তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:

এটি একটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন বা আলোচনা। সবাই বলে প্রায় ওই মানুষটি খুব আত্মকেন্দ্রিক মানে খুব স্বার্থপর, এটাই বোঝাতে চায়। আত্মকেন্দ্রিকতার আসল মানেটা কি? আসুন একটু গভীরে ঢোকা যাক।

বেশিরভাগ মানুষের ধারণা আত্মকেন্দ্রিকতা মানে স্বার্থপরতা। একটু ইতিহাসের তাকানো যাক। এই শব্দটির অর্থ ঐতিহাসিক ভাবে চালু হয়েছে বুদ্ধের কিছু আগে বা বুদ্ধের সময় থেকে। নিজেকে চেনো, তোমার মধ্যেই আছে চেতনার এক উন্নত স্তর, যা তুমি ছুঁতে পারো না, যা তোমার সৃষ্টির মূলে, কেউ কেউ একে পরমআত্মা বলেন।

তোমার চেতনার গভীরে এক অশারীরিক বা নিরাকার এবং একই সাথে আকারযুক্ত এক বোধ কাজ করে তোমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। চেতনার কেন্দ্রে থাকা এই বোধকে অনুভব করাই হলো মুক্তি। শরীরের উর্ধে উঠা। আত্মকেন্দ্রিকতা হলো discover Your self in every moment। যাঁরা খালি পরের অনিষ্ঠ ও সামাজিক সম্পর্ক সমন্ধে উদাসীন ও নির্মম থাকে সেই হলো স্বার্থপর, ক্ষমতালোভী। যে মানুষ নিজেকে চেনে বা চেনার চেষ্টায় থাকে আত্ম নিন্দুক হন, সেই অন্যকে বোঝার ক্ষমতা রাখে। মনে রাখবেন একাকীত্ব হলো নিজের সাথে কথা বলা, যা সৃষ্টির বা creativity'র মূল শর্ত।

নিঃস্বার্থ কথাটার কোনও মানে হয় না, সবই স্বার্থযুক্ত এবং প্রয়োজন ভিত্তিক। বুদ্ধের মৃত্যুর হওয়ার পর থেকে বুদ্ধের তৈরি সংঘ গুলির ভাঙন শুরু হয়, ক্ষমতার লড়াই, দুর্নীতি আসতে শুরু করে আর ওই সময়ে ইসলাম ভারতে প্রবেশ করে। গোড়া হিন্দুরা ক্ষমতার স্বার্থে  এই শব্দটির ভিন্ন অর্থ তৈরি করে। ব্রাহ্মণরা প্রচার শুরু করে আমরাই শ্রেষ্ঠ, সবই হয় জাত ও ধর্মের স্বার্থে।

ধ্যানের বিরুদ্ধে ক্ষমতার পক্ষে। ফলে আত্মকেন্দ্রিক এই ধারণার অর্থ নেতিবাচক হয়ে যায়। অন্যের বিপদের ছুটে যাওয়া, সহযোগিতার হাত বাড়ানো, বা অন্যকে শান্ত করার সাথে আত্মকেন্দ্রিকতার কোনও বিরোধ নেই, বরং সম্পর্ক আছে যা এক অন্যের পরিপূরক।

আত্মকেন্দ্রিকতা ও স্বার্থপরতা এক মানে নয়। দুটি বিপরীত ধর্মের কথা বোঝায়। আত্মকেন্দ্রিক হন কিন্ত স্বার্থপর নয়। আসুন এইবার একটু স্বার্থপরতা প্রসঙ্গে আলোকপাত করি। আমি এক দিন বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যুবক বয়সে, সবাই স্বার্থের কারণে বা প্রয়োজনে আমার কাছে আসে। আমার বাবা প্রায় ফুটপাত থেকে লড়াই করা এক বর্ণময়  মানুষ। জীবনকে উপলব্ধি করেছে জীবনের প্রতিটি সংঘর্ষ থেকে, তৈরি হয়েছে এক জীবন বোধ। বাবা উত্তর দিলেন, প্রয়োজন বা স্বার্থ ছাড়া মানুষ তোমার কাছে কেন আসবে? আমাদের সমাজ ও বিজ্ঞান গড়ে উঠেছে প্রয়োজনের তাগিদেই বা স্বার্থের তাগিদে। প্রয়োজন বা স্বার্থ আর্থিক হতে পারে, মানসিক হতে পারে, শারীরিক হতে পারে, অজস্র কারণ আছে। এটাই স্বাভাবিক আর উল্টোটা বোঝা বা করা হলো প্রকৃতির বিরুদ্ধে যাওয়া। পরে যখন বুদ্ধকে বুঝতে শুরু করলাম, দেখলাম উনিও একই কথা অন্য ভাষায় বলেছেন।

আসলে স্বার্থপর শব্দটির গভীরে ঢুকলে অনুভব করবেন এটার কোনও মানেই নেই। খুব গোলমেলে এবং অস্পষ্ট বা অসম্পূর্ণ শব্দ। এই ভাবে দেখতে গেলে পৃথিবীর সব মানুষ স্বার্থপর। যে আত্মকেন্দ্রিক মানুষ অন্যের কথা গুরুত্ব দিয়ে শোনে, সন্মান প্রদর্শন করে, অন্যের ক্ষুদ্র ইচ্ছাকে শুধু দমন করে না, পথ প্রদর্শকের কাজ করে নিজের অভিজ্ঞতা বলে, চাপিয়ে দেয় না, রাস্তা খুঁজে নিতে বলে, সমাধান দেয় না। এই আত্মজ্ঞানী মনে করে যখন আমি কিছুই জানতে পারেনি এখনও মূর্খ সেই আত্মকেন্দ্রিক মানুষ হলো আত্মজ্ঞানী। অর্থাৎ আত্মজ্ঞানী মানুষ হতে গেলে আত্মকেন্দ্রিকতা হলো মূল শর্ত। আমার দল বা আমি বা আমার পরিবারের পক্ষে বললে আপনি ভালো এবং উদার আর আমার বিরুদ্ধে বললে আপনি স্বার্থপর, সংকীর্ণ, এই বোধ আত্মকেন্দ্রিকতা বিরোধী এবং ক্ষতিকর যা আমাদের ক্ষুদ্র গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখে।  যে নিজের শ্বাসের সাথে সচেতন ভাবে একাত্ব হতে পারে, সেই পারে অন্যের শ্বাসের সাথে নিজেকে যুক্ত করতে। আমিত্ব থেকে মুক্তি পেতে গেলে গভীরভাবে আত্মকেন্দ্রিক হতে হবে। আগে নিজের দিকে আঙ্গুল তুলুন, পরে পরের দিকে।

তাই আত্ম অনুসন্ধান শেষ বিচারে হল একটি গভীর সাধন প্রক্রিয়া, যা অনন্ত। অনন্ত জাগে লিখলেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি সঠিক ভাবে উপলব্ধি করেছেন

আছে দুঃখ আছে মৃত্যু বিরহ-দহন লাগে

তবুও শান্তি তবু আনন্দ তবু অনন্ত জাগে।

যা অনন্ত তাই শান্ত। তাই অনন্ত ও প্রকৃতির নিয়মের পক্ষে থাকুন। আত্মকেন্দ্রিক মন বা বোধ থেকে যে উচ্চস্তরের চেতনার জন্ম হয় তা নিরাকার। তাই রবীন্দ্রনাথ সঠিক ভাবে বলেছেন... "আমি মুক্তি খুঁজি, সত্য খুঁজি রূপ থেকে অরূপে যাওয়ার পথে," যা আত্মকেন্দ্রিক পথ থেকেই পাওয়া সম্ভব। আত্মকেন্দ্রিক পথ থেকেই আসে অহিংসা ও সাম্য। মনে রাখবেন আপনার শত্রু বাইরে থাকতে পারে কিন্তু গভীরে গেলে বুঝবেন আপনার শত্রু আসলে আপনি নিজে।

আপনি বাহ্যিক ভাবে মুক্ত হতে পারেন অনেক কিছু থেকে কিন্তু আসলে লোভ, লালসা ও সব কিছু জন্য আপনিও বন্দি একটি সংকীর্ণ খাঁচার মধ্যে, মুক্ত নন। রবীন্দ্রনাথ বলছেন আলেকজান্ডার পৃথিবী জয় করেননি। পৃথিবী জয় করেছেন আত্মজ্ঞানী গৌতম বুদ্ধ। তাই আত্মকেন্দ্রিক হন আবার একই সাথে হাত বাড়িয়ে দিন, শুধু অন্যকে সাহায্য করার জন্য নয় নিজেকেও চেনার জন্য, আমি আসলে কে? নিজেকে আবিষ্কার করুন। আত্মমগ্নতা হারিয়ে যেতে চলেছে তাই এত বিপর্যয় মানুষের সৃষ্টির সব ক্ষেত্রে।

যাই হোক বুদ্ধের কথায় শেষ করি এই আলোচনা। “No one saves us but ourselves. No one can and no one may. We ourselves must walk the path.” “It is better to conquer yourself than to win a thousand battles." আধ্যাত্মিক সাধনা কখনওই রূপের সাধনা হইতে পারে না। তাহা সমস্ত রূপের ভিতর দিয়া চঞ্চল রূপের বন্ধন অতিক্রম করিয়া পরম সত্যের দিকে চলিতে চেষ্টা করে। সীমা থেকে অসীমের দিকে যাত্রা। খন্ড সত্তা থেকে অখন্ডকে বোঝা।

তিনি রূপ থেকেই অরূপের দিকে ছুটে চলেছেন। ইন্দ্রিয় গোচর যে কোনও বস্তু আপনাকেই চরম বলিয়া স্বতন্ত্র বলিয়া ভান করিতেছে, সাধক তাহার সেই ভানের আবরণ ভেদ করিয়া পরম পদার্থকে দেখিতে চায়।’ (রূপ ও অরূপ, রবীন্দ্রনাথ)

অরূপ, তোমার বাণী

অঙ্গে আমার চিত্তে আমার মুক্তি দিক সে আনি॥

নিত্যকালের উৎসব তব বিশ্বের দীপালিকা--

আমি শুধু তারি মাটির প্রদীপ, জ্বালাও তাহার শিখা

নির্বাণহীন আলোকদীপ্ত তোমার ইচ্ছাখানি॥

যেমন তোমার বসন্তবায় গীতলেখা যায় লিখে

বর্ণে বর্ণে পুষ্পে পর্ণে বনে বনে দিকে দিকে

তেমনি আমার প্রাণের কেন্দ্রে নিশ্বাস দাও পুরে,

শূন্য তাহার পূর্ণ করিয়া ধন্য করুক সুরে--

বিঘ্ন তাহার পুণ্য করুক তব দক্ষিণপাণি॥

এটাই তাঁর ছিল আধ্যাত্মিকতার বা আত্মমগ্নতার স্বরূপ।

অরূপ তোমার বাণী

এর থেকে শেষ কথা কি হতে পারে। এই উপলব্ধি  আত্মমগ্ন বা আত্বকেন্দ্রিক সাধনার ফল। এইটাই আমাদের সংস্কৃতি যা তাঁর প্রতিটা লেখায় প্রতিফলিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ও বিবেকানন্দ দেশের ইতিহাসকে বুঝতে ভুল করেননি। কিন্তু আমরা ভুলতে বসেছি সাফল্য ও সভ্যতার সারমর্মকে।

(www.theoffnews.com - self)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours