কাজী নূর, কবি, সাহিত্যিক ও ফিচার রাইটার, বাংলাদেশ:

আজ ২৪ এপ্রিল, নয় বছর পূর্ণ হলো বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার অদূরে সাভারের রানা প্লাজা ট্রাজেডির। দেশ তথা সারা বিশ্বের পোষাক শিল্পের ইতিহাসে স্মরণকালের অন্যতম শোকাবহ দিন। আজ থেকে নয় বছর আগে ইতিহাসের এই দিনে ভয়াবহ এক ভবন ধ্বসের দুর্ঘটনায় আঁতকে উঠেছিলো সারা বিশ্বের মানুষ। বিশ্বের ইতিহাসে তৃতীয় বৃহত্তম শিল্প দুর্ঘটনা হিসেবে বিবেচিত মানবসৃষ্ট এই ভয়াবহ দুর্যোগে নিমিষেই সাভারের রানা প্লাজা হয়ে উঠেছিলো দুঃখ বেদনার এক শোকগাঁথা অধ্যায়। ২০১৩ সালের এই দিনে ঢাকা আরিচা মহাসড়কের সাভার বাসস্ট্যান্ডের পাশে অবস্থিত রানা প্লাজায় তিনটি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা প্রতিদিনের মতো সকাল ৮টায় হাজির হন কর্মস্থলে। সাড়ে ৯টার দিকে হঠাৎ বিকট শব্দ। ধ্বসে পড়ে নয় তলা রানা প্লাজা ভবন। শুরু হয় আহত শ্রমিকদের চিৎকার আহাজারি। মুহূর্তেই উদ্ধার অভিযানে এগিয়ে আসেন স্থানীয়রা। পরে তাদের সঙ্গে যুক্ত হন রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনী। সেনাবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস, নৌবাহিনী আনসার, র‌্যাব ও পুলিশ সদস্যদের সমন্বয়ে চলে বিরতিহীন উদ্ধার অভিযান। বেদনাব্যঞ্জক সেদিনে রানা প্লাজা ধ্বসে ইট কংক্রিটের নিচে চাপা পড়ে হারিয়ে যায় ১ হাজার ১৩৬ জন শ্রমিকের তরতাজা প্রাণ। আহত হন আরও কয়েক হাজার শ্রমিক। জীবন ফিরে পেলেও খেটে খাওয়া শতশত সাধারণ শ্রমিককে বরণ করতে হয়েছে স্থায়ী পঙ্গুত্ব।

রানা প্লাজা ভবন ধ্বসের হৃদয়বিদারক সে ঘটনায় কেউ হারিয়েছেন তার মাকে, কেউ তার বাবা, কেউ তার ভাই, কেউ বোন, কেউ তার স্ত্রী, কেউ আবার স্বামীকে বা পরিবারের উপার্জনক্ষম একমাত্র মানুষটাকে। তৈরী পোষাক শিল্পখাতে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের ইতিহাসে এটাই সবচেয়ে বড় বিপর্যয়। ভবনটির তৃতীয়তলা থেকে নবম তলা পর্যন্ত ছিল পাঁচটি পোশাক কারখানা। এতে প্রায় ৪ হাজার পোশাক শ্রমিক কাজ করতেন। ভবন ধ্বসের সঙ্গে সঙ্গে ধ্বংসস্তূপের ভেতরে চাপা পড়েন চার হাজার পোশাক শ্রমিক। তাদের কান্না আর আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে বাংলার আকাশ। শোকের ছায়া নেমে আসে গোটা দেশজুড়ে। খবর পেয়ে উদ্ধার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন সাধারণ উদ্ধার কর্মী থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীগুলোর সদস্যরা। 

ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে বের হতে থাকে জীবন্ত মানুষ। কখনও ইলেকট্রিক করাত দিয়ে হাত পা কেটে ফেলে বের করে আনা হয় চাপাপড়া মানুষদের। উদ্ধার হওয়া আহতদের দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার জন্য সাভারের ঢাকা আরিচা মহাসড়ক বন্ধ করে দিয়ে মহাসড়কের দুই পাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে রাখা হয় এ্যাম্বুলেন্স। আহতদের হাসপাতালে পাঠানো, প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া সহ সব ধরনের সহযোগিতার জন্য বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে ছুটে আসে হাজারো স্বেচ্ছাসেবী।

সেদিন টিভির পর্দায় অবর্ণনীয় ঘটনার সরাসরি সম্প্রচার দেখে কেঁদে উঠেছিল গোটা বাংলাদেশ। র্ধ্বংসস্তূপ থেকে একে একে বের হতে থাকে জীবন্ত, মৃত ও অর্ধ-মৃত মানুষ। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মৃত মানুষের সংখ্যা বেড়ে যায়। হাসপাতাল মর্গ ভরে ওঠে লাশে। পরে এসব লাশ নিয়ে যাওয়া হয় সাভারের অধরচন্দ্র স্কুলের মাঠে। স্কুল বারান্দায় সারিবদ্ধভাবে লাশ রেখে দেওয়া হয়। লাশের সংখ্যার হিসাব রাখার জন্য ঝুলানো হয় স্কোরবোর্ড। সারিবদ্ধ ভাবে সাজিয়ে রাখা হয় কফিনের বাক্স। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ধ্বংসস্তূপের ভেতরে চাপা পড়া লোকদের স্বজনেরা ছুটে আসেন রানা প্লাজার সামনে। প্রিয়জনকে জীবিত না পেলেও তার মৃতদেহ নেওয়ার জন্য স্বজনেরা ভিড় জমান অধরচন্দ্র স্কুল মাঠে।

উদ্ধারকাজের কোনও অভিজ্ঞতা ছাড়াই ভয়াবহ সেদিনে জীবনকে তুচ্ছ করে উদ্ধার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো অগণিত সাধারণ জনতা। ভবনের নিচে আটকে পড়া মানুষের জীবন বাঁচানোর তাগিদেই নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা ঢুকে পড়েন ধ্বংসস্তূপের ভেতরে। পঁচা লাশের গন্ধ উপেক্ষা করে তারা সন্ধান করেন জীবিত প্রাণের। সেই মানুষগুলোর কারণেই ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে ২৪৩৮ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। এছাড়া, মৃতদেহ উদ্ধার করা হয় ১ হাজার ১৩৬ জনের।

(www.theoffnews.com - Bangladesh Rana plaza tragedy)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours