ইরানী বিশ্বাস, সাংবাদিক সাহিত্যিক নাট্যকার ও পরিচালক, বাংলাদেশ:

বিশ্ব চলমান। এখানে কোন কিছুই স্থায়ী নয়। আজ যা নতুন কাল তা পুরানো হচ্ছে। বর্তমান সময়ে প্রায়ই শোনা যায় ওটিটি প্লাটফর্ম-এ মুভি মুক্তি পেয়েছে। আবার কখনো শোনা যায় ওটিটি প্ল্যাট ফর্মে গান বা মিউজিক ভিডিও রিলিজ দেওয়া হয়েছে। ওটিটি অর্থাৎ ‘ওভার দ্য টপ’। এটি এমন একটি প্ল্যাটফর্ম যেখানে দর্শকরা বাড়িতে বসে অনলাইনে ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান দেখার সুযোগ পান।

যুগ বদলে যাচ্ছে। এক সময় যাত্রা, পুতুল নাচ ছিল বিনোদনের মাধ্যম। এর পর বাংলাদেশে সিনেমা হল হয়েছে। সেখানে বিদেশী সিনেমা দেখানো হতো। আজ থেকে ঠিক ৪৫ বছর আগে ভিসিআর এসেছিল এ দেশে। এক শ্রেনী হৈচৈ ফেলে দিয়েছিল। কেউ কেউ প্রতিবাদও করেছিল। তাদের মুখে একটাই কথা সিনেমার বারোটা বেজে গেল। ধীরে ধীরে ভিসিআর জনপ্রিয় হয়ে উঠলো সব শ্রেনির মানুষের কাছে। তাই বলে রুটিন করে সিনেমা দেখা বন্ধ হলো না।

তারপর বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্ম হলো। পুরো জাতি তাকিয়ে থাকতো বিটিভির দিকে। বিটিভি তাদের নিজস্ব পছন্দের অনুষ্ঠান প্রচারিত করতো। সংবাদ, দেশ উন্নয়নের ডকুমেন্টারী। হাতে গোনা কয়েকটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখানো হতো। সপ্তাহে একটাই নাটক প্রচারিত হতো। তাই শিল্পী এবং গল্প নির্বাচনে ছিল অনেক সতর্ক। এসব নাটকে শিল্পীদের চান্স পাওয়া অনেক ভাগ্যের ব্যাপার ছিল। তখন বিটিভিতে এক সিকোয়েন্স অভিনয় করলে তিনি রীতিমতো অভিনেতা হিসেবে প্রচারিত হতেন। হাটে মাঠে যেখানেই যেতেন সাধারণ মানুষ তাকে চিনে যেত। কালক্রমে সাদাকালো বিটিভি রঙিন হয়ে এলো। মানুষের মনে আনন্দের সীমা রইল না। সময়ের বিবর্তনে এসে গেল স্যাটেলাইট নির্ভর টিভি চ্যানেল। এখানে সরকারী বাধ্যবাধকতা নেই। অনেকটা দর্শকপ্রিয় অনুষ্ঠান প্রচারিত হতে লাগলো। মানুষের মধ্যে বিটিভির চাহিদা অনেকটা কমে যেতে লাগলো। মানুষ হয়ে পড়লো স্যাটেলাইট চ্যানেল নির্ভর। গত কয়েক বছর দেশের স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোর অনুষ্ঠান নিয়ে স্বেচ্ছাচারিতা শুরু হয়েছে। বাধ্য হয়ে মানুষ বিনোদনের জায়গা করে নিয়েছে হাতের নাগালে থাকা ওটিটি প্ল্যাটফর্ম।

বর্তমানে বাংলাদেশে নেটফ্লিক্স এবং এ্যামাজন প্ল্যাটফর্মের গ্রাহক সংখ্যা ৩ লাখেরও বেশি। এ দুটি প্ল্যাটফর্মে যে কন্টেন্ট আছে তা বিদেশী ভাষায় নির্মিত। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ বিদেশী ভাষা বোঝে না। আর নেটফ্লিক্স এবং এ্যামাজন প্ল্যাটফর্মে বাংলা কোন কন্টেন্ট নেই। তাই বাঙ্গালীর শেষ ভরসা হিসেবে পার্শ্ববর্তী দেশের ওটিটি প্ল্যাটফর্ম জি-৫ বা হৈচৈ। মন্দের ভাল হিসেবে এ দুটি প্ল্যাটফর্ম থেকে ভাল-মন্দ মিলিয়ে দর্শকের চাহিদা মেটাচ্ছে। মাঝে মাঝে বাংলাদেশের কিছু কন্টেন্ট এই দুটি ওটিটি প্ল্যাটফর্মে আপলোড করা বা মুক্তি দেওয়া হচ্ছে। তাতে বাংলাদেশের কতোটা লাভ হচ্ছে জানি না। তবে ভারতের পশ্চিমবাংলার এ দুটি প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশে জনপ্রিয় করে তুলতে সক্ষম হয়েছে।

ওটিটি প্ল্যাটফর্ম হচ্ছে ভার্চ্যুয়াল সিনেমা হল। অর্থাৎ দর্শক ওটিটি প্ল্যাটফর্মের কন্টেন্ট মোবাইলে, ল্যাপটপে, পিসিতে বা স্মার্ট টিভিতে দেখতে পাচ্ছে। ওটিটি প্ল্যাটফর্ম অনলাইন হলেও নির্মানের ক্ষেত্রে অনেক সতর্ক থাকতে হবে। এর জন্য ৯০ মিনিট দৈর্ঘের সিনেমা বানাতে হবে। অনেকে পর্ব হিসেবে অর্থাৎ মধ্যবর্তী বিরতির পরের অংশ অন্য একটি পর্ব হিসেবে আপলোড করে থাকে। এছাড়াও আছে ওয়েব সিরিজ। ধারাবাহিক নাটকের আদলে ওয়েব সিরিজ বানানো হয়। তবে এর একটু ভিন্নতা থাকে। যেমন প্রতিটি পর্বের একটা করে নাম দেওয়া হয়। এভাবে ১০টা পর্ব নিয়ে একটা করে সিজন করা হয়। এরপর একই গল্পের বর্ধিতাংশ নিয়ে আরও সিজন তৈরি করা হয়ে থাকে।

যারা ওটিটি এবং ইউটিউব সম্পর্কে নুন্যতম ধারানা রাখে না তাদের জনা প্রয়োজন। ওটিটি প্ল্যাটফর্ম চালু রাখতে প্রাথমিক পর্যায়ে অন্তত পক্ষে একশ কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে হবে। অনেকেরই এ কথা শুনে মনে প্রশ্ন জাগতে পারে এত টাকা কেন? কেউ যদি মনে করে ইউটিউব এবং ওটিটি একই বিষয় তাহলে তাদের ধারণা ভুল। ইউটিউবে চলে ব্যক্তির মর্জি মাফিক। ইউটিউব কর্তৃপক্ষ নিজেদের ইচ্ছা অনুযায়ী কন্টেন্ট দিতে পারেন। কিন্তু ওটিটি প্ল্যাটফর্ম মানেই আর্ন্তজাতিক মানের কন্টেন্ট বিশ্ববাজারে তুলে ধরা। এবং সেখান থেকে টাকা আয় করা। বিষয়টি এত সহজ নয়। সুতরাং ওটিটি প্ল্যাটফর্মের জন্য যে কন্টেন্টগুলো নির্মান করতে হবে, তা অবশ্যই বিশ্বমানের হতে হবে। ওটিটি প্ল্যাটফর্ম টিকিয়ে রাখতে বা দর্শক নন্দিত করতে সিরিজ এবং সিনেমা আপলোড করতে হবে। তবে সিনেমা ছাড়া শুধুমাত্র সিরিজ দিয়ে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। কেউ যদি মনে করে ধারাবাহিকের আদলে ওয়েব সিরিজ বানিয়ে ওটিটি প্ল্যাটফর্মে মুক্তি দিলেই দর্শক সেটা লুফে নিবে তাহলে সেটা ভুল হবে। এই প্ল্যাটফর্মে কন্টেন্ট আপলোড দিতে হলে অবশ্যই বিশ্বমিডিয়ার কথা মাথায় রাখতে হবে অর্থাৎ নির্মান শৈলী, ক্যামেরা কোয়ালিটি, মেকাপ, ডায়লগ ডেলিভারী, আর গল্প তো আছেই।

আগামী দুই/তিন বছরে স্যাটেলাইট চ্যানেলের জায়গা দখল করে নিতে চলেছে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম। কারণ ইতোমধ্যে দর্শকরা টেলিভিশন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছে। এমনিতেই বাংলাদেশের স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোর মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি চ্যানেলের আর্থিক অবস্থা ভাল। বাকিগুলো কোনমতে চালিয়ে যাচ্ছে। চ্যানেলগুলো নিজের খরচ তুলতে যেখানে হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে ভাল কন্টেন্ট কেনা বা নির্মানের কথা চিন্তা করা অপ্রাসঙ্গিক। তাছাড়া চ্যানেলে দর্শকের ইচ্ছেমতো অনুষ্ঠান দেখার সুযোগ নেই। চ্যানেলের টাইম অনুযায়ী টিভির সামনে গিয়ে বসে থাকতে হয়। সেখানে ওটিটি প্ল্যাটফর্মে দর্শক ইচ্ছেমতো সময় এবং স্থানে বসে কন্টেন্ট দেখার সুযোগ পাচ্ছে। মানুষ একবার যদি সুবিধা পায় তাহলে সেটার দিকেই ঝুঁকে পড়ে। 

ইদানীং ইউটিউবে বিজ্ঞাপণের বিড়ম্বনা বেড়ে গেছে। আগে প্রত্যেকটা বিজ্ঞাপণ স্কিপ করা যেতো। এখন সেই সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। ফলে দর্শক ওটিটি প্ল্যাটফর্মেও দিকে বেশি মনোনিবেশ করেছে। কারণ এখানেই একমাত্র বিজ্ঞাপণহীন কন্টেন্ট দেখার সুযোগ রয়েছে। 

অনেকে হয়তো মনে করছেন বিজ্ঞাপণ যদি নাই থাকে তাহলে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম থেকে আয় করার সুযোগ কোথায়? তাদের উদ্দেশ্যে বলছি, ইউটিউবে যদি এক ঘন্টার কন্টেন্টে ১০ টাকা আয় হয় তাহলে ওটিট থেকে অন্তত ৫০গুন বেশি টাকা আয় সম্ভব। প্রচলিত নিয়ম অনুয়ায়ী ওটিটি প্ল্যাটফর্ম দেখতে প্রতি মাসে, ৩ মাসে, ৬ মাসে বা বছরের জন্য নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা দিয়ে গ্রাহক হতে হয়। বিশ্বে বসবাসকারী বাংলা ভাষার মানুষের সংখ্যা অনেক। সেখানে ৫০ লাখ গ্রাহক পাওয়া কঠিন কিছু না। এখন এই ৫০ লাখ গ্রাহক যদি প্রতি মাসে মাত্র ২৫ টাকা নিবন্ধন করে তাহলে মাসে মোট ১২ কোটি টাকা আয় হবে। এই টাকা ইউটিউব থেকে কোন ভাবেই সম্ভব নয়।

বিনোদন নির্ভর ওটিটি প্ল্যাটফর্ম থেকে রাজস্ব আদায়ের পরিকল্পনা করেছে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি। নেটফ্লিক্স, অ্যামাজন প্রাইম, জি-৫, আইফ্লিক্স, হইচই ইত্যাদির মতো ওটিটি প্ল্যাটফর্মেও ওপর কোনও নিয়ন্ত্রন না থাকায় উচ্চ আদলতের নির্দেশনায় এসব প্ল্যাটফর্ম থেকে আপত্তিকর কনটেন্ট অপসারণ ও খসড়া নীতিমালা প্রণয়ন উদ্যোগ নিয়েছে বিটিআরসি। এরই মধ্যে বিটিআরসি এই বিষয়ক একটি কমিটি গঠন করেছে। ভাইবার, ম্যাসেঞ্জার, ইমো, উইচ্যাট লাইনের মতো যোগাযোগ নির্ভর ওটিটি সার্ভিস এ দেশে বিপুল জনপ্রিয়। দেশ থেকে বিজ্ঞাপণের মাধ্যমে ব্যবসা করে অর্থ নিয়ে যাচ্ছে তারা। দেশে এসব প্রতিষ্ঠানের কোনও নিয়ন্ত্রন না থাকা, কোন ধরনের যোগাযোগ পয়েন্ট না থাকায় সরকার তার রাজস্ব হারাচ্ছে।

যেখানে সুবিধা থাকে সেখানে অসুবিধাও থাকে, এ কথা আমরা প্রায় সবাই মানি বা বিশ্বাস করি। ওটিটি যতটা আকর্ষনীয় ততটাই কিন্তু বিভ্রান্তিকর। কারণ খুব সহজেই ওটিটি প্ল্যাটফর্মে কন্টেন্টের নামে যৌন উত্তেজক বিষয়বস্তু জুড়ে দেওয়া হতে পারে। যা অল্পবয়সী ছেলে-মেয়েদের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক। আমরা জানি শিশুরা দেশের ভবিষ্যত। যে দেশের শিশুরা সুন্দর সাবলীল জীবন-যাপন করতে পারে সেই দেশের এগিয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে বেশি। ওটিটি প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম যেন কোনভাবেই ক্ষতির মুখে না পড়ে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। অবশ্য এজন্য বাংলাদেশ সরকার একটি খসড়া নীতিমালা তৈরি করেছে। খুব শিঘ্রই এই নীতিমালার আওতায় আনা হবে ওটিটি প্ল্যাটফর্মের সকল কন্টেন্ট।

(www.theoffnews.com - Bangladesh OTT platform)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours