পলাশ মুখোপাধ্যায়, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

ঠিক ২২ বছর আগের একটি ঘটনা দিয়ে এই লেখা শুরু করা যাক। আমি তখন দুর্গাপুরে ইটিভির সাংবাদিক। সেই সময় বিদ্যুৎ মন্ত্রী মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায় দুর্গাপুরের বিধায়ক। এ জোনে একটি কোয়ার্টারে দুর্গাপুর গেলে থাকতেন মৃণালদা। মৃণালদার ভাই আমাদের সহকর্মী, টেলিগ্রাফ কাগজের সাংবাদিক উৎপলদাও তখন দুর্গাপুরে পোস্টিং, দাদার বাড়িতেই থাকতেন। উৎপলদার সঙ্গে আমার বেশ খাতির হয়ে যায়, সে কারনে বেশ কয়েকবার মৃণালদার বাড়িতে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু আমার বেশ কিছু খবর পছন্দ না হওয়ায় মৃণালদা জনসমক্ষেই বেশ কিছু কথা শোনান। আমায় কয়েকবার বাইট দিতেও অস্বীকার করেন। উৎপলদার সঙ্গে ভাব থাকলেও মন্ত্রী দাদার এই ব্যবহার আমার মোটেই ভাল লাগেনি। এর পর থেকে মৃণালদাকে সরাসরি এড়িয়ে যেতে শুরু করলাম। আমার তৎকালীন বস আশিসদাকে জানিয়ে মৃণালদার বাইট নেওয়া বন্ধ করে দিলাম। এমনকি কোনও অনুষ্ঠানে মৃণালদা বলতে উঠলেও আমরা তার সামনেই ক্যামেরা বন্ধ করে স্ট্যান্ড সশব্দে গুটিয়ে রেখে দিতাম। অন্যদের সঙ্গে মৃণালদাও খেয়াল করেছিলেন সেটা। একদিন ডিপিএল এর একটা অনুষ্ঠান থেকে ফিরছি, বিদ্যুৎ মন্ত্রী মৃণালদাও সেখানে অবশ্য আমন্ত্রিত। আমরা যথারীতি বিদ্যুৎ মন্ত্রীর কোনও ছবিই তুলিনি। স্কুটারে ফিরছি, রাস্তায় আমাদের আটকে হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল একটি পুলিশ ভ্যান। বিস্মিত হয়ে তাকাতে দেখলাম পিছনেই মৃণালদার গাড়ি, গাড়ি থেকে নেমে আমাদের দিকে আসছেন মৃণালদা। কাছে এসে সস্নেহে জিজ্ঞাসা করলেন কেমন আছি, এরপরেই বললেন দাদা হিসেবে হয় তো রাগের মাথায় দুচার কথা বলেইছেন, ভাইয়ের কি এত অভিমান করা সাজে? কি বলব চুপ করেই থাকলাম। তিনিই বললেন যা হয়েছে ভুলে যাও, কালকে সন্ধেবেলা বাড়িতে এস একটা খবর দেব। এর পরে অবশ্য মৃণালদা আর কখনও খারাপ ব্যবহার করেননি। একই দাওয়াই কাজ করেছিল দুর্গাপুরের তৎকালীন মেয়র রথীন রায়ের ক্ষেত্রেও। তিনিও আমার দেখা অতি নিরস একটি মানুষ, সাংবাদিক দেখলেই বোধহয় তার কিছু একটা অস্বস্তি হত, কোনও মতেই কথা বলতে চাইতেন না। ক্রমাগত খবর করা এবং তাকে বয়কট করাতে খানিকটা শুধরে ছিলেন।  

এবারে আসি এই দীর্ঘ গল্পের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে। সম্প্রতি ধর্ষণ কাণ্ড এবং ধর্ষিতা প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য নিয়ে ঝড় উঠেছে। পাশাপাশি মুখ্যমন্ত্রী সংবাদ মাধ্যম নিয়েও নানা কুকথা, হুমকি এবং নিদান দিয়েছেন। খবরের চ্যানেল না দেখে সিরিয়াল দেখতেও বলেছেন সাধারণ মানুষকে। বিজ্ঞাপন দেওয়া নিয়ে তো আগেই সতর্ক করেছিলেন জেলায় গিয়ে, ইতিবাচক খবর না করলে সরকারী বিজ্ঞাপন মিলবে না বলে জানিয়েছিলেন। এবার আরও এক ধাপ এগিয়ে বেসরকারী সংস্থাগুলিকেও বিজ্ঞাপন দিতে বারণ করেছেন সরকার বিরোধী খবর করলে। প্রশ্ন উঠছে উপরের ঘটনার মত যদি সংবাদ মাধ্যম বয়কট করে তাহলে কি উনি জব্দ হবেন? 

সমস্যাটা এখানেই। আমি যে গল্পটি বলেছি সেটি দুই দশক আগেকার। তখন খবরের কাগজ কিছু থাকলেও বেসরকারি সংবাদ মাধ্যম নেই বললেই চলে। এখনকার মত খবরের চ্যানেল তো নেইই। ছিল না পাড়ায় পাড়ায় মোড়ে মোড়ে গজিয়ে ওঠা এমন স্বঘোষিত সাংবাদিকও। তাই সব চেয়ে জনপ্রিয় একটি টিভি চ্যানেল বয়কট করা মানে তখন অনেক কিছু। তখন সাক্ষাৎকার দিতে পারলে নেতা বা অন্যান্যরা ধন্য হয়ে যেতেন, এখন সাক্ষাৎকার দিতে দিতে বিরক্ত হয়ে যান। বেসরকারি নানা টিভি চ্যানেলের পাশাপাশি এখন অজস্র ওয়েব পোর্টাল। সেগুলির অধিকাংশরই লেখা পড়লেই বোঝা যায় যারা লিখেছেন তাদের শিক্ষাগত মান এবং যোগ্যতা কেমন। কোনও জিনিস বেশি হয়ে গেলে তার মর্যাদা যে থাকে না তা প্রাচীন কাল থেকেই প্রমাণিত। এক্ষেত্রেও তাইই হয়েছে। 

মুখ্যমন্ত্রীর দলেরই এক অতি শিক্ষিত নেত্রী কিছুদিন আগেই সাংবাদিকদের দু পয়সার সাংবাদিক বলে অভিহিত করেছিলেন। কিছু সংবাদ মাধ্যম তাকে বয়কট করবার কথা বললেও অধিকাংশই সে পথে হাঁটেননি বরং তার খবর করে ধন্য হয়েছিলেন এবং হচ্ছেনও। আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম আমার পরিচিত তথাকথিত বড় মিডিয়ার কয়েকজনকে। তাদের অনেকেরই মত, এটা ছোটখাটোদের উদ্দেশ্য করে মহুয়া বলেছেন, আমাদের নয়। ব্যস আমাদেরকে বলেনি, এই নীতিতেই মিডিয়ার লোকেরা সর্বদা সুখে থাকে, দ্বিধা বিভক্ত থাকে। তারই সুযোগ নেয় এই রাজনীতির কারবারিরা। মহুয়া মিত্রকে বয়কট করবার সৎসাহস যদি সব সংবাদ মাধ্যম এক যোগে তখন দেখাতে পারত, তাহলে অন্য কেউ মিডিয়াকে কিছু বলবার আগে সামান্য একটু ভাবতো। কিন্তু যেখানে রাজনীতির পরিচয়ে, রাজনৈতিক নেতা নেত্রীর সঙ্গে খাতির থাকার মাপকাঠিতে চ্যানেলের বস ঠিক করা হয়, সেখানে আপনি আর কি আশা করতে পারেন? সাতদিন যদি মুখ্যমন্ত্রীর কোনও খবর কোনও মিডিয়া না দেখায় তাহলে সাধারণ মানুষ রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী আছেন কিনা সেটাই জানতে পারবেন না। কিন্তু সেটা অলীক কল্পনা। এই তাঁবেদারির সংসারে তা হওয়ার নয়। তাই তো খুশি মত খবর না হলেই মন্দিরের ঘন্টার মত যে পারেন বাজিয়ে দিয়ে যান মিডিয়ার মানুষগুলিকে। শুধু মন্ত্রী সান্ত্রিই নন, একই কথা প্রযোজ্য সাধারণ মানুষের জন্যও।  

মিডিয়াকেও খুব সিরিয়াসলি ভাবতে হবে তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে। এভাবেই কি পুলিশের মত জীবন যাপন করবে, নাকি পুরনো সম্মান পুনরুদ্ধার করে শিরদাঁড়া সোজা করে প্রকৃত অর্থেই চোখে চোখ রেখে কথা বলবে। এখনকার চিৎকার সর্বস্ব টেলি মিডিয়া, ভুলে ভরা ওয়েব পোর্টাল, এবং ধামা ধরা সংবাদপত্র যদি তাদের এমন ধারাবাহিকতা বজায় রাখে তাহলে সাধারণ মানুষের সহানুভূতি এবং ভালবাসা থেকেও বঞ্চিত হবে তারা। না জনতা, না জন নেতা, দিনের শেষে দেখা যাবে সঙ্গে নেই কেউই।

(www.theoffnees.com - media political leaders)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours