দেবিকা ভট্টাচার্য, লেখিকা ও লেকচারার, চন্দননগর, হুগলি:

কুসুমগ্রামের মুন্সী বাড়িতে গান শেখাতে আসতেন শিক্ষক সতীশ চক্রবর্তী। সেখানেই খুড়তুতো দাদা ইব্রাহিম মুন্সীর অভিভাবকত্বে ভাই মহম্মদ কাশেমের সংগীতে হাতেখড়ি। ভাইয়ের সংগীত প্রতিভার জন্য ইব্রাহিম, কাশেমকে স্নেহ করতেন খুব, নাম দিয়েছিলেন 'মানু'। হঠাৎ-ই কলেরায় ইব্রাহিমের মৃত্যু হলে কাজ এবং সংগীত—দুইয়ের টানে 'মানু'কে সতীশ চক্রবর্তীর হাত ধরেই কলকাতা চলে আসতে হয়। সেখানে তুলাপট্টিতে চামড়ার গুদামে সামান্য বেতনের কাজ পান। অমানুষিক পরিশ্রমের পর ফুটপাতে রাত্রিযাপন করতে করতে দোকানদারের নির্দেশেই কানপুরে র‌্যালি ব্রাদার্স কোম্পানীতে সাতটাকা মাইনের কাজ নিয়ে কানপুর পাড়ি দেন। তখনও তাঁর সঙ্গীতের প্রতি আকর্ষণ ছিল অদম্য। আবদুল হাই হাকিমের কাছে শুরু করেন সঙ্গীত শিক্ষা। একসময় পাগলা ফকিরদের আশীর্বাদ এবং অনুমতি নিয়ে ফিরে আসেন কলকাতায়। সে সময় কলকাতায় এসে গেছে রেকর্ড কোম্পানী। গহরজান, কৃষ্ণভামিনী, বেদানাদাসীরা করেছেন বাজার দখল। একদিন বন্ধুদের আবদারে তুলাপট্টির মোড়ে কাশেমের গান শোনানো শুরু হতেই প্রবল যানজটে আটকে পড়ে রেকর্ড কোম্পানীর মালিকের গাড়ি। হঠাৎ-ই গাড়ি থেকে নেমে আসা মালিকের পক্ষ থেকে সরাসরি আমন্ত্রণ পান গান রেকর্ড করার। দিনে তিনশো টাকা রয়্যালটি। তখন কাশেমের মনে লালিত হচ্ছে ভক্তিগীতি, লেটো, গাজন, কৃষ্ণকীর্তন, কমলাকান্তের শ্যামাসঙ্গীত, দাশরথি রায়ের পাঁচালি।

মুসলিম গায়কের কণ্ঠে হিন্দু ভক্তিগীতি কেমন চলবে, এই আশঙ্কাতে নতুন নামের জন্ম—কাশেমের কে এবং শুভানুধ্যায়ী গোরাচাঁদ মল্লিক ও শান্তি মল্লিকের থেকে মল্লিক পদবী নিয়ে 'কে মল্লিক'।

ভাবলে অবাক হতে হয় সে সময় নজরুল ইসলামের গানের সঙ্গেও মানুষের পরিচয় নেই। গোলাম কুদ্দুসের লেখা থেকে জানা যায়—

একদিন গ্রামাফোন ক্লাবে বাংলা ডিপার্টমেন্টের বড়োকর্তা ভগবতীচরণ ভট্টাচার্যের কাছে নলিনী সরকার নামে একজন এসে একখানা খাতা দিয়ে বললেন, —'দেখুন তো এই বাংলা গজল গানগুলি রেকর্ড করা যায় কিনা' 

বড়বাবু প্রশ্ন করলেন, —'কে লিখেছে?'

—'কাজী নজরুল ইসলাম।'

বড়বাবুকে মল্লিককে ডেকে নিয়ে নজরুল ইসলামের লেখা একখানা গানের খাতা তাঁর হাতে দিলেন যাতে গজল ছাড়াও বিভিন্ন ধরণের গান রয়েছে। কে মল্লিক "বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুলশাখাতে দিস নে আজি দোল" এবং "আমারে চোখের ঈশারায় ডাক দিলো হায় কে গো দরদী" এই দু'খানা গান নিয়ে খাতাটি নলিনী সরকারের হাতে দিয়ে বললেন,—'এই দু'খানার বাজার দেখে তারপর অন্য গান নেওয়া যাবে।'

এরপরেরটুকু ইতিহাস। নজরুলের সে গানের সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য গানও অমর অক্ষয় হয়ে গেছে খুব স্বাভাবিক ভাবেই। বড়বাবু ভগবতীচরণের ইচ্ছে কে মল্লিক ভজন, দেহতত্ত্ব, শ্যামাসংগীত অনেক গেয়েছেন, এবার কাজীকে আনিয়ে তাঁর লেখা আরও গান গাওয়ানোর। কে মল্লিক গ্রামাফোন ক্লাবে নিয়ে আসেন নজরুলকে। সেখানে কোম্পানীর পরামর্শ অনুযায়ী বিদ্রোহের রণদামামা বাজানো যাবে না, ঝাঁঝালো স্বদেশী গান চলবে না বৃটিশ কোম্পানীর আওতায়, এমন গান লিখতে হবে যাতে পয়সা আসে। দেশের মানুষ ধর্ম প্রবণ, ধর্মীয় গানে তাই আপত্তি নেই। এবার হিন্দু সংগীত, ইসলামী সংগীত—দুই দিয়েই বাজার দখল করার চেষ্টা চলল।

রজনীকান্ত, অতুল প্রসাদ, রবীন্দ্রনাথের গান কিছু কিছু গাইলেও ১৯০৯— ১৯৪৮ পর্যন্ত নজরুলের গানে কে মল্লিকের খ্যাতি জগৎ জোড়া। যদিও ১৯৪৬ খ্রীষ্টাব্দে এত নাম যশকে সরিয়ে রেখে কলকাতা ছেড়ে নিজের গ্রামে ফিরে এসে স্থানীয় কৃষকদের মধ্যে বিনামূল্যে সংগীত শিক্ষা দিতে শুরু করেন। ১৯৫৯ খৃষ্টাব্দে (১৩৬৬) তিনি সেখানেই দেহরক্ষা করেন। তাঁর কাছে তালিম নেওয়া আঙুরবালা, ইন্দুবালার নাম যদিও কিছুটা রয়ে গেছে, একেবারে চাপা পড়ে গেছে 'কে মল্লিক' নামটি।

বর্ধমান জেলার কালনা মহকুমার মন্তেশ্বর থানার কুসুমগ্রামের মুন্সী পরিবারে আজকের দিনে অর্থাৎ ১২ই জ্যৈষ্ঠ১৮৮৮ (১২৯৫) খৃষ্টাব্দে জন্ম হয়েছিল মহম্মদ কাশেম, কে মল্লিকের, যাঁকে আবুল আহসান চৌধুরী 'বাংলা গানের বিস্মৃত যুবরাজ' বলেছেন।

(www.theoffnews.com - song)


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours