দেবিকা ভট্টাচার্য, লেখিকা ও লেকচারার, চন্দননগর, হুগলি:
টেকা গ্রামের গুরু মহাশয় মোহন মিত্র উলা বীরনগরে এসে বসতি স্থাপন করেন ১৬৫৭ খ্রিস্টাব্দে। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে (১৭০৪খ্রি) মোহন মিত্রর পুত্র রামেশ্বর আওরঙ্গজেবের কাছ থেকে মুস্তৌফী পদবী গ্রহণ করেন। বীরনগরে মিত্র মুস্তৌফী পরিবারের অনেক স্মৃতি, স্থাপত্য এখনও বর্তমান। ১৭০৮ খ্রিস্টাব্দে রামেশ্বরের জ্যেষ্ঠ সন্তান রঘুনন্দন শ্রীপুর বলাগড়ে বসতি স্থাপন করেন। ১৭১২ খ্রিস্টাব্দে রামেশ্বরের চতুর্থ সন্তান অনন্তরাম চলে আসেন সোমড়া বাজারের সুখড়িয়ায়।রামেশ্বরের দ্বিতীয় পুত্র রামনারায়ণের সময় সম্ভবত দ্বাদশ শিবমন্দির, শ্যামরায় মন্দির পরিখা দিয়ে ঘেরা মুস্তৌফী বাড়ির সিংহদুয়ার ১৭১৩ থেকে ১৭৩০ এর মধ্যে নির্মিত হয়। ১৭৫৭ সালে অনন্তরামের চতুর্থ সন্তান তিলোক রাম ১০০১ টাকার বিনিময়ে সুখড়িয়া, গোপীনগর, পুনই, ক্রয় করেন বর্ধমান মহারাজা তিলক চাঁদের কাছ থেকে।
রামনিধি এবং বীরেশ্বর মুস্তৌফী নিঃসন্তান ছিলেন ঠিকই, আর যাঁরা বংশধর ছিলেন কলকাতায় চলে যান। দৌহিত্র বংশীয় বিশ্বাস বংশ বহুদিন যাবৎ রাধাকুঞ্জের মালিকানা পাওয়ায় বাড়িটি বিশ্বাস বাড়ি বলেই পরিচিত হতে থাকে।
এই যে সময়কাল, সে সময়ে ইংরেজও দেশ শাসনের ভার নেয়নি। ইতিহাস যত বিকৃত বা অলিখিত থাক আন্দাজ বা লোকমুখ ঊনবিংশ বা বিংশ শতাব্দীর কথা কিছু বলে না। ১৮৮১তে শ্রীরামকৃষ্ণ এখানে এসেছিলেন সত্য। রানি রাসমণি কাশী যাওয়ার পথে এখানকার আনন্দময়ী মায়ের মন্দির দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন এবং দক্ষিণেশ্বরের মন্দির তৈরির সময় এই মন্দিরের আদল রাখার চেষ্টা করেছিলেন।
রাজন্য প্রথা বিলোপ হওয়ার অনেক আগেই মিত্র মুস্তৌফীর জমিদারিতে ছেদ পড়ে যায়। শোনা যায় রাধাজীবন মিত্র মুস্তৌফীর নামে তৈরি রাধাকুঞ্জ। সে ভগ্ন দুই স্তম্ভ নিয়ে ঝড়ের মুখে দাঁড়িয়ে আছে এখনও। প্রতিবছর পুজোয় যখন গিয়ে দাঁড়াই দেখি, অভ্যাসের কোনো জীর্ণতা যেন কোনো কিছু আড়াল করেনি। কল্পনায় সবটুকু পাওয়া যায়। এই মিত্র মুস্তৌফীর বংশকে কেন্দ্র করেই সুখড়িয়ার মন্দির, পুকুর, বাগান।
হাওড়া থেকে কাটোয়া লাইনের ট্রেনে অথবা ব্যাণ্ডেল থেকে কাটোয়া লাইনের ট্রেনে করে সোমড়া বাজার রেল স্টেশন। টোটো করে অথবা পায়ে পায়ে ঘুরে নেওয়া যায় সোমড়া বাজারের দর্শনীয় স্থান।পুকুর, স্বাভাবিক গাছগাছালিতে ঘেরা শান্ত ছোট্ট জায়গা সোমড়া বাজার। পণ্ডিতদের ব্যাখ্যা "সোমো ভাতি যত্র সা সোমঢ়া" অর্থাৎ চাঁদ যেখানে প্রকাশ পায় সেই সোমড়া। চন্দ্র কিরণোজ্জ্বল স্থান হিসেবেই এই নামের উৎপত্তি এমনটাই মনে করা হয়। কেবল পূর্ণিমা নয় নির্মেঘ আকাশ হলে দুটি পক্ষের প্রত্যেকটা রাতে চাঁদের বৃদ্ধি এবং ক্ষয়ের সৌন্দর্য গ্রামের যে কোনো জায়গা থেকে চোখে পড়বে, বোঝা যাবে এই নামের সার্থকতা।
আদি গঙ্গার তীরে সিদ্ধেশ্বরী মায়ের মন্দির ঠিক কবে তৈরি হয়েছিল তা নিয়ে মতান্তর রয়েছে। ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই জুলাই রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব কোচবিহার রাজের নৌকা করে সোমড়ার এই ঘাট পর্যন্তই আসেন।
এখানে প্রাচীন বৃক্ষের নীচে এক সৌম্য দর্শন কালীসাধকের সাধনার কথা লোকমুখে প্রচলিত আছে। তিনিই প্রস্তর নির্মিত প্রায় আড়াই ফুটের কালী মূর্তিটি পঞ্চমুণ্ডির আসনে বসান। মুস্তৌফী বংশের অর্থ দিয়েই আনুমানিক ১৭৮৫ খ্রিস্টাব্দে একতলা সমতল ছাদ বিশিষ্ট মন্দিরটি নির্মিত হয়। বটবৃক্ষের ঝুড়ি গুলিই এক একটি বৃক্ষের গুঁড়ি আকৃতির। গ্রামের যে কোনো অনুষ্ঠান সম্পন্ন করার আগে মা সিদ্ধেশ্বরীর থানে পুজো দেওয়ার রীতি রয়েছে। মন্দিরটি বর্তমানে সংস্কার করা হয়েছে। (ক্রমশঃ)
(ছবি সৌজন্যে প্রতিবেদক স্বয়ং)
(www.theoffnews.com Somra bazar Hooghly)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours