রূদ্রাণী মিশ্র, লেখিকা ও কবি, কলকাতা:

আজকালকার সমাজে চারিদিকে নানা ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে। রোজ নানা মাধ্যম থেকে আমরা খবরগুলো জানি এবং শুনে থাকি। আপনারা বলবেন কেন আগে হত না? নাহ অস্বীকার করার জায়গা নেই। তবে এটাও ঠিক যে এখনকার মত ভয়াবহতা তখন ছিল না।

এত গৌড়চন্দ্রিকার কারণ, এবার খুলে বলি। আমার মতে যে সমাজ বই পড়তে জানে না বা বই পড়তে ভুলে গেছে, সেই সমাজ অবক্ষয়ের পথে যেতে বাধ্য। সেই সমাজে দয়া, মায়া, বিবেক আশা করা, অনেকটা যেন মরুভুমিতে ধানক্ষেত খোঁজা। আগে যখন টিভি বলতে শুধুমাত্র দূরদর্শন বোঝাত। তার সময়সীমাও ছিল, বাঁধাধরা। ফলতঃ তখন লোকজনের বই ছাড়া আর কোনও কিছুই অবসর যাপনের জন্য ছিল না। সেসময় ছোটদের জন্য চাঁদমামা, শুকতারা, আনন্দমেলা এরকম ছোটদের ম‍্যাগাজিন তো ছিলই। উপরন্তু অমর চিত্রকথা, নামের কমিকসের বইও ছিল, যা ছবি দিয়ে এবং কথপোকথনের সাহায্যে বড় গল্পকে ছোট করে তুলে ধরা হত। ছোট ছেলেমেয়েরা মনের আনন্দে ওইসব পড়ত, তার ফলে বড় আসল গল্পগুলো না পড়া হলেও, মোটামুটি জিস্ট তারা জানত। যেমন, বঙ্কিমচন্দ্রের লেখা দেবী চৌধুরানী, আনন্দমঠ, রানা প্রতাপ, শিবাজী, বিদ‍্যাসাগরের জীবনী এই রকম নানা গল্প। অনেক স্কুলে লাইব্রেরি বলে একটা পিরিয়ড ও থাকত, ক্লাস ফাইভ থেকে। সেই পিরিয়ডে স্কুল থেকে বই দেওয়া হত, একসপ্তাহ পর ফেরত দিয়ে আবার নতুন বই। এতো গেল ছোটদের কথা। বড়রাও বঞ্চিত হতেন না, বই পড়ার আনন্দ থেকে। পাড়ায় পাড়ায় গ্ৰন্থাগার থাকত, সেখান থেকে তারা বই এনে পড়তে পারতেন। উপরন্তু সন্ধেবেলা ওইসব গ্ৰন্থাগারের রিডিং রুমে সব ধরণের সেদিনের খবরের কাগজও থাকত, অনেকেই ওখানে বসে বসে খবরের কাগজ পড়তেন। আর আবালবৃদ্ধবনিতার জন্য বইমেলার কথা না বললে তো অনেক কিছু বলা বাকি থেকে যাবে। হ‍্যাঁ, ঠিক বলেছেন, এখনও বইমেলা হয়। তবে আমার জানা মতে এখন যারা বই কেনেন, তারা ওই ফ্লিপকার্ট, আ্যামাজনের উপরই পুরোপুরি নির্ভর করেন। কেউ কেউ তো আরেক ডিগ্ৰী উপরে, তারা পিডিএফ নামিয়ে মোবাইল বা কম্পিউটারে পড়ে নেন (আমি তো ভাবতেই পারি না, বইয়ের গন্ধ না শুঁকে, পড়তে পড়তে বইয়ের উপর না ঘুমিয়ে, লোকজন বই কিভাবে পড়ে?) তাই বইমেলা কতটুকু বইয়ের জন্য, সেই প্রশ্নটা থেকে যায়। তবে লিটিল ম‍্যাগাজিন গুলো এখনও একটু অক্সিজেন পায়, এই বইমেলা থেকে। একথা অস্বীকার করার জো নেই।

এতদূর পড়ে নিশ্চয়ই ভালভাবে বোঝা যাচ্ছে, তখনকার লোকজনের মধ্যে পড়ার চল ছিল। কিন্তু অত‍্যন্ত দুঃখের বিষয় সেই বইপ্রীতি আজকাল আমার চোখে পড়ে না। এখনকার বেশিরভাগ বাচ্ছাদের তো আমি পড়তে (পড়ার বই ছাড়া) দেখতেই পাই না। আমার পাশের বাড়ির একটি মেয়ে সে জানে না, তার পড়ার বইয়ের কোথায় কী আছে। কিন্তু ভিনদেশীয় ওয়েব সিরিজ 'স্কুইড গেম' নেটফ্লিস্কে দেখানো হয়েছে। তা সে ইংরেজি ভাল মত না জানলেও, জানে। আমার জানা মতে এই ওয়েব সিরিজটিতে বটম লাইন হল, 'মরো বা মারো'। আপনারা আশা করছেন কিভাবে, যে এইরকম ওয়েব সিরিজের দর্শক যেখানে ভুরি ভুরি, সেখানে লোকজনের মধ্যে দয়া, মায়া, বিবেক, বিবেচনা এইসব সুক্ষ্ম কোমল সুকুমারবৃত্তি গুলো থাকবে? তারা তো মর না হলে মারো মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে গেছে। প্রেম ভালোবাসা, ত‍্যাগ ওগুলো ওদের কাছে 'বাতুলতা'। তাই এখন হয়তো মোমবাতি জ্বালিয়ে নিয়ে খুঁজলেও আগের বাঙালি পাওয়া খুব মুস্কিল।

কয়েকদিন আগে ডঃ কৃষ্ণা বসু একটি কবিসভায় বক্তৃতা দিয়ে বলেছিলেন। "স্বশিক্ষিত মানেই সুশিক্ষিত"। তিনি আরও বলেছিলেন, তিনি একবার তার ভাগ্নের কাছে ফ্রান্সে গেছিলেন। তখন ভাগ্নের কথা মতো তিনি ট্রেন ধরে ভাগ্নের বাড়ী গেলেন। যাওয়ার পথে দেখতে পেলেন, ট্রেনের মধ্যে, ট্রেনের বাইরে, পার্কে সব জায়গায় লোকজন হাতে বই নিয়ে চুপচাপ পড়ে যাচ্ছে। কেউ কাউকে বিরক্ত করছে না। এবার আপনি বলুন পাঠক, সেই দেশ এগোনো উচিত না যে দেশের লোকজন বইকে ভুলে গেছে, তারা এগুবে?

এই বলে ক্ষান্ত দিতে পারছি না। কেন? বলছি। সেদিন বই নিয়ে ফেসবুকের এক বন্ধুর পোস্টে কথা হচ্ছিল। সেখানে একজন লেখিকা (বন্ধুটি জানালেন) আমায় বললেন "মানবিকতা দয়া মায়া বই পড়ে শেখা যায় না। পৃথিবী দেখে শিখতে হয় … কালো অক্ষরে যা লেখা থাকে, তার প্রভাব খুব একটা সুদূরপ্রসারি হয় না ..." বিশ্বাস করুন আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছিল না, যে মহিলা একজন শব্দকর্মী। একজন শব্দকর্মী কিভাবে এই কথা বলতে পারেন?  তাহলে সাধারণ মানুষের দোষ কোথায়? তারা তো টিভি দেখে পৃথিবী শিখছেন। যারা এইরকম মানসিকতায় ভোগেন, তাদের কাছে আমার কয়েকটি প্রশ্ন আছে।

১) লেখকের লেখা ব‍্যান হয় কেন?

২) ছোটবেলা ভাল ভাল কথার বই বাচ্ছাদের পড়ানো হয় কেন? 

৩) খারাপ বই খারাপ মানসিকতা ছড়াবে, এমন বই পোড়ানো হয় কেন?

৪) আগেকার দিনে মেয়েদের পাঁচালি, মেয়েদের ব্রতকথা এসব কিছু ছাড়া পড়তে দেওয়া হত না, কেন?

৫) লেখকদের খুনের হুমকি দেওয়া হয় কেন? 

৬) কিছু লোকজনকে কেন বলতে শোনা যায়, ওই বই আমার জীবন যাত্রা পাল্টে দিয়েছে?

৭) লেখার জন্য হাজতবাস করতে হয় কেন? বা কোর্ট আর বাড়ি করতে হয় কেন? ( মান্টো, ইসমৎ চুগতাই)

মূলকথা কি জানেন, আমরা জন্মের পর থেকে প্রতি মূহুর্তে শিখে চলি। কেউ যখন নতুন রান্না করে, তাকে অভিজ্ঞ রাঁধুনি থেকে গাইড নিতে হয় না? (এখন অবশ্য ইউটিউব আছে) তেমনি লেখা পড়ে আমরা বুঝতে, জানতে, শিখতে চেষ্টা করি। যা লেখক আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাতে চেষ্টা করেছেন। আমার চেনা একজন এক লেখককে বলছিলেন, তখন কান পেতে শুনেছি, তিনি বলছিলেন, "জানেন, আপনি যা লেখেন, তা আমাদের চোখের সামনে রোজ হয়, কিন্তু মনে হয়, ওটা তো স্বাভাবিক, ওটা তো ঘটে আসছে। এমনটাই তো হয়। তারপর আপনার লেখা পড়ে মনে হয়, না সত‍্যি তো, এটা তো অন‍্যায় হয়ে এসেছে। শুধু আমাদের উপলব্ধির অভাবের জন্য আমরা বুঝতে পারি না"। তাই বলছি, কথাটা একটু কিতাবি লাগলেও, বই আমাদের ভাবায়, শেখায়, বোঝায়, চোখে আঙ্গুল দিয়ে ভুল দেখিয়ে দেয়। তবেই তো বলা হয়, বই প্রকৃত মানুষ করতে সাহায্য করে। সেই জন্য বলতেই হচ্ছে, ওই কালো অক্ষরগুলো সত্যিই অনেক সুদুরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করার ক্ষমতা রাখে। বিশ্বাস করুন।

(www.theoffnews.com - book)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours