সুজাতা দাস, লেখিকা ও সমাজকর্মী, কলকাতা:

একটা সময় স্বপ্নেরাও স্বপ্ন দেখা ছেড়ে দেয়, শুধু থেকে যায় স্বপ্নের ফসিল। যা খুঁড়ে খুঁড়ে বার করতে হয় মনজমিনের গভীর থেকে। তারপর চলে পাওয়া না পাওয়ার হিসেব নিকেশ, যা শুধু যন্ত্রণাতে ভরা এক অদ্ভুত অনুভব।

জীবনের শেষ সময়ে আট বাই আটের এই ঘরটা আর কোনও স্বপ্ন বুনতে সাহায্য করে না, যা করায় তা হলো প্রতিক্ষা। যা মৃত্যু বা মুক্তির, এই স্বপ্ন বোনা জীবনটা থেকে! আর মনজমিন খুঁড়ে যে ফসিলটা বার করে আনা হয় অনেক সযত্নে, তার সাথেই চলে সুখ আর দুখের কথকতা।

তারপর টেনে নিয়ে চলা আট বাই আটের জীবনটাকে এক অনাহূত অতিথির মতো, নিঃসঙ্গ একাকি বিনা স্বপ্নে ধুকে ধুকে চলা, যেখানে না স্বপ্ন দেখা চলে, না ভাবনার ব্যাখ্যা চলে। যা চলে তা হলো ফেলে আসা জীবনের ভুলগুলো ঠিক করার অমোঘ প্রচেষ্টা।

তবে সেটা চেষ্টাই থাকে কারণ ভুল শোধরাতে যাকে দরকার সে তখন বাবা মায়ের উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে হয় টেক্সাস নয় সুইডেনে বা ইংল্যান্ডের কোনও শহরে ঠান্ডা ঘরের উষ্ণ আলিঙ্গনে বদ্ধ হয়ে গেছে। তার ফিরে তাকানোর মতো সময় আর হয় না ফেলে আসা সেই ছোট্ট বাড়িটার দিকে, যেখানে তার স্বপ্ন পূরণের জন্য নিজেদের স্বপ্ন বিসর্জন দিয়েছিলেন কেউ কেউ আনাবিল আকাঙ্খায়। আজ তাদেরই একজন সব হারিয়ে আট বাই আটের বাসিন্দা।

জীবনে যা স্বপ্ন বুনতে থাকি আমরা নিজের মনে, তার কিয়দংশ পূরণ হয় মাত্র! বাকিটা চাপা পড়ে সংসার সমাজ আর সন্তান মানুষ করতে করতে তবুও হাসি মুখে মেনে নিই পুরোটাই আমরা মানে বাবা মায়েরা। কিন্তু দিন শেষে সব শূন্য একসাথে জড়ো হয় নিজের জন্য, তবে অন্তর্বর্তী স্রোতস্বিনী জানান দেয় মাঝে মাঝেই এই না পাওয়ার বেদনা যা ঝরে পড়ে বেদনার স্রোতধারা নিয়ে।

তবু আমরা বাবা মায়েরা হাসি, হাসি এই আনন্দে যে একটা সময় সেই দিন আসবে আর সেখানেই আমি বা আমরা বাবা মায়েরা বিজয়ী। কিন্তু এই ভুল ভাঙতে বেশি সময় লাগে না কারণ ততক্ষণে বিলাসিতার চাদরে মুড়ে নিয়ে নিজেকে আলাদা করে ফ্যালে সেই সন্তান, যাদের মানুষের মতো মানুষ করতে বাবা মা বাজি রেখেছিলেন নিজের জীবন যৌবন।

ভুলে যায়, ভুলে যায় সেই সন্তান, নিজেদের অর্জিত সমস্ত বিত্ত খরচ করে একদিন মানুষ করে ছিলেন এই সন্তানকে ওই আট বাই আটের মানুষটি অনেক আশায় আর কষ্টে। আজ তাদের স্থান এই আট বাই আটের ছোট্ট কঠুরিতে নিঃসঙ্গ নির্বাসন---

যার নাম 'বৃদ্ধাশ্রম'।

(www.theoffnews.com - oldage home)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours