মল্লিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, ফিচার রাইটার ও লেকচারার আহমেদাবাদ:

“ভাবী, নীচে নেহী চলোগী, হোলিকা হোগী থোড়ী দের বাদ। জলদি আ যাও, তৈয়ার হো কে -- শাড়ী জরুর ঢালনা।“ এক মুখ হাসি নিয়ে বলেছিল  সামনের ফ্ল্যাটে নতুন আসা বউটি। ওর রাজস্থানের উদয়পুরে আদি বাড়ী ,জম্মকর্ম সব আমেদাবাদে। প্রথমদিনই বলেছিল ‘আমরা বৈষ্ণব', শুনেই বুঝেছিলাম মছলি খেকো বাঙ্গালী বাড়ীর ধারকাছ বেশি মাড়াবে না। 

মেয়েটির বয়স ওই তিরিশের কোঠায়, ওদের ছোট সংসার –স্বামী, সিক্সে পড়া মেয়ে আর বাতে পঙ্গু শ্বশুর মশাই। মেয়েটিকে দেখি আর ভাবি, কি খাটান না খাটতে পারে, সকাল থেকে জলখাবার বানানো, রান্না করা ঘরঝাড়ু মোছা, বাচ্ছাকে স্কুল থেকে আনা নেওয়া। এরপরও দুপুরে ছোট বাচ্ছাদের বাড়ীতে টিউশন দেয়, বিকেলে শ্বশুরমশাইকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে নীচে ঘোরাতে নিয়ে যায়। মেয়েটির রং চাপা, মুখশ্রীও সাধারণ, তবু মুখে সবসময় যে হাসিটা লেগে থাকে তাতেই মুখটা যেন উজ্জ্বল আলো আলো লাগে।

প্রথম প্রথম হাসি আর মামুলি দু একটি বাক্য বিনিময়ই হত, হঠাৎ একদিন দেখি এক প্লেট গরম সিঙ্গারা আর এক টুকরো কেক নিয়ে হাজির। লাজুক মুখে জানাল ওরই জন্মদিন, সেই থেকে ভাবটা শুরু হল। 

অত গরমে শাড়ী চাপিয়ে হোলিকা দহন দেখতে যাবার বিশেষ ইচ্ছে হচ্ছিল না তাই মিন মিন করে বলেছিলাম, ”যানা জরুরী কেয়া?’

অবাক হয়ে বলেছিল ”ওমা! জানো না হোলিকার ছাই দিয়ে তো আটটা মুঠি বানানো হবে, সামনেই আমাদের গঙ্গৌর আসছে না!”

“সেটা কি রে?” বোকা বোকা মুখ করে জানতে চেয়েছিলাম। প্রচন্ড উৎসাহ নিয়ে বলতে শুরু করেছিল “আরে গণ মানে ঈশ্বর বা শিব আর গৌরী  হল মা দুর্গা, ওদেরতো বিয়ে হবে গো ওই গঙ্গৌরের দিন। একজন শিব ঠাকুরকে আনবে একজন গৌরীকে, আসলে দোলের পরের দিন গৌরী বাপের বাড়ী আসে পাক্কা আঠেরো দিন পরে বিয়ে করে শ্বশুড়বাড়ী যাবে গো। তবে এর মাঝে চৌথা আছে আটম আছে, সে সময় আমরা ভাই, ভায়ের বউয়ের মঙ্গল কামনায় উপবাস করি, ব্রত পালন করি।“

এবার বলি –“তা গঙ্গৌরের দিন কার জন্য ব্রত রাখা হয়? মানে ঠিক কি কি হয়?”

প্রচন্ড উত্তেজিত হয়ে বলতে শুরু করে, ”হোলিকা দহনের দ্বিতীয় দিন মানে চৈত্র কৃষ্ণ প্রতিপদ থেকে চৈত্র শুক্ল তৃতীয়া অবধি আঠেরো দিন ধরেই উৎসব চলে। যেখানে মন্ডপ হয় সেখানে শিব ঠাকুরের মুর্তি আর তার এক বন্ধুর মুর্তি নিয়ে বরযাত্রীরা আসে। ওদিকে মাটির তৈরি গৌরীমা আর তার প্রিয় সখী আশাবাইকে সাথে নিয়ে আসেন অন্য দল । গৌরী তো শিবের সাথে চলে যাবেন কিন্তু আশাবাই থেকে যাবেন আমাদের সমাজের কারুর ঘরে, ওনার কানে কানেই তো মনষ্কামনা জানাতে হয় গো। আশাবাইকে আর গণেশজীকে উৎসব মিটলে যারা নিজেদের ঘরে নিয়ে যাবে তাদের কিন্তু সারা বছর নিয়ম করে পুজো করতে হবে। এরপর ধরো আমরা কন্যাপক্ষের তো আমরা বরযাত্রীদের আসার পথে নুন জল ছেটাবো, ওদের গ্লাসে করে দুধ দিয়ে স্বাগতম জানাব। ওরা বদমাইশি করে আমাদের নাক, চুল টেনে দেবে। পুরো যেন বাড়ীর মেয়ের বিয়ে হচ্ছে, আগের দিন হলদি হবে।

বিয়ের দিন উপোস থেকে আমরা স্বামীর মঙ্গল কামনা করি, কুমারী মেয়েরা মনের মত বর চায়। জমজমাট বিয়ে হয়, শিব আর গৌরী সাত পাকে বাঁধা পরে, তবে খুব সাবধান থাকতে হয় এই সাত ফেরা নেওয়ার সময় , মাটির ঠাকুর একটু কিছু ভেঙ্গে গেলে ওই আঠেরো দিনের ব্রত পুরো ভেস্তে যাবে। রাতে বিয়ে মিটলে খাওয়া দাওয়া চলে, গঙ্গৌর গীত গাই সবাই মিলে –সব আসলে বিয়ের গান!”

“তারপর কি হবে?” কৌতুহলী আমি জানতে চাই।

একটু দুঃখী দুঃখী মুখ করে বলে, "আ-র কি! পরদিন বিদাই, আগেকার দিনে জলে বিসর্জন হত এখন বনের মধ্যে গাছের নীচে রেখে আসি। এতদিন  ধরে যে অখন্ড দিয়া জ্বলছিল সেটা ভেঙ্গে ফেলে ওই মাটির টুকরো যে যার বাড়ী নিয়ে গিয়ে আনাজের জায়গায় অথবা তিজোরীতে রাখে যাতে আগামী  একবছর ঘরে সুখ সমৃদ্ধি থাকে। বাড়ী ফিরে গমের আটা বাজরার আটা ঘি শক্কর মিশিয়ে মিষ্টি বানাই গো, তোমাকেও দেব।“

“সে তো বুঝলাম! কিন্ত তুমি তো বৈষ্ণব, এত ধুমধাম করে শিবের পুজোও কর, যতদুর জানি এককালে শৈব আর বৈষ্ণবদের মধ্যে হাতাহাতির সম্পর্ক ছিল" আমি আর না বলে পারি না। হাসতে হাসতে বলে, "ছাড়ো তো ভাবী! সব ভগবান এক, যে আমার সংসারে সুখশান্তি দেবে সেই ভগবান! চল চল আপাতত নীচে হোলিকা পুজো সেরে আসি। শোনো  আমি তারক মেহেতা সিরিয়ালে বাঙ্গালিদের বেগুনভাজা আর মিষ্টি দইয়ের গল্প শুনেছি, খাওয়াবে কিন্তু একদিন।“

ও চলে যেতেই ভাবি মায়ের মুখে গল্প শুনেছি ছোটবেলায় এই বাসন্তী পুজোর। নবদ্বীপেও ঠিক এমনই ধুমধাম করে শিব ঠাকুরের বিয়ে হত। পরীক্ষা থাকায় কখনও সেসময় যাওয়া হয়নি--- তবে শুনেছি ওখানে ছেলেরাই কেউ শিব কেউ পার্বতী সাজত। বিয়েতে খাট বিছানা যৌতুক দেওয়া হত, সারারাত বাসর জাগা, গান বাজনা হৈ হুল্লোড় চলত।

স্থান কাল আলাদা হলেও পুজো পার্বণ উৎসবের  মানেটা কিন্তু সর্বত্রই এক – খানিকক্ষণ সব দুঃখ ভুলে আনন্দে মেতে ওঠা।

(ছবি সৌজন্যে প্রতিবেদক স্বয়ং)

(www.theoffnews.com - Gangour festival)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours