পলাশ মুখোপাধ্যায়, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

“হোয়াট বেঙ্গল থিংকস টুডে, ইন্ডিয়া থিংকস টুমরো”, অর্থাৎ বাংলা আজ যা ভাবে গোটা ভারত তা ভাবে আগামীতে। গোপাল কৃষ্ণ গোখলের এই বিখ্যাত উক্তির যথাযথ রূপায়ণ কিন্তু মোদি সরকারের হাত ধরে আবার দেখা গেল। বাংলার দেখানো পথ ধরেই কেন্দ্রও এবার সেনাবাহিনীতে সিভিক ভলান্টিয়ার গোছের কিছু তরুণ তরুণী নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই নিয়োগের নাম দেওয়া হয়েছে “অগ্নিপথ”, যারা এই প্রকল্পের মাধ্যমে নিযুক্ত হবেন তারা অগ্নিবীর। আর সেখানেই বেধেছে গোল। অগ্নিপথের বিরুদ্ধে ভবিষ্যৎ অগ্নিবীরদের বিক্ষোভে অগ্নিগর্ভ গোটা দেশ। কেন্দ্র ভেবেছিল তাদের অন্যান্য জনবিরোধী ঘোষণার মত এই ঘোষণার পরও বুঝি সাধারণ মানুষকে ভুল বুঝিয়ে পার পেয়ে যাবে। কিন্তু এক্ষেত্রে আর তেমনটা হয়নি। বিশেষ করে উত্তর এবং মধ্য ভারতের মানুষ যারা এতদিন বিজেপির জয়গান গেয়ে এসেছে মূলত তারাই এবার সরাসরি কেন্দ্রের বিরুদ্ধে পথে নেমেছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি তো ঘোলা জলে মাছ ধরবেই, কিন্তু এবার যেটা বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় রঙ সরিয়ে দেশের যুবসমাজ স্বতস্ফুর্ত ভাবেই এই বিরোধীতায় নেমেছে। 

এই আলোচনায় প্রবেশের আগে একবার দেখে নেওয়া যাক এই প্রকল্প ঠিক কি? কেনই বা এর বিরোধীতা করছে সকলে। অগ্নিপথ  নিয়োগের ক্ষেত্রে ন্যূনতম বয়স ১৭.৫ বছর। সর্বোচ্চ বয়স ২১ বছর। শুধু এ বছরের জন্য বয়সের সর্বোচ্চ সীমা শিথিল করে ২৩ বছর করা হচ্ছে। এই প্রকল্পে বার্ষিক বেতন ৪.৭৬ লক্ষ টাকা থেকে ৬.৯২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত। আয়ের ৩০ শতাংশ ‘সেবা নিধি’তে জমানো যাবে। সমপরিমাণ টাকা দেবে সরকারও। বেতনের পাশাপাশি মিলবে রেশন, উর্দি এবং যাতায়াতের ভাতা। চার বছরের মেয়াদ শেষে কাজের ভিত্তিতে ২৫ শতাংশকে দেওয়া হবে সেনার স্থায়ী কমিশন। বাকি ৭৫ শতাংশের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। তাদের এককালীন ১১.৭ লক্ষ টাকা ভাতা দেওয়া হবে। আর কোনও অবসরকালীন সুবিধা পাওয়া যাবে না। স্থায়ী কমিশন না পেলেও এই ৭৫ শতাংশ আধা সামরিক বাহিনী-সহ সরকারি চাকরিতে অগ্রাধিকার পাবেন। অন্যান্য সাধারণ চাকরিতেও মিলবে অগ্রাধিকার। পরে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে ফের তলব করা হতে পারে তাঁদের। ৪ বছর মেয়াদ শেষে এই ৭৫ শতাংশ পাবেন অগ্নিবীর শংসাপত্র। কেউ ব্যবসা করতে চাইলে সরকার তাদের ন্যূনতম সুদের হারে ঋণও দেবে। সেনাতে কাজ করার সময় মৃত্যু হলে বিমা বাবদ ৪৮ লক্ষ টাকা এবং অতিরিক্ত ৪৪ লক্ষ টাকা অনুদান পাবে পরিবার। সেই সঙ্গে মিলবে চার বছরের চাকরি জীবনের বাকি মেয়াদের বেতনও। অগ্নিবীর হিসাবে কাজ করার সময় অঙ্গহানি হলে ১৫ থেকে ৪৪ লক্ষ টাকা অনুদান এবং সেই সঙ্গে মিলবে চাকরি জীবনের বাকি মেয়াদের বেতন।

সমস্যা যেখানে প্রধান সেটা হল, “অগ্নিপথ” চালু হওয়ার পর সেনার নিম্নপদে স্থায়ী নিয়োগ আপাতত বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সেনাবাহিনীর তরফে জানানো হয়েছে যে, এখন কেবলমাত্র অগ্নিপথ যোজনার মাধ্যমেই নিয়োগ নেওয়া হবে এবং আগের নিয়োগ পদ্ধতিগুলি আপাতত বন্ধ হয়ে যাবে। পাশাপাশি অগ্নিবীর হিসাবে নিযুক্ত হলেও চার বছর পর তাঁদের ভবিষ্যৎ বেশ অনিশ্চিৎ, তাই নিয়ে চিন্তিত সেনায় চাকরিপ্রার্থীরা। স্থায়ী চাকরি না পেলে চিকিৎসা সহ কোনও রকম অবসরকালীন সুযোগ সুবিধা মিলবে না। বয়সের ঊর্ধ্বসীমার জন্য বছরের পর বছর সেনার চাকরির প্রস্তুতি নেওয়া যুবক-যুবতীরা চাকরির সুযোগই পাচ্ছেন না। 

নতুন প্রকল্পে বছরে ৪৫ থেকে ৫০ হাজার ‘অগ্নিবীর’ নিয়োগ হবে। বেশিরভাগেরই কর্মজীবনের মেয়াদ থাকবে মাত্র চার বছর। প্রতিবছর যা নিয়োগ হবে, তার মাত্র ২৫ শতাংশ আরও ১১ বছর কাজের সুযোগ পাবেন। বর্তমানে দেশের সেনাবাহিনীতে জওয়ানের সংখ্যা ১৩ লক্ষেরও বেশি। নতুন প্রকল্পে সেখানে বছরে নিয়োগ হবে মাত্র ১২ হাজার জওয়ান। বছরে দু’বার নিয়োগ হলে, সংখ্যাটা দাঁড়াবে ২৪ হাজার। তাও মাত্র ১৫ বছরের জন্য। এতে পেনশন নিয়ে সরকারের উদ্বেগ কমবে। পেনশন নিয়ে সেনাকর্মীদের দাবি দীর্ঘদিনের। নতুন প্রকল্পের সাহায্যে সেই দাবিকেও ঘুরিয়ে পাশ কাটানো যাবে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু, এতে স্থায়ী সেনার সংখ্যা কমবে বলে তাঁরা উদ্বিগ্ন। স্থায়ী সেনাকর্মীরা অবসরের পরেও চিকিৎসা, যাতায়াতে ছাড়, কোনও কিছু কেনাকাটা করা সহ অন্যান্য বিভিন্ন ব্যাপারে আজীবন সুবিধা পান। এই প্রকল্পে নিযুক্তদের সেই ব্যাপারে কোনও আশ্বাস দেওয়া হয়নি। মোট কথা আমাদের সামনে যে সিভিক ভলান্টিয়ারদের দেখি এও অনেকটাই তেমন ব্যাপার। অনেকটা দায়িত্ব এড়িয়ে, বেতন কম দিয়ে, এমনকি পুলিশ কথাটিও ব্যবহার না করে যেভাবে সিভিক ভলান্টিয়ারদের দিয়ে পুলিশের অধিকাংশ কাজটা জলের দরে করে নেওয়া হয়, অগ্নিপথ তারই কেন্দ্রীয় প্রতিরূপ। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে দেশের নিরাপত্তায় যারা নিযুক্ত হবেন তাদের মাথায় যদি চার বছরে চাকরি চলে যাওয়ার টেনশন প্রথম থেকেই দিয়ে দেওয়া হয় তাহলে সেই কাজে তারা কতটা মনপ্রাণ দেবেন তা নিয়ে। এও প্রশ্ন উঠেছে নবনিযুক্ত অগ্নিবীররা যখন দেখবেন তাদের সঙ্গে কাজ করা স্থায়ী জওয়ানদের বেশি বেতন এবং সুযোগ সুবিধা তখন তাদের মনোবলে চিড় ধরবে না তো? বিশেষজ্ঞদের মতে এখন পাঁচ ছয় বছরের অভিজ্ঞ জওয়ানদের তুলনামূলক কঠিন জায়গাতে পাঠানো হয়, তাদের অভিজ্ঞতা সহায়ক হয়। কিন্তু এর পর সামান্য অভিজ্ঞতাতেই অগ্নিবীরদের কাজ করতে হবে যে কোনও জায়গায়, যে কোনও পরিস্থিতিতে। সেটা তাদের জন্য তো বটেই, দেশের জন্যও বিপদজনক। এখন দেখার প্রবল বিক্ষোভের মুখে কৃষিবিলের মত অগ্নিপথও প্রত্যাহারের পথে কেন্দ্র হাঁটে কিনা। সে যাই হোক এমনটা যে করাই যায় তা বাংলা আজ থেকে প্রায় বছর পনেরো আগেই দেখিয়ে দিয়েছে। “হোয়াট বেঙ্গল থিংকস টুডে…”

(www.theoffnews.com - agnibir agnipath civic volenteer)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours