ইরানী বিশ্বাস সাংবাদিক সাহিত্যিক নাট্যকার ও পরিচালক, বাংলাদেশ:
প্রায় সাড়ে বারোশো কোটি টাকা ব্যয়ে কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকারের নির্মীয়মান সেন্ট্রাল ভিস্তার কেন্দ্রে নতুন সংসদ ভবন। তারই ছাদে ব্রোঞ্জের তৈরি প্রায় ৯৫০০ কিলোগ্রাম ওজনের এবং ৬.৫ মিটার উচ্চতার অশোক স্তম্ভ বাসানো হয়। ভারতের জাতীয় প্রতীক তৈরির নকশা থেকে তৈরি প্রক্রিয়া শেষ হতে মোট আটটি ধাপ অতিক্রম করেছেন শিল্লীরা। প্রথমে কম্পিউটারে ‘গ্রাফিক্স স্কেচ’ তৈরি করা হয়। তার উপর ভিত্তি করে তৈরি হয় মাটির মডেল। পরে ধাপে ধাপে কাজটি সম্পন্ন হয়।
গত সোমবার ১১ জুলাই সংসদ ভবনের ছাদে বাসানো ব্রোঞ্জের তৈরি জাতীয় প্রতীক অশোক স্তম্ভটির উদ্বোধন করেন ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এ সময় উপস্থিত ছিলেন লোকসভার স্পিকার ওম বিড়লা, রাজ্যসভার ডেপুটি চেয়ারম্যান হরিবংশ, সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী প্রহ্লাদ জোশী এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হরদীপ সিংহ পুরী।
সুবিশাল অশোক স্তম্ভটির উদ্বোধনের পর শুরু হয় রাজনৈতিক বিতর্ক। তবে বিষয়টি নিয়ে আত্মপক্ষ সমালোচনা করেন দুই শিল্পী। তাদের দাবী, ‘মূল স্তম্ভ থেকে কোথাও আলাদা নয় নতুন এই স্তম্ভটি। আমরা খতিয়ে দেখিছি। সেভাবে কোন পার্থক্য নেই। তবে ছোটখাটো কোন ফারাক থাকতে পারে। এটি বড় মূর্তি ফলে নীচ থেকে দেখলে এটি আলাদা মনে হতেই পারে।’ অনেকেই ধারনা করছেন যেহেতু আগের স্তম্ভটি ১.৬ মিটার উঁচু এবং বর্তমান স্তম্ভটি ৬.৫ মিটার উঁচু তাই এটি ১০০ মিটার দূর থেকে দেখা উচিত। তাহলেই স্তম্ভটি সঠিক আকৃতি দেখা যাবে।
বিজেপি বিরোধীদের সরব প্রতিবাদে বলা হচ্ছে বর্তমান স্তম্ভটির সিংহের মুখে হিংস্রতা ফুটে উঠেছে। যেহেতু পুরানো স্তম্ভটি ছিল সম্রাট অশোকের তৈরি তাই এটি ছিল অহিংস প্রতিমূর্তি। এবার আমরা জেনে নিতে পারি সম্রাট অশোকের পরিচয়, কেন তিনি অহিংস ছিলেন।
সিংহলীয় উখ্যানসমুহে পাওয়া যায়, সম্রাট বিন্দুসারের ১৬টি স্ত্রীর মধ্যে সুভদ্রাঙ্গী ছিলেন সম্রাট অশোকের মা। বিন্দুসারের সন্তান সংখ্যা ছিল ১০১টি। তাঁর অসুস্থতার খবর ছড়িয়ে পড়লে তাঁর পুত্রদের মধ্যে সিংহাসনের দখল নিয়ে রক্তাক্ত দ্বন্দ্ব শুরু হয়। পিতার মৃত্যুর পর সম্রাট অশোক তার ৯৮ ভাইকে হত্যা ও অন্য ভাইদের পরাজিত করে সিংহাসন দখল করেন। এ জন্য তাকে অশোকও বলা হয়ে থাকে।
ধারনা করা হয়, খ্রিষ্টপূর্ব ২৬০-৬৩ অব্দের দিকে সম্রাট অশোক কলিঙ্গ রাজ্য জয় করেন। এই যুদ্ধে কলিঙ্গবাসী সর্বশক্তি দিয়ে অশোকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার পরও কলিঙ্গবাসী পরাজিত হয়। এই যুদ্ধে প্রায় এক লক্ষ নর-নারী প্রাণ হারায় এবং প্রায় দেড় লক্ষ নর-নারী বন্দী হয়। যুদ্ধের পিশাচীয় ঘটনায় সম্রাট অশোক বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন। নিজের মধ্যে অনুশোচনারও জন্ম হয়। তখন তিনি যুদ্ধের পথত্যাগ করে অহিংসার পথে সাম্রাজ্য পরিচালনার নীতি গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তিনি উপগুপ্ত নামক এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর কাছে দীক্ষা নিয়ে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন।
খ্রিষ্টপূর্ব ২৬৯ অব্দের দিকে সম্রাট অশোক ‘সম্রাট’ হিসেবে অভিষেক লাভ করেন। এর পর তিনি ‘দেবানাম-প্রিয়-পিয়দাসী’ অর্থাৎ ‘দেবতাদেরও প্রিয় প্রিয়দর্শী’ উপাধি ধারণ করেন। সম্রাটের অহিংস হয়ে ওঠার গল্প থেকে জানা যায় তিনি ছিলেন প্রচন্ড ক্ষমতালিপ্সু রক্তক্ষয়ী মানুষ।
আমার ঠাকুরমা বলতেন, তুমি যেখানে বসবে তার চারপাশ ভাল করে পরিস্কার করে বসবে। কারো পরিস্কার করার অপেক্ষায় থাকবে না বা পরিস্কার করার ভয়ে অন্যত্র চলে যাবে না। যদি পরিস্কার না করো তাহলে তোমার গায়ে ময়লা উঠবে। আবার যদি পরিস্কার করার ভয়ে অন্যত্র চলে যাও তাহলে সেই জায়গাটা সবসময় অপরিস্কার থেকে যাবে।
গল্পটি বলার অর্থ, সম্রাট অশোক নিজের পাপের জন্য নিজের অনুশোচনা হয়েছিল। তাই তিনি অহিংসার পথ বেছে নিয়েছিলেন। এ সবই ঠিক ছিল, তবে তিনি বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন এটা ঠিক করেননি। অর্থাৎ যে ব্যক্তি শুধুমাত্র নিজের শান্তি এবং স্বার্থের জন্য ধর্ম, দল এবং দেশ ত্যাগ করেন তিনি হচ্ছেন সবচেয়ে বড় স্বার্থপর। ধর্ম ত্যাগ না করেও অন্য ধর্মের ভাল কিছু অনুসরণ করা যায়। সম্রাট অশোক তা-ই করতে পারতেন। বরং তিনি তা করেননি। তিনি নিজেকে মহৎ পরিচয় দিতে নিজ ধর্ম ত্যাগ করে অন্য ধর্ম দীক্ষা নিয়েছিলেন।
অনেকেই বলবেন পৃথিবী ব্যাপী বৌদ্ধ ধর্ম হচ্ছে বড় ধর্ম। এ ধর্মে অহিংস শিক্ষা দেওয়া হয়। তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, বৌদ্ধ সিংহ যদি অহিংস হয়ে থাকে, তাহলে ১৯৭৮ সালে মিয়ানমারে ১০ হাজার মুসলমান রোহিঙ্গা শহীদ করা হয়েছিল কেন? ১৯৯৭ সালে মায়ানমারের বৌদ্ধ সরকার ২৭ টি মসজিদ ভেঙ্গে ফেলেছিল কেন? আরাকানের রোহিঙ্গা মুসলমানদের সমুলে উৎখাত করে আরাকানের নাম পরিবর্তন করে রাখাইন প্রে করেছিল কেন? বৌদ্ধ সংখ্যা গরিষ্ঠ থাইল্যান্ডে মুসলমানদের ইসলামী নাম রাখা কেন নিষিদ্ধ করেছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রনালয়? কম্বোডিয়ায় মুসলমানরা খেমাররুজ গেরিলাদের দ্বারা সমুলে উৎখাত হয়েছে কেন? ভুটানে মসজিদ নির্মানের অনুমোদনযোগ্য নয় কেন? ভিয়েতনামে অবস্থানরত অনেক মানুষ বৌদ্ধদের ভয়ে ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য করা হচ্ছে কেন?
উপরিউক্ত সকল আলোচনা থেকে অবশ্যই বোঝা গেল জগতে কোন কিছুই অপরিবর্তনীয় নয়। কোন কিছুই স্থির নয়। ক্ষমতাও ঠিক তেমন পরিবর্তনশীল। একদল ক্ষমতায় থাকে অন্যদল সমালোচনা করে। আজ যে দল ক্ষমতায় আছে, তাদের কাজে যেমন সমালোচনা করা হচ্ছে, তেমনি অন্য দল ক্ষমতায় গেলে তারাও সমালোচনা করবে।
তাছাড়া একটা বিষয় অবশ্যই স্পষ্ট বোঝা যায় বৌদ্ধ ধর্ম যদি অহিংস্র হয়, তাহলে তাদের প্রতীক কি করে সিংহ হতে পারে! তারা অবশ্যই গাধা বা অন্য শান্ত প্রকৃতির প্রানীকে প্রতীক হিসেবে নিতে পারতেন। হিংস্রতা যদি গ্রহণযোগ্য না হয় তাহলে দেবী দূর্গার হিংস্র মূর্তি বা মা কালীর হিংস্র মূর্তি কেন পুজিত হয়! একবার ভাবুন তো হুংকার ছাড়া সিংহ আপনার চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে আপনার কি তাকে সিংহ মনে হবে? একজন মানুষের ব্যক্তিত্ব না থাকলে কি তাকে মানুষ বলা যায়? তেমনি সিংহের যদি হিংস্রতা না থাকে তাহলে তাকে কেন পশুর রাজা বলা হয়?
সবশেষে বলতে চাই, অহিংস্র সম্রাট অশোক যেমন সহিংস্র ছিলেন, আবার বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হলেও সকলেই অহিংস্র হয় না। তেমনি বিজেপি সরকারের নির্মিত নতুন অশোক স্তম্ভের সিংহের মুখ দেখতে হিংস্র হলেও আসলে তা হিংস্র নয়। আজ ক্রোধের বসে যে সিংহের মুখ দেখে আপনাদের হিংস্র মনে হচ্ছে আসলে, এটা সিংহের বীরত্বের প্রতীক। তাই বিজেপি বিরোধীদের প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি, হিংসা নয়, মানসিকতা বদলে ফেলুন প্রেক্ষাপট বদলে যাবে।
(www.theoffnews.com Bangladesh Ashok stambho)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours