য করে রয়েও গেল মেয়েটি। বাপের বাড়িতে মেয়েটি আশ্রিতা হিসেবে পরিচিতি লাভ করবে। কিছুদিনের মধ্যে ভাইয়ের বউয়েরা আসবে। তারা বোঝা মনে করতে শুরু করবে। মেয়েটি আমৃত্যু বাপের বাড়িতে ভাইয়ের বোঝা হয়ে বেঁচে থাকবে। তার নিজের কোন অধিকার এ বাড়িতে থাকবে না। একই বাবা মায়ের সন্তান হয়ে বিয়ের আগে যে বাড়িতে অধিকার ছিল। সেই একই বাড়িতে ভাই মালিক আর বোন হয়ে যায় আশ্রিতা। এই লজ্জা আর অপমান সহ্য করার চেয়ে প্রত্যেকটা হিন্দু মেয়ে মনে করে স্বামীর বাড়ির এক কোনায় কাজের মেয়ের মতো থাকাও ভাগ্যের। অন্তত বাপের বাড়ির কাছে তাকে ছোট হতে হয় না।

বাংলাদেশে এখনও পর্যন্ত বিবাহ রেজিষ্ট্রি বাধ্যতামূলক হয়নি। ২০১২ সালের আগে যাঁদের বিবাহ হয়েছে তাঁদের ক্ষেত্রে বিবাহের বৈধ কাগজপত্র নেই। কিসের ভরসায় তারা কোন আইনে আদালতে বিবাহ বিচ্ছেদ জন্য ভরণপোষনের জন্য লড়বে? তাছাড়া ২০১২ সালের পরবর্তীতে শুধুমাত্র শহরাঞ্চলের ধনী শিক্ষিত পরিবারেই বিবাহ রেজিষ্ট্রি করানো হচ্ছে। হিন্দু সম্প্রদায়ে বিবাহ রেজিষ্ট্রি এবং নারীর সম্পত্তি অধিকারের প্রতি আগ্রহ নেই। রেজিষ্ট্রি চালু করা হয়েছিল শুধুমাত্র বৈদেশিক ঝামেলা মেটানোর জন্য। তাই নামে মাত্র আইনটি চালু রাখা হয়েছে।

শত শত বছর ধরে হিন্দু নারীদের সামাজিক ও ধর্মীয় বেড়াজালে কৌশলগতভাবে আটকে রেখেছে। যা থেকে এখনও তাঁরা বের হতে পারছেন না। পৃথিবীতে প্রতি রাতে কত শত হিন্দু নারীর অস্ফুট কান্না বুকে চেপে রাত শেষ হয় তার হিসাব নেই। অনেক বিবাহিত নারী স্বামীর বাড়িতে কাজের মেয়ের মতো থাকেন। স্বামীর পাশে জায়গা হয় না। শুধু স্বামীর নামে সিঁথিতে সিঁদুর আর শাঁখা পরে সধবা থাকার আশায় পড়ে থাকে। পায়ের তলায় মাটি নেই বলে কোন মেয়ে সংসার ভাঙ্গার সাহস দেখাতে পারে না। শতকরা ১ জন নিজের আয়ে চলার ভরসায় স্বামীর সঙ্গে আলাদা হওয়ার সাহস দেখায়।  এরখম পরম পরম্পরায় কত শত হিন্দু নারীদের মিথ্যা নাটকীয় সুখী সংসার টিকে আছে।

(www.theoffnews.com - Bangladesh hindu divorce)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours