পলাশ মুখোপাধ্যায়, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

আসনপানি গ্রামটা থেকে হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায় ঝাড়খণ্ডকে। পাহাড় জঙ্গলে ঘেরা সাপঘরা গুহা ঝাড়খণ্ড সীমানার ওপারে হলেও যেতে হয় আসনপানি হয়েই। সেই গ্রামের দশরথ তিরকে আমাদের নিয়ে চলল সাপঘরা দেখাতে। একে বাঙালি, তায় আবার সাংবাদিক, চুপ করে চলা যায় নাকি, কলকাতায় পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং তার বান্ধবীদের নিয়ে যখন এমন একটা হট্টগোল চলছে। দশরথকেই শুধোলাম তার কি অভিমত জানার জন্য। জানা গেল দশরথ এসব কিছুই জানে না, এমনকি সে পার্থ চট্টোপাধ্যায়কেও চেনে না। ঘুরে এসে গ্রামের দুচারজনের থেকেও একই উত্তর মিলল, তারা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই চেনে। আর চেনে দুই একজন স্থানীয় নেতাকে। একটু সংশয় থাকলই, সেটা কাটাতে সন্ধেয় হানা দিলাম বান্দোয়ানের একটি চায়ের দোকানে। সিঙ্গাড়া, পেঁয়াজি এবং চা হাতে তখন দোকানের ভরা যৌবন। কলকাতার লোক দেখলে অবশ্য ওরাই এগিয়ে আসেন, এখানেও ব্যত্যয় হল না, আমিও তক্বে তক্কেই ছিলাম। মাঝ হাটে পেড়ে ফেললাম প্রশ্নটা। কলকাতায় এই যে এত টাকা মিলছে কি ভাবছেন আপনারা। একটা বড় অংশই পার্থকে চেনে না, দুই একজন সাংবাদ মাধ্যমে জেনেছেন বটে। কিন্তু একটা ব্যাপারে সকলেই দেখলাম একমত যে রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকে এমন টাকা পাওয়াটা খুব একটা আশ্চর্যের নয়। প্রায় সমস্বরে সকলে জানালেন বড়লোকেরা (পড়ুন রাজনৈতিক নেতা) এমন আর্থিক তছরুপ করবেন, ধরা পড়বেন, আবার ছাড়াও পেয়ে যাবেন এটাই স্বাভাবিক। খুব যে সকলে ব্যাপারটা নিয়ে রাগান্বিত, বিরক্ত বা অতিভাবিত এমনটা মনেই হল না। সামনের পঞ্চায়েত ভোটে কি হবে? উত্তরটা দিলেন  চা বিক্রেতার স্ত্রী, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, যাকে কিছুটা হলেও সমৃদ্ধ করেছে। জানালেন তারা দিদিকেই চেনেন, তার প্রতি ভরসা আছে। বাকিরাও নীরবে সায় দিয়ে চলল বাড়ির দিকে, দোকানের সামনে রাখা কন্যাশ্রী বা সবুজসাথীর সাইকেলে চেপে। 

এটাই রাজ্যের বৃহৎ অংশের কথা। পুরুলিয়া কেন? আমার বাড়ির পরিচারিকাকেও একই প্রশ্ন করেছিলাম। তারও প্রায় কাছাকাছিই উত্তর। সেও পার্থকে চেনে না, তবে বাড়ি বাড়ি কাজ করতে গিয়ে এমন কিছু একটা শুনেছে, কিন্তু লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, বিনা পয়সার রেশন, মেয়ের কন্যাশ্রীর সুবিধা এসবই তাকে এখনও দিদির পক্ষেই রেখেছে। আমায় কয়েকজন প্রাজ্ঞ মানুষ বলছিলেন এবার মানুষের টনক নড়বে। রাশিরাশি টাকা উদ্ধার এবার তৃণমূলকে বিপদে ফেলবে। কিন্তু সত্যিই কি তাই? আচ্ছা পুলিশ ঘুষ খায়, এই কথা শুনলে আপনি কি এখন খুউউউব রেগে যান? আপনার কি প্রচণ্ড ঘৃণায় গা গুলাতে থাকে? উত্তেজনায় অস্বস্তি বোধ করেন? না, করেন না। এসব কিছুই আপনার আর হয় না, কারণ পুলিশের ঘুষ খাওয়াটা আপনার আমার সকলের কাছেই অতিস্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে গিয়েছে। রাজনীতির ক্ষেত্রেও তাই, রাজনৈতিক নেতারা ঘুষ খাবেন, তাদের কাছ থেকে রাশি রাশি টাকা উদ্ধার হবে। তাদের স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি এখন রাজা মহারাজাদেরও ছাড়িয়ে যাবে এটাই দস্তুর। তাই তো সামান্য কাউন্সিলর বা পঞ্চায়েত সদস্যের চারতলা প্রাসাদোপম বাড়ি, বিদেশী গাড়ি দেখলে আমাদের আর চোখ টাটায় না। অনুব্রত মণ্ডলের দেহরক্ষীর সম্পত্তি একশ কোটি শুনলে আমরা অবাক হই না, পার্থর বান্ধবীর কাছ থেকে পঞ্চাশ কোটি টাকা, গহনা, অনেকগুলি ফ্ল্যাটের সন্ধান পেলেও বিস্ময় গ্রাস করে না। 

সামনের বড় নির্বাচন বলতে পঞ্চায়েত ভোট। কিন্তু এই মুহুর্তে রাজ্যে বিরোধী দলের অবস্থাটা প্রায় তেজপাতার মত। রান্নাঘরে থাকে, রান্নায় দেওয়া হয় বটে, কিন্তু তার তেজ কিছু নেই। বিজেপি নিজেদের নিয়েই এখন ল্যাজেগোবরে। বামেরা এখন শুধু অস্তিত্বের জানান দিতেই লড়ে যাচ্ছে। কংগ্রেসের কথা তো না বলাই ভাল। এমতাবস্থায় এক বছর পরে কেন, আগামী কালও যদি পঞ্চায়েত বা অন্য কোনও ভোট হয় তাহলে তা তৃণমূলের পক্ষেই যাবে এটা বলতে খুব রাজনৈতিক দূরদর্শিতার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।   

তা বলে কি পার্থকে নিয়ে হইচই হচ্ছে না, সাধারণ মানুষ কি নিন্দা মন্দ করছেন না? করছেন কিন্তু সেটা সংবাদ মাধ্যমের ক্রমাগত নিউজ আপডেটের ফল। স্যোশ্যাল মিডিয়ায় ধারাবাহিক মিম বা রসিক মেসেজের ফল। এগুলি একটু ঝিমিয়ে গেলে দেখবেন শহুরে বা শহর ঘেঁষা মানুষজনও ঝিমিয়ে পড়বেন। বিশ্বাস হল না তো ? আচ্ছা বলুন তো নারদা কাণ্ডে দশজন তৃণমূল সাংসদ, মন্ত্রী, নেতাদের হাতে টাকা নিতে দেখা গেল। তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম তারা সকলেই ধোয়া তুলসি পাতা। কিন্তু ওই ভাবে টাকা নেওয়ার কোনও সঠিক কারন তারা কেউ দেখাতে পেরেছিলেন কি? কোনও পরিস্থিতিতে এমন ভাবে টাকা নিতে হয় কি? রাজ্যের কোটি কোটি মানুষ তা দেখেছেন। কিন্তু তার পরে তো নির্বাচন হয়েছে। তৃণমূলের কোনও সমস্যা হয়েছে কি? বরং ওই নেতা মন্ত্রীদের অনেকেই এখনও বহাল তবিয়তে স্বপদেই রয়েছেন। জনগন তাদের ভোট দিয়ে রেখেছে। সারদা সহ অসংখ্য চিটফাণ্ড কাণ্ডে সর্বস্বান্ত হয়েছেন এই রাজ্যবাসীই। এই চিটফান্ডগুলিতে রাজনৈতিক নেতাদের সরাসরি যুক্ত থাকার কথা বার বার উঠে এসেছে। বহু রাজনৈতিক নেতা এই চিটফাণ্ডের হয়ে সরাসরি সওয়াল করেছেন। তা স্বত্বেও কি জনগনের ভোটে তার প্রভাব পড়েছে? জনগণের কাউকে তুলতে যেমন সময় লাগে না তেমনই এসব কেলেঙ্কারি ভুলতেও সময় লাগে না।  বরং মানুষের মনে হয়েছে ক্ষমতায় যেই আসুক সেই লুটেপুটে খাবে, তাই তার মধ্যে যদি কেউ আমাদের ছিটেফোটা দিয়ে খায় তবে সেই ভাল। সেই মন্দের ভালকেই বেছে নিতে এখন তাই হাত কাঁপে না আমাদের। কেউ কেউ বলছেন বটে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার হোক বা বিভিন্ন ”শ্রী”-র টাকা, এসবই নাকি ভিক্ষা বা দাক্ষিণ্য। কিন্তু বন্ধ ফ্ল্যাটে কোটি কোটি টাকা ডিম পাড়ার জন্য রেখে না দিয়ে কিছু দাক্ষিণ্য দিলে বা নিলে ক্ষতি কি? সেও তো আমাদেরই টাকা, এও তো আমাদেরই টাকা।

(www.theoffnews.com - West Bengal corruption panchayat election)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours