বিভা ভট্টাচার্য, লেখিকা ও অধ্যাপিকা, কলকাতা:

কমিউনিস্ট ভাবধারায় অনুপ্রাণিত লীলা মজুমদার যেমন একদিকে ছিলেন একজন রাজনৈতিক কর্মী, তেমনি সংসার, সন্তান প্রতিপালনের প্রতি দায়বদ্ধ এক ব্যতিক্রমী নারী। ১৯২১ সালে বিহারের বারসোই গ্রামে তাঁর জন্ম। তাঁর পিতা ছিলেন জেলা বোর্ডের একজন ডাক্তার, তিনি বিভিন্ন স্থানে বদলি হতেন। লীলা মজুমদার বড় হয়ে ওঠেন রংপুরে জ্যাঠামশাই, জেঠিমা, জ্যাঠতুতো ভাইবোনদের সাথে যৌথ পরিবারে। যখন তাঁর এগারো বছর বয়স, ষষ্ঠ শ্রেণীর বৃত্তি পরীক্ষা দিয়েছেন, তখন তাঁর মা কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়ে মারা যান। ওই এগারো বছর বয়সে লীলা যেন হঠাৎ বড় হয়ে গেলেন, বাবা, দাদা সহ তিন ছোট ভাইয়ের (যার মধ্যে সবথেকে ছোট ভাইয়ের বয়স ছিল মাত্র আড়াই বছর) সংসারে তিনিই হয়ে ওঠেন কর্ত্রী। বৃত্তি পরীক্ষায় সফল হয়েও তাঁর স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। প্রথাগত শিক্ষা লাভের সুযোগ না পেলেও বাড়িতে তিনি পড়াশোনা চালিয়ে যান, প্রাইভেটে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেন। পরে ছোটো ভাইয়ের সাথে প্রাইভেটে ইন্টারমিডিয়েট (কলাবিভাগ) পাশ করেন। ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেওয়ার সময় তিনি কমিউনিস্ট ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে 'মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি'র সদস্য পদ গ্রহণ করেন। আত্মরক্ষার নানা কৌশল, লাঠি খেলা, ছোরা খেলা শেখেন।

লীলা মজুমদার একটা রাজনৈতিক পরিমন্ডলের মধ্যেই বড় হয়েছিলেন। তাঁর বাবা, ভাই ছিলেন ফরোয়ার্ড ব্লকের সমর্থক তাঁর জ্যাঠতুতো দিদির স্বামী বীরেন রায়চৌধুরী কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত ছিলেন, তাঁর কাছ থেকেও লীলা মজুমদার প্রেরণা পেয়েছিলেন। তেভাগা আন্দোলনের সময় সক্রিয় ভাবে অন্যান্য মহিলা আন্দোলনকারীদের মতো তিনি সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছেন। ১৯৪৮ সালে জননিরাপত্তা আইনে কমিউনিস্ট পার্টি এবং মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি নিষিদ্ধ হয়, লীলা মজুমদার প্রথমবারের জন্য গ্রেফতার হলেন, কয়েক সপ্তাহ কারাবাসের পর মুক্তি পান।

এই সময় থেকেই লীলা মজুমদারের জীবন এক সাথে বহু সমান্তরাল ধারায় প্রবাহিত হতে থাকে। স্বাধীনতার কয়েক বছর আগে জলপাইগুড়িতে চলে আসার পর তিনি শিশু মহল নামে একটি স্কুলে যোগ দেন শিক্ষিকা হিসেবে। তিনি ছিলেন স্কুলের জনপ্রিয় শিক্ষিকা। কিন্তু জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর পুলিশের খাতায় তাঁর নাম উঠে যাওয়ায় শিক্ষিকা হিসেবে তাঁর চাকরি পাওয়া কঠিন হয়ে ওঠায় তিনি পেশা হিসেবে বিমা কর্মী হিসেবে কাজ শুরু করেন, এবং আজীবন তিনি অত্যন্ত দক্ষতা ও মানবিকতার সাথে এই কাজ করেছেন। একই সাথে তিনি ছিলেন একজন সক্রিয় পার্টি কর্মী। ১৯৫০ সালে কমিউনিস্ট নিধন পর্বে তাঁকে দ্বিতীয় বারের জন্য জেলে যেতে হয়। জেলার ছোট্ট জেলে তিনি ছিলেন একমাত্র মহিলা বন্দী। এই সময় পার্টি ক্যাডারদের রাজনৈতিক বন্দীর মর্যাদা দেওয়ার দাবি জানাচ্ছিল। লীলা মজুমদার এই দাবির সমর্থনে  অন্য পুরুষ কমরেডদের সাথে অনশন শুরু করেন জেলের অভ্যন্তরে। মহিলা হিসেবে তিনি কোনরকম বাড়তি সুবিধা নিতে রাজি ছিলেন না। এরপর তাঁকে জলপাইগুড়ি থেকে কলকাতার জেলে পাঠানো হয়। সেখানে তাঁর সাথে পার্টির জাতীয় স্তরের নেত্রী গীতা মুখোপাধ্যায়, মণিকুন্তলা সেনের সাথে পরিচয় হয়, আজীবন তাঁদের সেই বন্ধুত্ব অটুট ছিল।জলপাইগুড়িতে সিপিআইয়ের কৃষক সভার দক্ষ সংগঠক হিসেবে কাজ করার সময় লীলার আলাপ হয়েছিল সহকর্মী চারু মজুমদারের সাথে। দুজনের ঘনিষ্ঠতা বাড়ে, তাঁরা একসাথে নতুন জীবন শুরু করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১৯৫২ সালে খুব অনাড়ম্বর ভাবে তাঁদের বিবাহ হয়, এরপর তিনি চারু মজুমদারের সাথে চলে আসেন শিলিগুড়িতে, জীবনের এক নতুন অধ্যায় শুরু হয় লীলার।

শিলিগুড়িতে আসার পর দুজনেই সিপিআইয়ের দার্জিলিং জেলা কমিটির সাথে যুক্ত হন। লীলা পরপর দুবার জেলা পার্টি কমিটির নির্বাচনে জয়ী হন। ১৯৬৪ সালে চারু মজুমদারের মতো তিনিও সিপিআই ছেড়ে সিপিআইএম এ যোগদান করেন। এরপর কয়েক বছরের রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহ লীলা মজুমদারের জীবনেও প্রভাব ফেলেছিল। ১৯৬৭ সালের নকশালবাড়ি আন্দোলন, চারু মজুমদারের নেতৃত্বে সিপিআইএমে ভাঙন, সিপিআইএমএল গঠন, নকশাল আন্দোলন, রাষ্ট্রীয় দমনপীড়ন, চারু মজুমদারের গ্রেফতার এই ঘটনা প্রবাহের কোথাও আর লীলা মজুমদারকে খুঁজে পাওয়া যায় না। ১৯৬৭ থেকে ১৯৭২, চারু মজুমদারের মৃত্যু এবং তার পরের বছরগুলিতেও লীলার মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব শুধু নিজের পরিবারের দেখাশোনা করা, সন্তানদের মানুষ করার মধ্যেই নিজেকে যুক্ত রেখেছিলেন, পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি কি ছিল তা কোনদিন কারো কাছে প্রকাশ করেননি। তবে তিনি সিপিআইএম পার্টি থেকে কোনদিন ইস্তফা দেননি, এমনকি চারু মজুমদারকে পার্টি থেকে বহিষ্কৃত করার পরেও নয়। তবে তিনি যেমন পদত্যাগ করেননি, আবার পার্টির সদস্যপদ পুনর্নবীকরণ ও করেননি।

লীলা মজুমদার যখন চারু মজুমদারকে বিবাহ করেন তখন তিনি একজন সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী হওয়া সত্ত্বেও সাংসারিক দায়দায়িত্ব সুষ্ঠু ভাবে সম্পন্ন করে গেছেন। বিবাহের পর চারুর বৃদ্ধ রক্ষনশীল পিতা, অবিবাহিতা বোনকে নিয়ে শুরু হয়েছিল তাঁর নতুন জীবন। ভোরবেলা উঠে পরিবারের সবার জন্য রান্না করা, ধান সেদ্ধ করা, পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয় স্বজন, এমনকি কমরেডদের প্রতি খেয়াল রাখা - সমস্ত কাজ তিনি একা হাতে সামলাতেন। তাঁর বাড়ির দরজা ছিল সবার জন্য উন্মুক্ত, প্রত্যেকের প্রতি তাঁর আতিথেয়তা ছিল প্রশংসনীয়। ১৯৫৪, ১৯৫৬, ১৯৬০ সালে তিনটি সন্তান জন্মগ্রহণ করে, তা সত্ত্বেও গোটা পঞ্চাশের দশক জুড়ে তিনি পার্টির দার্জিলিং জেলা কমিটির গুরুত্বপূর্ণ নেত্রী ছিলেন।তাঁর রাজনৈতিক চিন্তা ছিল স্বতন্ত্র স্বাধীন। চারু মজুমদারের সাথে হয়তো তিনি সহমত ছিলেন না। কারণ তিনি কোনদিন পার্টির সদস্যপদ ত্যাগ করেননি। আবার হরেকৃষ্ণ কোঙার যখন শিলিগুড়ি গিয়ে নকশাল বাড়ি আন্দোলন, চারু মজুমদারের নিন্দা করতে শুরু করেন, তিনি দ্রুত সেই স্থান ত্যাগ করেছিলেন। তিনি চিন্তার স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিলেন। ৩১ বছর বয়সে লীলা মজুমদার বিয়ে করেন, পাড়ার মেয়ে বউরা বউ দেখে অবাক। বিয়ের পর বাড়িতে প্রবেশ করেই তিনি জামাকাপড় পালটে ঘর ঝাঁট দিতে শুরু করেন। ১৮ বছর বয়স থেকেই তিনি পাড়ওয়ালা সাদা শাড়ি পরতেন। বিয়ের পর তাঁর শ্বশুরমশাই তাঁকে রঙিন সিল্কের শাড়ি উপহার দিলে তিনি বলেন, বাবা শাড়িটা খুবই সুন্দর, কিন্তু আমি সাদা শাড়ি ছাড়া অন্য কিছু পরি না। শ্বশুরমশাইও আপত্তি করেননি, পরের দিন লীলা ওই শাড়ি ফেরত দিয়ে নিজের পছন্দমতো শাড়ি কিনে নিয়ে আসেন। বিয়ের পরদিন তিনি রান্না করে তৈরি হয়ে শ্বশুরমশাইকে বলেন, বাবা আমি পার্টির কাজে বেরোচ্ছি, তাঁর শ্বশুরমশাইও কোন আপত্তি করেননি। আবার যখন চারু মজুমদার জেলে, লীলা মজুমদারের কোলে আড়াই বছরের শিশু সন্তান, তখন নিজের হাতে অসুস্থ শ্বশুরের বেডপ্যান পরিষ্কার করে, বিছানা কেচে তিনি রান্না ঘরে ঢুকতেন। তাঁর সেবা শুশ্রূষায় সেরিব্রাল অ্যাটাকের পর শরীরের এক দিক প্যারালাইজড হয়ে যাওয়া সেই বৃদ্ধ আবার উঠে দাঁড়াতে পেরেছিলেন।

১৯৬৭ সালের পর যে নতুন রাজনৈতিক আদর্শের জন্ম হয়েছিল তার কেন্দ্রে ছিলেন লীলা মজুমদারের স্বামী, তাঁদের বাড়ি হয়ে উঠেছিল রাজনৈতিক কার্যকলাপের কেন্দ্র, ঠিক এই সময় থেকেই লীলা মজুমদার ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করেন। যেখানে তাঁর স্বামী রাষ্ট্রের সাথে সরাসরি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছেন সেখানে তিনি সম্পূর্ণ আড়ালে থেকে আপনজনদের সুরক্ষা নিশ্চিত করছেন, শিলিগুড়িতে একজন সাধারণ বিমাকর্মী হিসেবে কাজ করে পরিবারের দেখাশোনা করছেন। তাঁর স্বামী তাঁকে পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি দিয়ে সম্পত্তি রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্ব দিলেও তিনি ছিলেন ব্যক্তিগত মালিকানার বিরোধী। তাই হাতে থাকা জমির সবটাই কৃষকদের নামে লিখে দিয়েছিলেন। শ্বশুর, তিন ছেলে মেয়ে, ননদ, নন্দাই, তাঁদের দুই সন্তান নিয়ে গঠিত বৃহৎ পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ছিলেন বিমা সংস্থার এজেন্ট লীলা মজুমদার। কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হয়েও শেষ পর্যন্ত তিনি 'চারু মজুমদারের স্ত্রী' হিসেবেই পরিচিত হয়েছেন। রাষ্ট্রীয় দমনের মুখে অবিচল দাঁড়িয়ে প্রয়াত স্বামীর প্রতি আস্থা, বিশ্বাসের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি তাঁর LIC'র লেটার প্যাডে লিখে রেখেছিলেন C/O Late Shri Charu Mazumdar।

সূত্র - মৌসুমী ভৌমিক সম্পাদিত লীলাদি, এক অন্য রাজনৈতিক যাপন।

(www.theoffnews.com - Lila Majumdar Charu Mazumder)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours