তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:

পৃথিবীর বহু মানুষ বিবর্তনবাদের তত্বকে অস্বীকার করে। আজও বিশ্বের অনেক সমীক্ষায় জানা গেছে এর কারণ হলো বর্ণবৈষম্য বাদ,জাতপাত ও অন্ধ ধর্মবিশ্বাস। বেশিরভাগ মানুষ মনে করেন ঈশ্বর সৃষ্টি করেছেন মানুষ এমনকি গোটা জীবজগৎ। বরং উল্টোটাই সত্যি, ঈশ্বর তথা দেব ও দেবীর রূপ কল্পনা মানুষের হাতে সৃষ্ঠি হয়েছে।

প্রথমে সৃষ্টি উদ্ভিদের তারপর প্রাণীর। পৃথিবীতে জীব সৃষ্টির পর দু'টি ধারায় জীবজগৎ বিভক্ত হয়ে গেল -একটি উদ্ভিদজগৎ আর একটি প্রাণীজগৎ। উদ্ভিদজগৎ আর প্রাণীজগৎ মিলে জীবজগৎ। মানুষ এসেছে সবার শেষে। মানুষের আগমণ মাত্র ত্রিশ লক্ষ বছর আগে। মানুষও একেবারে পৃথিবীতে আসেনি। এককোষী প্রাণীর থেকে যে রূপান্তর সৃষ্টি হয়েছিল, তারই শেষ পরিণতি মানুষ। সৃষ্টির এই যে তত্ত্ব, বিজ্ঞানের ভাষায় একেই বলে বিবর্তনবাদ।

তবে আর একটা ভিন্ন মত আছে, সেটাও জানা দরকার। আধুনিক spiritualist সদগুরু বিবর্তনবাদকে অস্বীকার করেননি। এদের অনেকেই ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কি সেটা? উনিশ শতকে বিবর্তন তত্ত্ব ব্যাখ্যা করেছিলেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন। কিন্তু তার বহু আগেই হিন্দু শাস্ত্রে  উল্লিখিত দশাবতারে প্রাণিজগতের বিবর্তন বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল বলে দাবি করলেন অন্ধ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জি নাগেশ্বর রাও। 

পঞ্জাবের জালন্ধরে লাভলি প্রফেশনাল ইউনিভার্সিটিতে বসেছে এবারের বিজ্ঞান কংগ্রেস। গত কয়েক বছরের মতো এবারও বিতর্কিত মন্তব্যের ধারা অব্যাহত রইল সেখানে। এ দিন নিজের দাবির সপক্ষে রাওয়ের ব্যাখ্যা, ডারউইনের তত্ত্বে বলা হয়েছে, কী ভাবে মানুষের বিবর্তন ঘটেছে। কিন্তু দশাবতারে ধাপে ধাপে বোঝানো হয়েছে বিবর্তন। কী রকম? রাও বলেন, ‘‘দশাবতার শুরু হচ্ছে ‘মৎস্য অবতার’ দিয়ে, জলজ প্রাণী। তার পর ‘কূর্ম অবতার’, অর্থাৎ কি না উভচর। যে জলেও বাঁচে, ডাঙাতেও। চতুর্থ অবতার ‘নরসিংহ’। অর্ধেক মানুষ ও অর্ধেক সিংহ। পঞ্চম অবতার ‘বামন’। আকারে ছোট মানুষ।’’ বলতে থাকেন রাও, ‘‘...শেষে এলেন রাম। এক জন সম্পূর্ণ মানুষ। তার পর কৃষ্ণ। আরও জ্ঞানী, বিচারক্ষমতা, কূটনৈতিক বুদ্ধিসম্পন্ন।’’ বলতে বাধ্য হচ্ছি গৌরিক পন্থীরা বলছেন যা কিছু আধুনিক আবিষ্কার সবই নাকি ভারতবর্ষে আগে হয়েছে। তাই বিবর্তন মতবাদ পাঠক্রম থেকে তুলে দেওয়া উচিৎ, এটা বললেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সত্যপাল। আরও বললেন এই সব তত্ত্ব ভুল একেবারে। এ কোন দেশে বাস করছি আমরা? এই মতবাদকে এক কথায় নস্যাৎ করলেন মন্ত্রী সত্যপাল। এই বিতর্কের একটি সমাধান সেটা হলো শিক্ষা, অন্ধ কুসংস্কার থেকে বেরিয়ে আসা একটু গভীরে যাওয়া যাক।

বিবর্তন শুধুই একটি থিওরি (scientific theory) বা তত্ত্ব নয়। এটি পর্যবেক্ষণযোগ্য প্রাকৃতিক ঘটনা। বিবর্তন প্রকৃতপক্ষে একটি বৈজ্ঞানিক বাস্তবতা (scientific fact)। আর যে সুপ্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব দিয়ে এই বিবর্তন নামের ফ্যাক্টটিকে ব্যাখ্যা করা হয় তাকে বলে বিবর্তন তত্ত্ব। অর্থাৎ একটি দৃশ্যমান প্রাকৃতিক ঘটনা হিসেবে বিবর্তন কিভাবে ঘটে, তার ব্যাখ্যা দেয় বিবর্তন তত্ত্ব। বিবর্তন তত্ত্বকে (theory of evolution) প্রায়ই সংক্ষেপে শুধু ‘বিবর্তন’ দ্বারা নির্দেশ করা হয়।

বিবর্তন বলতে জীবজগতের উন্নতি বোঝায় না; বিবর্তন হচ্ছে পরিবর্তন, সাধারণ পরিবর্তন নয়, ডারউইনের ভাষ্যমতে এটি “পরিবর্তন সংবলিত উদ্ভব” (descent with modification)। এই পরিবর্তন ইতিবাচক, নেতিবাচক কিংবা নিরপেক্ষ হতে পারে। এটি নির্ভর করে পারিপার্শ্বিক অবস্থা বা পরিবেশের উপর। বিবর্তনের কোন সুনির্দিষ্ট্য লক্ষ্য নেই। ‘বিপরীতমুখীন’ কিংবা ‘পশ্চাৎ বিবর্তন’ (backward evolution or de-evolution) বলেও কোন জিনিস নেই; একইভাবে নেই ‘সম্মুখ বিবর্তন’-এর মত কোন জিনিসও। অর্থাৎ বিবর্তন কোন নির্দিষ্ট দিকে চালিত হয় না। এমনকি প্রাকৃতিক নির্বাচনও সবসময় জীবজগতকে উন্নত করে না। কেন না কোন একটা পরিবেশের সাপেক্ষে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে একটা জীবগোষ্ঠী ওই পরিবেশের সাথে অভিযোজিত হয় ঠিকই, কিন্তু ভিন্ন পরিবেশে সেই অভিযোজিত বৈশিষ্ট্যগুলোই আবার ওই জীবগোষ্ঠীর অসুবিধার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

বিবর্তন কোন তাৎক্ষণিক প্রক্রিয়া নয়। বিবর্তন নিরবচ্ছিন্নভাবে চলমান প্রক্রিয়া। এটি একটি অত্যন্ত ধীর প্রক্রিয়া। একটি দৃশ্যমান বা চোখে পড়ার মত বড় ধরনের পরিবর্তনের জন্য সাধারণত লক্ষ লক্ষ বছর লেগে যায়। একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সাধিত হওয়ার জন্য একটি জীবগোষ্ঠীকে হাজার হাজার অন্তর্বতী অবস্থা (transitional forms) পার করতে হয়।

সর্বোপরি, বিবর্তন সরাসরিভাবে একটি পর্যবেক্ষণ লব্ধ ঘটনা। যদিও বিবর্তনের ফলে জীবের অভিযোজন ঘটে, তবুও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিবর্তন সুনির্দিষ্টভাবে উপকারী হয় না। বিবর্তনের ফলে জীবজগতের নাটকীয় পরিবর্তন সাধিত হয় সত্যি, কিন্তু একটা ক্ষুদ্র কালখণ্ডের সাপেক্ষে এই পরিবর্তন খুবই ধর্তব্য নয়।

বিবর্তনের স্বপক্ষে প্রামাণ্য তথ্য-বিশ্লেষণ বিবর্তনের পক্ষে সাক্ষ্য প্রমাণ অফুরন্ত বলে মনে করা হয়। বিবর্তন বা জৈব অভিব্যক্তির পক্ষে যে সমস্ত সাক্ষ্য হাজির করা যায় তা হলো: প্রাণ রাসায়নিক প্রমাণ, কোষবিদ্যা বিষয়ক প্রমাণ, শরীরবৃত্তীয় প্রমাণ, জীবাশ্ম বা ফসিলের প্রমাণ, সংযোগকারী জীবের (connecting link) প্রমাণ, ভৌগোলিক বিস্তারের (Geographical distribution) প্রমাণ, তুলনামূলক অঙ্গসংস্থানের প্রমাণ, শ্রেণিকরণ সংক্রান্ত প্রমাণ, নিষ্ক্রিয় বা বিলুপ্তপ্রায় অঙ্গের প্রমাণ ইত্যাদি। এছাড়া তবে ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে বিবর্তনের সপক্ষে সবচেয়ে জোরালো এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ পাওয়া গেছে ‘আণবিক জীববিদ্যা’ (molecular biology) এবং সাইটোজেনেটিক্স (cytogenetics) থেকে। আধুনিক জীববিজ্ঞান, প্রত্নতত্ত্ববিজ্ঞান, জেনেটিক্স, জিনোমিক্স এবং আণবিক জীববিদ্যার সকল শাখাতেই বিবর্তনের পক্ষে জোরালো প্রমাণ পাওয়া গেছে। গুটিকয় প্রধান সাক্ষ্য উল্লেখ করা যেতে পারে-

সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে এক প্রজাতি থেকে অন্য প্রজাতি উদ্ভূত হলে প্রজাতিগুলোর মধ্যে একটা সম্পর্ক থাকবে, এ সমস্ত কিছুকে জাতিজনি বৃক্ষ (Phylogenetic tree) আকারে সাজানো যাবে। সেটাই দৃশ্যমান জীবজগত রেপ্লিকেশন, হেরিটাবিলিটি, ক্যাটালাইসিস এবং মেটাবলিজম নামক সার্বজনীন মৌলিক প্রক্রিয়ার অধীন, যা জীবন প্রক্রিয়ার এক অভিন্ন উৎসের দিকে অঙ্গুলি-নির্দেশ করে। বিবর্তন তত্ত্ব থেকে যে সমস্ত সিদ্ধান্ত টানা হয় তা প্রত্নতত্ত্ব, জৈব রসায়ন, আণবিক জীববিদ্যা, কোষ বংশবিদ্যা কিংবা জেনেটিক ট্রেইটের থেকে পাওয়া বিভিন্ন সিদ্ধান্তের সাথে মিলে যায়। প্রাণীর ফসিলগুলো এই জাতিজনি বৃক্ষের ঠিক ঠিক জায়গায় খাপ খেয়ে যাচ্ছে। ট্রাঞ্জিশনাল ফসিল বা ‘মিসিং লিঙ্ক’ খুঁজে পাওয়া গিয়েছে বহু। বহু প্রাণীর মধ্যে অসম্পূর্ণ ডানা, চোখ কিংবা অ্যাপেন্ডিক্সের মত নিষ্ক্রিয় অঙ্গাদির অস্তিত্ব রয়েছে।

তিমির পেছনের পা, ডলফিনের পেছনের ফিন, ঘোড়ার অতিরিক্ত আঙ্গুল বিশিষ্ট পা কিংবা লেজ বিশিষ্ট মানব শিশু প্রকৃতিতে মাঝে মধ্যেই জন্ম নিতে দেখা যায়। এটা বিবর্তনের কারণেই ঘটে। কারণ কোন অঙ্গ লুপ্ত হয়ে গেলেও জনপুঞ্জের জীনে ফেনোটাইপ বৈশিষ্ট্য হিসেবে ডিএনএ সেই তথ্য সংরক্ষণ করে। তার পুনঃপ্রকাশ ঘটতে পারে বিরল কিছু ক্ষেত্রে। ব্যাপারটিকে বিবর্তনের পরিভাষায় আতাভিজম বলে। কোলাকান্থ, প্লাটিপাস, রাজকাঁকড়া, অ্যালিগেটর, অপোসাম এবং লাংফিশের মতো জীবন্ত ফসিল বিজ্ঞানীরা খুঁজে পেয়েছেন।

জীবজগতে প্রজাতির বিন্যাস বিবর্তনের ইতিহাসের ক্রমধারার সাথে সঙ্গতি বিধান করে। বিচ্ছিন্ন অন্তরিত দ্বীপে এমন সমস্ত বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন প্রাণী পাওয়া যাচ্ছে যা মূল ভূখণ্ডে অনুপস্থিত, যা বিবর্তনের প্রক্রিয়ার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বিবর্তন তত্ত্ব অনুয়াযী পূর্ব বিকশিত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থেকেই নতুন অঙ্গের কাঠামো তৈরির ক্ষেত্র তৈরি হয়। বিভিন্ন মেরুদণ্ডী প্রাণীর সামনের হাত বা অগ্রপদের মধ্যে তাই লক্ষ্যনীয় মিল দেখা যায়। ব্যাঙ, কুমীর, পাখি, বাদুর, ঘোড়া, গরু, তিমি মাছ এবং মানুষের অগ্রপদের অস্থির গঠন প্রায় একই রকম।

একই ব্যাপার খাটে আণবিক স্তরেও। তাই ফ্রুটফ্লাই আর মানুষের মধ্যে বাহ্যিক পার্থক্য যতই থাকুক না কেন, এরা শতকরা সত্তরভাগেরও বেশি ‘কমন জিন‘ শেয়ার করে। আর যে পূর্বপূরুষের সাথে কাছাকাছি সময়ে কোন প্রজাতি বিচ্ছিন্ন হয়েছে, তাদের জিনগত নৈকট্যও তত বেশি থাকে। সেজন্যই মানুষের সাথে ওরাং ওটাং -এর ডিএনএ অণুর বেইস জোড়ের মধ্যে পার্থক্য মাত্র ২.৪%, গরিলার সাথে ১.৪%, আর শিম্পাঞ্জীর সাথে মাত্র ১.২%। বিবর্তন তত্ত্ব সঠিক না হলে এই ব্যাপারটি কখনোই ঘটতো না।

স্বতন্ত্র ভাবে কিংবা সমান্তরাল পথে ঘটা বিবর্তনও পরীক্ষিত। যেমন, পাখি, বাদুর কিংবা পতঙ্গের পাখা উড়তে সহায়তা করলেও এদের গঠন এবং উদ্ভব ভিন্নভাবে হয়েছে। লেন্সকির পরীক্ষা সহ বহু পরীক্ষায় প্রজাতি গঠনের বিভিন্ন উদাহরণ পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয়েছে। আধুনিক বিজ্ঞানের কোন শাখা থেকে পাওয়া তথ্য বিবর্তনের বিপক্ষে যাচ্ছে না। বিতর্ক করুন কিন্তু যুক্তির জালে, বিজ্ঞানের আলোয় তর্ক করুন।

কোনো ধর্মীয় মোড়কে প্রাকৃতিক ঘটনাকে ব্যাখ্যা করা শুধু একপেশে ও ভ্রান্ত নয়, এটা মানবতা ও প্রগতি বিরোধী।

(www.theoffnews.com - servival evolution)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours